মডারেটরা দাবী করছিলো, তালেবান যা করছিলো তা নাকি সবই ইসলামের নাই।

আফগানিস্থানে তালেবানদের ৮৫ ভাগ অঞ্চল দখল করে নেয়া ও তার প্রতিক্রিয়ায় ভারতের চিন্তিত হওয়া এইসব কিছু ছাপিয়ে আমার কাছে বাংলাদেশে তালেবানপন্থিদের ‘নিখোঁজ’ হওয়া ও তার প্রতিক্রিয়া বেশি আকর্ষণ করছে। মুফতি মাহমুদুল হাসান গুনবী নামের একজন ‘গুম’ হওয়ার দাবী করছে তার অনুসারীরা। গণসংহতি সমিতির জুনায়েদ সাকিকে দেখলাম মাহমুদুল হাসান গুনবীকে গুম থেকে সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে সরকারের প্রতি কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। এর আগে আবু ত্বহা মুহাম্মদ আদনান নামের আরেক ইস লামী বক্তার কথিত গুমের বিরুদ্ধে তারা ফেইসবুকে তুমুল শোরগোল তুলেছিলেন। জাতীয় ক্রিকেট দলের কিছু খেলোয়াড়কেও তখন আবু ত্বহা’র কথিত নিখোঁজে খুবই উদ্বিগ্ন দেখিয়েছেন। কথিত গুম ও গ্রেফতার হওয়া এই ব্যক্তিগুলি ‘বাংলাদেশী তালেবান’ বলে সুপরিচিত। কারণ মুফতি মাহমুদুল হাসান গুনবী, মাওলানা হারুন ইজহার, আলী হাসান ওসামা- এই তিনজনকে আনসার আল ইস লাম, দাওয়াতুল ইস লামের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি মনে করা হয়। ‘আনসার আল ইস লাম’ নিজেদের আল কায়ে দার ভারত উপমহাদেশের (একিউআইএস) শাখা বলে দাবী করে। এই সংগঠন বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলসহ উত্তরবঙ্গের চরাঞ্চলে জঙ্গি কার্যক্রম ব্যাপকভাবে পরিচালনা করে আসছিলো। পাহাড়ী আদিবাসীদের ধর্মান্তকরণ, পাহাড়ে মস জিদ, মাদ্রাসা বানিয়ে সেখানে জঙ্গি তত্পরতা বৃদ্ধি করার মাস্টার প্লাণ হাতে নিয়েছিলো। পাহাড় থেকে দরিদ্র আদিবাসী শিশুদের ঢাকায় এনে মাদ্রাসায় ভর্তি করে তাদের ইস লাম ধর্মে দীক্ষা দেয়ার নেটওয়ার্ক বেশ কয়েক বছর ধরে ধরা পড়ছিলো। আমরা মনে হয় না গোটা বাংলাদেশে আনসার বাংলার এইসব কাজকর্মে কেউ উদ্বিগ্ন। কারণ পাহাড়ে মসজিদের প্রয়োজনীয়তা জানিয়ে একটি বহুজাতিক মোবাইল কোম্পানির এড নির্মাণ করেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ পুত্র নুহাশ হুমায়ূন। দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী ক্রিকেট খেলোয়াড়দের মধ্যে গুনবী, ত্বহা, হারুণ ইজহারদের জনপ্রিয়তা কোন গোপন বিষয় নয়। উগ্র ইসলামী ‘শিশু’ বক্তার সঙ্গে জনপ্রিয় ক্রিকেটারের ছবি ফেইসবুকে খেলোয়াড়রাই পোস্ট করেছিলেন। অথচ এইসব বক্তারা কি বক্তব্য রাখেন, তারা কি চান তার সব কিছুই ফেইসবুকে-ইউটিউবে শত শত ভিডিও সকলেই দেখে শুনে জানে। জুনায়েদ সাকি কি জানে না গুনবী তার ভিডিওতে কি করে ‘ক তল’ ‘জি হাদ’ করতে অস্ত্র হাতে কা ফের মুশ রিকদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে বলে?

আফগানিস্থানে যখন মার্কিন বোমা হামলায় মোল্লা ওমর মারা গিয়েছিলো তখন তার মৃত্যুতে কেউ শোক প্রকাশ করেনি। কেন করেনি? দেশে গুম খুন নিয়ে প্রতিবাদ আর দেশে চলমান তালেবানপন্থি ওয়াজীদের গ্রেফতারকে বাক স্বাধীনতা বলে দাবী করা লজিক্যাল ফ্যালাসি। ফেইসবুকের নীতিমালায় স্পষ্ট করে বলা আছে, কেউ যদি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হলোকাস্টকে অস্বীকার করে বা প্রশংসা করে তাহলে সেটা কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড লঙ্ঘন বলে ধরা হয়। আপনি যদি আপনার সন্তানের নাম ‘হিটলার’ রাখেন তাহলে ইউরোপে আপনাকে এর জন্য জবাবদেহী করতে হবে। তাহলে বাংলাদেশ ভারত পাকিস্তানে যেসব ইস লামী বক্তা লাগামহীনভাবে অমুস লিমদের ধর্মান্তরক করতে বলছে, তাদের উপর জি হাদ করতে বলছে, তাদের উপর ‘ক তল’ করতে বলছে, নাস্তিক, সমকামী, ভিন্নমতালম্বীদের হত্যা করতে প্রতিনিয়ত আহ্বান জানাচ্ছে সেটা কি করে বাক স্বাধীনতা হয়?

এটা ঠিক কেউ দোষী হলে তার বিচার করার জন্য আইন আছে। সরকার সেই মোতাবেক ব্যবস্থা নিবে। তা না করে কেউ ‘গুম’ হয়ে যাবে কেন? যদি তৃতীয় কোন পক্ষও সেটা করে থাকে সেটাও প্রশাসনই খুঁজে বের করবে। এই পর্যন্ত সবই ঠিক আছে। কিন্তু আপনি সারা বছর গুনবী, ত্বহাদের জি হাদী কার্যক্রম দেখে মুখ সেলাই করে বসে রইলেন, জীবনেও তাদের ওয়াজের একটা সমালোচনা করলেন না, কিন্তু তারা গ্রেফতার হওয়া মাত্রই তাদের বাক স্বাধীনতার জন্য অস্থির হয়ে গেলেন, তাদের ‘গুম’ হওয়াকে দেশে নিরাপত্তাহীন বলে চিল্লাচিল্লি করতে শুরু করলেন- আপনাকে নিয়ে সন্দেহ হবে না? দেশী এই তালেবানীদের সারা বছর উগ্র কাজকর্ম, বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক উশকানি দিয়ে হামলা চালানোর সময় তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলেননি। এখন তাদের বিষয়ে উদ্বিগ্ন কেন?

বিশ বছর আগে তালেবান যখন প্রথম আফগানিস্থান দখল নিলো গোটা বিশ্ব দেখল এই আধুনিক যুগে মেয়েদের ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ হয়ে গেলো। পুরুষদের সবার দাড়ি রাখার আইন হলো। সিনেমা হল, খেলার মাঠ বন্ধ করে দেয়া হলো। শরীয়া আইনে বিচার হতে লাগল। তখন ‘তালেবানের সঙ্গে ইস লামের কোন সম্পর্ক নেই’ এটা প্রমাণ করাই সবার কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। মুফতি আমিনীরা ভন্ডামী ছাড়া প্রকাশ্যে তালেবানদের স্বাগত জানিয়েছিলেন। সেসময় হারুন ইজহারের বাবা মুফতি ইজহারদের মত মুফতিরা আফগানিস্থান সফর করেছিলেন তালেবানদের নিমন্ত্রণে। কিন্তু মডারেটরা দাবী করছিলো, তালেবান যা করছিলো তা নাকি সবই ইস লামের নাম দিয়ে আমেরিকা করাচ্ছে। আজ বিশ বছর পর ফের সেই তালেবান যখন ক্ষমতায় তখন সেই তারাই বলছে তালেবান প্রমাণ করেছেন আফগানদের কেউ পরাজিত করতে পারে না! বিশ বছর পর একজন সেদিন প্রথম আলোতে লিখতে দেখলাম, তিনি তার বইয়ের জন্য তথ্য উপাত্তা সংগ্রহ করতে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন তালেবানদের ঘনিষ্ঠ এমন একজন পাকিস্তানীকে যাকে নিজের ‘বন্ধু’ বলে সম্বধোন করছেন! তালেবানকে ‘জাতীয়তাবাদী’ মুক্তি সংগ্রামী একটি চরিত্র দেয়া হচ্ছে। আমার বিশ্বাস, দশ বছরের মধ্যে সিরিয়াতে আইএস রাজনৈতিকভাবে তালেবানের মত অবস্থানে চলে আসলে বহু কোট প্যান্ট পরা আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক এভাবেই আইএসকে জাতীয়তাবাদী মুক্তি সংগ্রামী হিসেবে দেখাবে। বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিশ বছরের মধ্যে আফগানিস্থানের মত তালেবানপন্থিদের হাতে রাজনৈতিক পরাজয় হলে গুলশান হামলাকারীদের পশ্চিমা মদদপুষ্ট সরকারের বিরুদ্ধে ‘প্রথম শহীদ’ খেতাব দিতে এমন লোকজনকে দেখব যাদের এখন মৌলবাদীদের বিপরীত দলের লোক বলে আমরা ভ্রম করছি।

তাই আফগানিস্থানে ১০০ ভাগ দখল করে নিলেও আফগান তালেবানদের কথা ভাবার চাইতে দেশী তালেবান ও তাদের সমর্থকদের কথা ভাবাই বেশি প্রসিঙ্গক।

#সুষুপ্তপাঠক
#susuptopathok

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted