ওয়াশিংটন ডিসির এমব্যাসি রো’তে সোনালী ও দুধসাদা রঙের দেবি সরস্বতী, স্থাপন করেছে মুসলিম দেশ।

আমেরিকার ওয়াশিংটন ডিসির এমব্যাসি রো’তে আছে বিভিন্ন দেশের দূতাবাস। রঙবেরঙের জাতীয় পতাকা। বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের সামনে দেশগুলির প্রাতঃস্মরণীয় মনীষীদের ভাস্কর্য দেখতে পাবেন।

ব্রিটিশ দূতাবাসের সামনে দেখবেন উইনস্টন চার্চিলের মূর্তি। ভারতের দূতাবাসের সামনে
মহাত্মা গান্ধীর মূর্তি, সাউথ আফ্রিকার দূতাবাসের সামনে নেলসন ম্যান্ডেলার মূর্তি, তুর্কীর দূতাবাসের সামনে মুস্তাফা কামাল আতাতুর্কের মূর্তি।

সরস্বতীর


এভাবে এগিয়ে চলুন। একটা জায়গায় আপনার চোখ হোঁচট খাবেই। একটি দূতাবাসের সামনে তাঁদের দেশের কোনো প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তির মূর্তি নেই। সেখানে বিরাজ করছেন সোনালী ও দুধসাদা রঙের হিন্দুদের বিদ্যার দেবী সরস্বতী। মূর্তিটির ঠিক নীচে সেই দেশের স্কুলে বাল্যকালে পাঠরত কিশোর বারাক ওবামা ও তার দুই সহপাঠীর ভাস্কর্য।

দেশটির নাম শুনলে অবাক হবেন। বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম সংখাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়া!

এই ইন্দোনেশিয়াই পৃথিবীর একমাত্র রাষ্ট্র, যে দেশ তাদের দূতাবাসের সামনে সে দেশের জাতির জনক সুকর্নর মূর্তি না বসিয়ে বসিয়েছে বৈদিকযুগের শিক্ষার দেবী সরস্বতীর মূর্তি।

যে দেশের ৮৭% মানুষ মুসলিম, সে দেশের মুক্তচিন্তা ও সুপ্রাচীন হিন্দু ঐতিহ্যর প্রতি সম্মান ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতা বোঝাতে এই  একটি মাত্র উদাহরণই যথেষ্ট।

কিন্তু যে দেশে মাত্র ৩ শতাংশ হিন্দু সেখানে হিন্দু দেবী মা সরস্বতী দূতাবাসের সামনে কেন? ভারতের পল্লব রাজত্বের বণিকদের হাতধরে হিন্দুধর্ম ইন্দোনেশিয়ায় এসেছিলো চতুর্থ শতকে।

বিকশিত হয়ে মিশে গিয়েছিল ইন্দোনেশিয়ার জীবন ও সংস্কৃতিতে। তারপরে প্রায় হাজার বছর পর ত্রয়োদশ শতক নাগাদ ইন্দোনেশিয়ার জনগণ মুসলিম ধর্মে ধীরে ধীরে ধর্মান্তরিত হলেও ইন্দোনেশিয়া আজও মুক্ত ধর্মচিন্তার প্রতীক।

ইন্দোনেশিয়া তাদের জীবনযাত্রার সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রায় হাজার বছরের পুরনো হিন্দু সনাতনী ঐতিহ্যকে ভুলতে পারেনি কিংবা ভুলতে চায়নি।

তাই পৃথিবীর বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যা নিয়েও ইন্দোনেশিয়া আজও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ইন্দোনেশিয়ার সংবিধান ‘পানসাসিলা(পঞ্চশীল) নীতিতে বিশ্বাসী।

“পঞ্চশীলা” নামের সুপ্রাচীন রাষ্ট্রের পাঁচ মূলনীতি অনুসারে ইন্দোনেশিয়ার পাঁচটি মূলনীতি হলো ধর্মীয় একত্ববাদ, মানবতাবাদ, জাতীয় ঐক্য, ঐক্যমতভিত্তিক প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র এবং সামাজিক ন্যায়বিচার।

ইন্দোনেশিয়ার সংবিধানের ২৮/ই ধারায় পরিষ্কার বলা হয়ছে এই দেশে যেকোন মানুষ মুক্তভাবে তাঁর ধর্ম অনুযায়ী ঈশ্বরের আরাধনার অধিকারী।

পৃথিবীতে ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশের পরে ইন্দোনেশিয়াই হলো চতুর্থ হিন্দু জনবহুল রাষ্ট্র।

তাই ইন্দোনেশিয়ার জনজীবনের প্রতিটি শিরায় উপশিরায় সনাতন হিন্দুধর্মের নির্যাস মিশে আছে দেড়হাজার বছর ধরে।

আদিকাল থেকে ভারতবর্ষে দেবী সরস্বতী বিদ্যা ও ললিতকলার দেবী হিসেবে পূজিত হচ্ছেন। কিন্তু ভারতবর্ষের বাইরেও দেবী সরস্বতীর পূজা হয়ে থাকে। যবদ্বীপে পাওয়া পদ্মাসনে বসা সাত তারের বীণা হাতে সরস্বতী দেবীর মূর্তি, তিব্বতে বজ্রধারিণী ময়ূর নিয়ে বজ্র সরস্বতী দেবী ও বীণাপাণি দেবী সরস্বতী, জাপানে বেনতেন নামধারিণী সর্পাসনা দ্বিভুজা বীণাপাণি,
অষ্টভুজা হপ্পিবেনতেন সরস্বতী দেবী।

আর ইন্দোনেশিয়া তে তো রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত জ্ঞান, সংগীত ও কলার দেবী সরস্বতী। (চিত্রে আমেরিকায় অবস্থিত ইন্দোনেশিয়ান এম্ব্যাসিতে ১৬ ফুট উচ্চতার দেবী সরস্বতীর ভাস্কর্য)।

ভারতবর্ষে প্রাচীন ও অতি পরিচিত ঐতিহ্যমণ্ডিত পূজা হল বিদ্যা ও সংগীতের দেবী সরস্বতীর পূজা। মাঘ মাসে শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী মায়ের পূজা করা হয়। দেবী সরস্বতীর পূজা প্রাচীন যুগ থেকেই বাঙালীর হৃদয় ও অন্তরে সমাদৃত হয়ে আসছে। তিনি শুক্ল বর্ণ, শুভ্র হংসবাহনা, একহাতে বীণা ও অন্য হাতে পুস্তক।

শুক্ল বর্ণ মানে সাদা অর্থাৎ সত্ত্ব গুণের প্রতীক। পবিত্র গীতার চতুর্দশ অধ্যায়ে আছে, ‘তত্র সত্ত্বং নির্মলাত্বাৎ’ অর্থাৎ সত্ত্ব, তমো ও রজোগুণের মধ্যে সত্ত্বগুণ অতি পবিত্র গুণ। স্বচ্ছতার প্রতীক, নির্মলতার প্রতীক।

আবার ঐ অধ্যায়ের ১৭ নম্বর শ্লোকে বলা হয়েছে- ‘সত্ত্বাৎ সংজায়তে জ্ঞানং’ অর্থাৎ সত্ত্বগুণে জ্ঞান লাভ হয়। তাই জ্ঞানময়ী সর্বশুক্লা দেবী শ্রী শ্রী সরস্বতী জ্ঞানে গুণান্বিত বলে তার গায়ের রঙ শুক্লবর্ণ অর্থাৎ দোষহীনা। পবিত্রতার মূর্তি আর জ্ঞানদান করেন বলে তিনি জ্ঞানদায়িনী।

জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সরস্বতীর বাহন রাজহংস। কারণ হাঁস অসারকে ফেলে সার গ্রহণ করে। দুধ ও জলের মিশ্রণ থেকে জল ফেলে শুধু দুধটুকু গ্রহণ করে কিংবা কাদায় মিশ্রিত স্থান থেকে তার খাদ্য খুঁজে নিতে পারে।

মায়ের সঙ্গে পূজিত হয়ে শিক্ষা দিচ্ছে, সবাই যেন অসার/ কুশিক্ষা/ অকল্যাণকর বিদ্যা পরিহার করে নিত্য পরমাত্মাকে গ্রহণ করে এবং পারমার্থিক জ্ঞান অর্জন করতে পারে।

দেবীর হাতে থাকে বীণা। সংগীতের আদি এই যন্ত্র বীণার জীবন ছন্দময়। বীণার ঝংকারে উঠে আসে ধ্বনি বা নাদ। বীণার সুর অত্যন্ত মধুর।

তাই বিদ্যার্থীদেরও মুখ নিঃসৃত বাক্যও যেন মধুর ও সঙ্গীতময় হয়। সেই কারণেই মায়ের হাতে বীণা।

তাই দেবী সরস্বতীর আরেক নাম ‘বীণাপাণি’।

বিদ্যার্থীদের লক্ষ্য জ্ঞান অন্বেষণ। আর জ্ঞান ও বিদ্যার অন্বেষণের জন্য জ্ঞানের ভান্ডার ‘বেদ’ তার হাতে রয়েছে। সেই বেদই বিদ্যা। তিনি আমাদের আশীর্বাদ করছেন আমাদের.সাফল্যের 🙏💙

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted