হিন্দুদের অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি।

“হিন্দুদের “অসাম্প্রদায়িক” রাজনীতি”
ডাঃ মৃনাল কান্তি দেবনাথ

1937 সালে স্বায়ত্ব শাসন চালু হবার পর পশ্চিম বাংলায় ফজলুল হক সাহেবের "কৃষক প্রজা পার্টি' সব চেয়ে বেশী আসন লাভ করেছিলো। ফজলুল হক ছিলেন আপাঙ্গ ভারতীয় এবং মুসলিম লীগের সম্পুর্ন বিরোধি।

তিনি ততকালীন কংগ্রেস নেতাদের দরজায় দরজায় ঘুরেছিলেন শুধু একটি মাত্র অনুরোধ নিয়ে। সেটা হলো, কংগ্রেস আর কৃষক প্রজা পার্টি এক যোগে পশ্চিম বাংলায় সরকার গঠন করুক আর মুসলিম লীগ ক্ষমতা থেকে দূরে থাকুক।


একমাত্র শ্যামাপ্রাসাদ ছাড়া আর কেউ ফজলুল হকের অনুরোধের মর্মার্থ বোঝেন নি সেই সময়। তাই তৈরী হয়েছিলো "শ্যামা -হক মন্ত্রীসভা"।

পরবর্তিতেও দিল্লীর এবং সাবরমতি আশ্রমের কংগ্রেসি নেতারা কোন দিন মুসলিম লীগকে আটকানোর কোনো চেষ্টা করেন নি। মুসলিম লীগ তদাবধি ছিলো ঢাকার নাজিমুদ্দিন (নবাব বংশের লোক) এবং ইস্পাহানী কোম্পানীর মালিকের এক প্রাইভেট ক্লাবের মতো। ১৯০৬ সালে তৈরী মুসলীম লীগ প্রথম মান্যতা পায় পশ্চিম বাংলায় ১৯৩৭ সালে। অন্যত্র কোথাও বেশী ছিলো না।

সেই মুসলিম লীগের উত্থান শুরু হয়েছিলো যখন কংগ্রেস মন্ত্রী সভায় না গিয়ে সরে দাড়ালো আর মুসলিম লীগ ঢুকে গেলো।

জিন্না অবশ্যই দেশ ভাগের একজন মধ্য মনি। কিন্তু যদি তাকে সেই সুযোগ না করে দেওয়া হতো তাহলে তার পক্ষে সম্ভব ছিলো না দেশ ভাগ করার। জিন্না কোনদিন ভাবতেও পারেননি যে অতো সহজে কংগ্রেস দেশটাকে দুই টুকরো করতে রাজী হবে। একটু ভয় দেখালেই কাজ হাসিল হবে এটা কে ভাবতে পারে??? তাই জিন্না বলেছিলো "হুন্সসে লিয়া পাকিস্তান,লড়কে লেংগে হিন্দুস্তান"। কংগ্রেস এবং হিন্দু নেতা গুলোকে (নেতাজী, শ্যামাপ্রসাদ আর সাভারকরকে বাদ দিয়ে) জিন্না খুব ভালো করেই জানতো,তাদের মেরুদন্ড কতো শক্ত।

আমার বক্তব্য ঠিক ওই খানে। গৃহকর্তা যদি দরজা খুলে চোরকে স্বাগত জানায় তাহলে দোষ কার????? চোরের না মালিকের???? অসাবধানতা ও এক ধরনের পাপ,তাই না??

১৯০৬ সালে মুসলীম লীগ প্রতিষ্ঠা হলেও তার প্রভাব সীমিত ছিলোশুধু মাত্র প্রাক্তন মুসলিম শাসক পরিবারের বংশধরদের এবং ধনাঢ্য ব্যাবসায়ী শ্রেনীর মধ্যে। সাধারন ,সমাজের অন্ত্যজ শ্রেনীর মুসলিম রা সেই অভিজাত লীগের খবর ও পায়নি। সেই ভাবেইচলছিলো।

জিন্না, কংগ্রেসী ছিলেন। গোঁড়া মুসলিম হিসাবে তিনি কোনোদিনইপরিচিত ছিলেন না। বিদেশী পোষাক পরতেন, মসজিদে যেতেন না, মদ্য পান করতেন নিয়মিত। উচ্চশিক্ষিত, ব্যরিষ্টার,চোস্ত ইংরেজি বলতেন আর তার ছিলো প্রখর বুদ্ধি। গান্ধী দক্ষিন আফ্রিকা থেকে হঠাৎ দেশে এসে অতি হঠাৎ ই কংগ্রেসের সর্বময় নেতা হয়ে গেলেন। সেই সময় ভারতের খবরের কাগজ গুলো সবই প্রায় ইংরেজদের মালিকানায় ছিলো । সেই সব কাগজে বেশ হঠাৎ করেই গান্ধীর দক্ষিন আফ্রিকার কার্যকলাপ বিশেষ করে ছাপা হয়ে প্রচার পেতে শুরু করেছিলো। তখন অন্য কোনো প্রচার মাধ্যম ছিলো না। দক্ষিন আফ্রিকার সংগে যোগাযোগ ছিলো জাহাজের মাধ্যমে। ব্রিটিশ সরকারের প্রচেষ্টায় গান্ধী ভারতে আসার আগেই কংগ্রেসীদের মাথার মুকুট্ মনি হয়ে বসেছিলেন। দেশে ফিরেই তিনি সর্বময় কর্তা হয়ে গেলেন। কি আশ্চর্য্য!!!!!!

কংগ্রেস মুলত একটি অসাম্প্রদায়িক দল ছিলো। সেই ভাবনার পরিবর্তন হলো গান্ধীর নেতৃত্তে। প্রার্থনা সভায় বসে, যেখান থেকেই গান্ধী মুলত তার প্রচার চালাতেন সেটা শুরু হতো রামধুন দিয়ে। এই প্রথা জিন্নার পছন্দ হয়নি। রাজনীতির সংগে ধর্মীয় প্রথা চালু করার পক্ষপাতি জিন্না ছিলেন না। গান্ধীর হঠাৎ করে সর্বময় কর্তৃত্ত নিয়েও তার সন্দেহ দেখা দিলো। পরিশেষে গান্ধীর নানা কার্য কলাপে তিনি বিরক্ত হয়ে কংগ্রেস ছেড়ে চলে গেলেন লন্ডনে, শুরু করলেন লর্ড র্যারডক্লিপের (যিনি ভারত ভাগের সীমা রেখা তৈরী করেছিলেন) কাছে থেকে ব্যারিষ্টারী। গান্ধী জিন্নার এই রাজনৈতিক অংগন থেকে দূরে চলে যাওয়ায় খুশী ছিলেন।তার এক প্রতিযোগি তো গেলো।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে তুরষ্কের খলিফার খলিফা গিরি চলে গেলো। খোদ তুরষ্কে বা পৃথিবীর আর কোনো মুসলীম দেশে এই নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য শোনা গেলো না। প্রান কেঁদে ঊঠলো গান্ধীর। খলিফা তন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য গান্ধী শুরু করলেন মরন পন সংগ্রাম। মহম্মদ আলী ভাতৃদ্বয়কে সংগে নিয়ে গান্ধী সারা ভারত চষে বেড়ালেন, শুরু করলেন মুসলীম জনসাধারনকে রাজনৈতিক ভাবে জাগিয়ে তুলতে। খিলাফত আন্দোলনের সেই একটাই ফলশ্রুতি, গান্ধী মুসলিমদের রাজনৈতিক অধিকার দাবী করার জন্য তাদের সজাগ করে দিলেন। হ্যা, প্রায় ঘুমিয়ে থাকা, ভারতের প্রাক্তন বৈদেশিক শাসক শ্রেনীর বংশধরেরা রাজনৈতিক ভাবে সচেতন হলো, গান্ধীর রাজনৈতিক প্ররোচনায় তারা বুঝলো যে তারাই একসময় ভারতের শাসক ছিলো।

জিন্না তখনো বিলেতে প্রাকটিস করছেন। কবি আল্লামা ইকবাল ‘গান্ধীকর্তৃক জাগ্রত মুসলিম’ দের রাজনৈতিরক স্বপ্ন দেখালেন। সারা দেশে, রাজনৈতিক ভাবে জাগ্রত মুসলিমদের তিনি শোনালেন “পাকিস্তান” এর গল্প। আরো শেখালেন যে, ভারতের মুসলমান রা হিন্দুদের থেকে সতন্ত্র এক জাতি ,তাদের কোনোদিনই হিন্দুদের সংগে একসংগে, এক দেশে ,এক শাসনে থাকাউচিত নয়। ইকবাল রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না। তাই তিনি চেষ্টা চালালেন জিন্নাকে রাজনৈতিক সন্ন্যাস থেকে ফিরিয়ে আনতে। ১৯৩৩ সালে জিন্না লন্ডন থেকে ফিরে এলেন পুরোদস্তুর সাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে, আর এসেই ‘মুসলিম লীগে’ র নেতা হয়ে গেলেন।

মুসলিম জনসাধারনকে জাগানোর কাজ সেই যে গান্ধী শুরু করেছিলেন, সেটার পুর্নাংগ রুপ পেলো জিন্নার সুচতুর রাজনৈতিক কার্য কলাপে। গান্ধীর চোখের সামনেই জিন্না একের পর এক ছিনিয়ে নিলেন কংগ্রেসী মুসলিম নেতা দের। সাধারন মুসলিম রা বন্যার প্লাবনের মতো যোগ দিলো কংগ্রেস ছেড়ে তাদের জন্য তৈরী মুসলিম লীগে। সেই শুরু হলো, মুসলিমলীগের উত্থান আর দেশ ভাগের রাজনৈতিক পরিকাঠামো। জিন্নার রাজনৈতিক চালের সামনে দাড়ানোর মতো বুদ্ধি বা কর্ম নিপুনতা নেহেরু বা গান্ধীর ছিলো না। মাত্র ৪ বছরের মধ্যে (১৯৩৩থেকে ১৯৩৭) ভারতের প্রতিটি মুসলিম প্রধান প্রদেশে তৈরী হয়ে গেলো মুসলিম লীগের শক্ত ভিত। ১৯৩৭ সালের স্বায়ত্ব শাসন চালূ হবার পর যে ভোট হলো তাতে দেখা গেলো মুসলিম লীগের পায়া সারা জায়গায় বেশ ভারী। তার ঠিক ১০ বছরের মধ্যে জিন্না ড্যাং ড্যাং করে, গান্ধীএবং নেহেরুকে পিছনে ফেলে ,তাদের চোখের সামনেই হাজার হাজার বছরের সভ্যতা সম্পন্ন, এক হিন্দু সংখ্যা গরিষ্ট দেশ কে (প্রায় ৮৫%) দুই ভাগ করে, প্রায় এক তৃতীয়াংশ ভারতকে একচরম ভারত বিরোধী দেশ তৈরী করে এবং ভবিষ্যতে আরো টুকরো করার ব্যাবস্থা করে গেলো। মাত্র ১২ % মুসলিম ৩৩% ভুমি নিয়ে গেলো আর শিক্ষিত,বুদ্ধিমান (???) হিন্দুরা খোলা চোখে তা দেখলো। কারো চোখে ছানি পড়লো না।

সেই থেকে কংগ্রেস শুরু করলো ‘সেকুলারিজিম’ এর নামে সাম্প্রদায়িক রাজনিতী। সেই খেলা আজো চলছে।

আমাদের পশ্চিম বংগে সেটা বড়ো বেশী। এখানে কংগ্রেস ছাড়া আর একটি দল আছে যারা আমাদের দেশ টাকে ১৭ ভাগে ভাগ করতে চায়। তারা সারা পৃথিবী থেকে উৎখাত হয়ে গেলেও এখানে বেশ আছে। রাজনৈতিক ভাবে দেওলিয়া হয়ে তারা এই দেশ টাকেই দেওলিয়া করতে চায়। 

পশ্চিম বংগের জনসাধারন এই দলটিকে চিনে নিয়ে এবারে ভিড়েছে আর একটি দলে, যে দল ওই কংগ্রেস থেকেই জন্ম নিয়েছে। এই দলের নেতা নেত্রীরা আবার গান্ধী নেহেরুর থেকেও ১০০ গুন ‘সেকুলার’। গান্ধী খিলাফত আন্দোলন করে ভারত ভাগ করার যে রাস্তা তৈরী করে দিয়েছিলেন, এই দলটি আরো এগিয়ে গিয়ে একবার ভাগ করা “বাংলা’ কে আবার পুনরায় এক করে এখানে বাস করা হিন্দুদের ‘বৃহত্তর বাংলা’ র সংখ্যলঘুতে পরিনত করার সমস্ত ব্যাবস্থা পুর্ন করে দিচ্ছে। সাবাশ! শ্যামাপ্রসাদের রাজনৈতিক প্রচেষ্টায় যে হিন্দুরা বেচে গিয়েছিলো, পুর্ব পাকিস্তানের থেকে বিতাড়ীত হিন্দুরা যেখানে আশ্রয় পেয়েছিলো, সেই পশ্চিম বংগ আজ আবার এক চরম বিপদের সম্মুখীন।। 

সাবাশ! হিন্দু (সেকুলার) রাজনীতি, সাবাশ!!!!!

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted