আমি বিশ্বাস করি না প্রোফাইলের ছবি কালো করলে বাঙ্গালী হিন্দুদের কোন সুবিধা হয়। আমি সত্যিই মনে করি না, হ্যাশট্যাগ মেরে খুব বেশি কিছু লাভ হয়। বড় জোর নিজের মনকে একটা ভুলভাল বুঝিয়ে দেওয়া যায় যে কিছু একটা তো করলাম। আমি বলছি, লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি প্রোফাইলে অনলাইন নিন্দার ঝড় বয়ে গেলেও বাংলাদেশের আদি বাঙালিদের উপর আক্রমণ একটুও কমত না। অনলাইন আন্দোলন কেবল তখনই কাজ করে যখন মাঠে ময়দানেও কিছু কাজ হয়। মাঠে ময়দানে কাজ বলতে শুধু মারামারির কথা বলছি না, সরকারি স্তরে বা UN-এ নিজের জাতির জন্য লবিবাজি করাটাও একটা কাজ। সেটা আছে বলেই পাকিস্তান ও বাংলাদেশে ইসকনের গায়ে খুব একটা হাত পড়ে না।
তবে নিজের কথার বিরুদ্ধে গিয়ে আরো একটা কথা বলি কারণ সেটা বাঙ্গালীর জন্য প্রযোজ্য। সেটা হচ্ছে যে এই প্রোফাইল ছবি কালো করাটা অন্য জাতির জন্য না হলেও বাঙ্গালীর জন্য একটা বিরাট বড় কাজ। কারণ বাঙ্গালী এটুকু করতেও সাত মাস সময় নেয়, ভয় পায় যে পুলিশ এসে তাকে ধরে নিয়ে যাবে। ফলে আজকের বাঙ্গালীর জন্য এটুকু করাটাই একটা বিরাট বড় আন্দোলন। আর এটাই সব থেকে বেশি আশঙ্কার বিষয়। বাঙ্গালীর প্রশাসনকে ভয় এবং মৃত্যু ভয়। ভয় না কাটাতে পারলে কোন জাতির মুক্তি ঘটে না।
এখন প্রশ্নটা হল ভয় কাটিয়ে উঠে করবটা কি? কারণ জাতি চেতনা বলতে কি বোঝায়, সেই বিষয়ে বাঙ্গালীর ধারণা অত্যন্ত অস্বচ্ছ এবং অস্পষ্ট। বাঙ্গালী মনে করে জাতি চেতনা মানে অবাঙালি কেউ রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইলে খুশি হওয়া বা নেতাজীকে গুরুত্ব দিলে আনন্দ পাওয়া। "আমাদের নেতাজি, আমাদের রবীন্দ্রনাথ"- এর বাইরে যে জাতি চেতনা বলে কিছু থাকতে পারে, এই বিষয়ে বাঙ্গালীর কোন ধ্যান ধারণা নেই। ফলে গোটা জাতিটাই হয়ে গেছে প্রতিক্রিয়াশীল আর পরমুখাপেক্ষী। প্রতিক্রিয়াশীল কারণ জিহাদিরা কোন ক্রিয়া সম্পন্ন করলে তবেই আমরা ভাবি হ্যাশট্যাগ লাগানোর কথা। আর পরমুখাপেক্ষী তো বাংলাদেশের বাঙ্গালী হিন্দু সেদিনই হয়ে গেছে, যেদিন থেকে তারা নিজেদের নাম ফেসবুকে হিন্দিতে লিখে মনে করেছে, গোটা ভারত তাদের বাঁচাবে।
আমি বাংলাদেশের নির্যাতিত বাঙ্গালী হিন্দুর কাছে জানতে চাই, আপনাদের দিল্লি এবং গোয়া ঘুরে যাওয়া বড় বড় স্বয়ংসেবক নেতারা কয়টা পূজা মণ্ডপ বাঁচাতে পেরেছেন? "ভারত কিছু করবে" বকে যারা ওখানে ভাবছেন, তারা আগে বলুন তো, ভারত সম্পর্কে আপনাদের ধারণাটা ঠিক কি? দিল্লির এত কাছে কাশ্মীর, সেখানে কাশ্মীরি পণ্ডিতরা আবার মার খাচ্ছে, কোন ভারত সরকার কি করতে পেরেছে? তো বাকি ভারতের অবাঙালি হিন্দুরা কজনকে বাঁচাবে? কাশ্মীরি পণ্ডিতদের? উত্তর প্রদেশের মেরোঠ থেকে পালানো হিন্দুদের, হরিয়ানায় মার খাওয়া হিন্দুদের? মার খাওয়া হিন্দু জাতির সংখ্যা ভারতে কম নেই। তো তারা নাড়ির টান কার সঙ্গে বেশি অনুভব করবে, ওদের সাথে নাকি আপনাদের সাথে?
আমি আরো একটা প্রশ্ন রাখতে চাই, আপনাদের ওখানকার দুর্গা পূজায় আজকাল এত রাম-হনুমানের ছড়াছড়ি কেন? বাঙ্গালীর দুর্গা পূজা তো মহারাজা সূরথের হাত ধরে। আপনারা রাম হনুমান দিয়ে ঠিক কি বার্তা দিতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশের স্থানীয় মুসলিম সমাজের কাছে? আপনারা জানেন না "জয় শ্রী রাম" এখন একটা আদ্যোপান্ত রাজনৈতিক স্লোগানে পরিণত হয়েছে? সিগনাল বোঝেন, সিগনাল? দিকে দিকে এত রাম, হনুমান যে সেই "জয় শ্রী রাম" আন্দোলনের সাথে নিজেকে একাত্ম করার চেষ্টা, সেটা বাংলাদেশের জেহাদি সমাজ বুঝেছে। লক্ষ্য করে দেখুন, প্রথম সংঘর্ষটা সেই হনুমান মূর্তিকে কেন্দ্র করেই শুরু হয়েছে।
তো আমি কি বলতে চাইছি যে ওখানে হনুমানের বদলে জয়া বিজয়া বা দেবীর অন্য কোন সহচরী থাকলে আক্রমণ হত না। হতেই পারত। আপনারা হঠাৎ গো বলয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ার আগে তো কতই আক্রমণ হয়েছে। তাহলে? বলতে চাইছি একটাই কথা যে এসব রাম হনুমান করে আপনারা ওখানে বাঁচবেন না। "হরে রাম" আর "জয় শ্রী রাম" দুটো এক জিনিস নয়। আপনি যত নিজেকে বাঙ্গালী থেকে গো বলয়ের সাথে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করবেন, তত আপনি বাঙ্গালী কম, হিন্দু বেশি হয়ে যাবেন। মনে রাখবেন, গোটা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ কিন্তু বাঙ্গালীর দেশ। ওই দেশে বসে যদি আপনি নিজেদের বাঙ্গালী হিন্দু পরিচয়কে তুলে ধরতে না পারেন, বিশ্বের কোন লোককে আপনি বোঝাতে পারবেন না যে ওই দেশের উপর আপনার বৈধ দখল আছে।
যত আপনি সংস্কৃত শ্লোক হিন্দি লিপিতে লিখবেন, ততই আপনি ওদেরকে আরবী ভাষায় লেখার জন্য অভিযোগ করার অধিকার হারাবেন। কারণ সংস্কৃত শ্লোক বাংলা ভাষাতেই লেখা হত, আপনি বিজাতীয় লিপিতে লিখে ওদেরকে আপনাকে বিজাতীয় বানানোর সুযোগ করে দিচ্ছেন। আপনাকে যদি ভারতের কারু সাথে গাটছড়া বাধতেই হয়, তাহলে সেটা হওয়া উচিত পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরার বাঙালিদের সাথে। এসব জায়গার বাঙালিদের মধ্যে যদি আপনাদের নিয়ে কোন চেতনা তৈরি হয়, কেবল সেইটা আপনাকে বাঁচাতে পারে। কিন্তু তার জন্য আপনাদের হিন্দু-হিন্দু না করে "বাঙ্গালী হিন্দু বাঙ্গালী হিন্দু" করতে হবে।
আপনি হয়তো ভাবছেন যে অখণ্ড হিন্দুত্বের একটা শক্তি আগে থেকেই তৈরি আছে, বাঙ্গালী হিন্দুর তো সেরকম কোন জোর নেই। ওটা করতে গেলে হয়তো শূন্য থেকে শুরু করতে হবে। হ্যাঁ হবে। শূন্য থেকেই শুরু করতে হবে। কিন্তু আপনাকে কোন রকম রক্ষা কবচ যদি কেউ দিতে পারে, তবে সেটা এটাই। আর অন্য কোন কিছু আপনাকে বিন্দুমাত্র সাহায্য দেবে না। শুধু একের পর এক রিপোর্ট লেখা হবে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিডিও ছড়াবে, ব্যস, এটুকুতেই শেষ। আপনারা শুধু হিন্দু নন, বাঙ্গালী হিন্দু ওই মাটির আদিবাসী এবং একমাত্র ভূমিপুত্র। এই কথাটা মন থেকে বিশ্বাস করুন, কোন কাগজে রিপোর্টে "হিন্দুদের উপর হামলা হয়েছে" লিখলে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করুন। হামলা হিন্দুদের উপর হচ্ছে না, বাংলাদেশে হামলা হয় "বাঙ্গালী হিন্দুর উপর"। যখন নিজেকে "হিন্দু" থেকে "বাঙ্গালী হিন্দু" প্রমাণ করতে পারবেন, তখনই আন্তর্জাতিক স্তরে লবি করে নিজেদের জন্য কিছু আদায় করতে পারবেন।
কারণ গোটা বিশ্বের কাছে হিন্দু একটা ভারতীয় জাতি, ধর্ম। এর সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক কি, এটা আপনি চট করে কাউকে বোঝাতে পারবেন না। উল্টে তারা আপনাকে বাংলাদেশে কোন ভারতীয় বহিরাগত জাতি বলে ধরে নিতে পারে। জেহাদিরা তো এই কথাই বলে, বাংলাদেশ হল বাঙ্গালীর দেশ, হিন্দুরা হিন্দুস্থানে যাক। আপনি নিজেকে শুধুমাত্র হিন্দু বলে, দিল্লির সমর্থন চেয়ে জিহাদিদের পাতা ফাঁদেই পা দিচ্ছেন। একটা সত্য খুব ভাল করে বুঝুন, কেবলমাত্র দুটো জিনিস আপনাকে রক্ষা করবে। আন্তর্জাতিক লবি আর পশ্চিমবঙ্গের চাপ। এই দুটো পেতে গেলে অবশ্যই আপনাকে বাঙ্গালী হিন্দু হতে হবে।
আমি জানি না, এই সহজ সত্যি কথাটা ঠিক কতবার বললে বাংলাদেশের বাঙ্গালী হিন্দুর মগজে ঢুকবে। কিন্তু এটাও জানি, বাংলাদেশের বাঙ্গালী হিন্দু আর পশ্চিমবঙ্গ-অসম-ত্রিপুরার বাঙ্গালী হিন্দুর ভাগ্য ওই একই জায়গায় বাঁধা। যতদিন না এই কথাটা বাঙ্গালী হিন্দুর মাথায় ঢুকবে, আমাদের সবার একই হাল হবে। কোন অখণ্ড হিন্দুত্বের মহান দর্শন এই জাতিকে বাঁচাতে পারবে না। আমার কলম এই কথা আগেও বলেছে, ভবিষ্যতেও বলবে।
আমার জাতি মরছে পুড়ে,
সুদিন আসবে কবে?
জয় মা কালী, জয় বাঙালী,
জয় আমাদের হবে।
#বাংলাদেশে_হিন্দু_আক্রান্ত_নয় #আক্রান্ত_বাঙ্গালী_হিন্দু
ছবি কৃতজ্ঞতা:- সঞ্জয় অধিকারী
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................