ধর্মান্তর নিয়ে স্বামীজীর ভাবনা
সৃষ্টির শুরু থেকেই সনাতন ধর্ম অবিচ্ছিন্নভাবে বহমান। সনাতন ধর্মকে কোন খ্রিস্টাব্দ, শকাব্দ বা বঙ্গাব্দের দিন-তারিখের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখা যায় না। এমনকি কোন এক বা একাধিক ব্যক্তির নামের সাথেও সংযুক্ত করা যায় না। কারণ, সনাতন ধর্ম কোন ব্যক্তি প্রবর্তিত ব্যক্তিকেন্দ্রিক ধর্ম নয়। যেদিন এ বিশ্ব সংসারের উৎপত্তি, সকল সৃষ্টির ধারাবাহিকতায় ঠিক সে সময়ে সনাতন ধর্মেরও উৎপত্তি। তাই এ ধর্মের শাস্ত্রীয় বিধানের মধ্যে কোনপ্রকার 'ধর্মান্তর' প্রসঙ্গ নেই। আছে শুধুই শুদ্ধিযজ্ঞ প্রসঙ্গ। অর্থাৎ যদি কেউ কোন আসুরিক ভাবাপন্নদের পাল্লায় পরে বৈদিক ধর্ম সংস্কৃতিকে পরিত্যাগ বা লঙ্ঘন করে অশুদ্ধ হয়ে আসুরিক ভাবাপন্ন হয়ে যায় ; পরবর্তীতে সে যদি তার ভুল বুঝতে পারে তবে তাকে বৈদিক যজ্ঞের মাধ্যমে শুদ্ধ হয়ে নিতে হবে।
এ শুদ্ধ হওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে সনাতন ধর্ম যদি কেউ পালন করতে চায় তাকে ধর্মান্তরিত হওয়া না বলে শুদ্ধিযজ্ঞ করে পবিত্র হওয়া বলে। বর্তমান বিশ্বে ধর্ম নামে ব্যক্তি প্রবর্তিত অসংখ্য ধর্মীয় মতবাদ আছে। কোন ধর্মীয় মতবাদের সাথে যখন ধর্মান্তর প্রক্রিয়া সংযুক্ত থাকবে তখনই বুঝতে হবে, এক বা একাধিক ধর্ম সেই ধর্মের পূর্ব থেকেই বর্তমান। সেই ধর্ম জগতের প্রথম উৎপন্ন ধর্ম নয়। পূর্বে একাধিক ধর্ম ছিল বলেই ধর্মান্তর প্রক্রিয়ায় তাঁর ধর্মে আনার প্রচেষ্টা। বিষয়টি আমরা সহজভাবে একটি আধুনিক দৃষ্টান্ত দিয়ে বলতে পারি। জগতে আজ মৃত-জীবিত লক্ষ-কোটি উচ্চতর পিএইচডি ডিগ্রিধারী ব্যক্তি ছিলেন এবং আছে। কিন্তু জগতে যিনি প্রথম পিএইচডি ডিগ্রি তার ছাত্রকে দান করেছেন তার কোন পিএইচডি ডিগ্রি ছিল না; এ কথাটি অবিসংবাদিত সত্য। জগতের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের যারা অধ্যাপক ছিলেন, তারা কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী ছিলেন না। প্রথম শিক্ষকেরা কোন পিএইচডি ডিগ্রি না থাকলেও বা সেই শিক্ষকদের স্নাতক ডিগ্রি না থাকলেও ; তাদের কিছুই যায় আসে না। তারা এ সকল উপাধি বা ডিগ্রির অনেক ঊর্ধ্বে ছিলেন। তাদের ছাত্রদের মাধ্যমে পরবর্তীতে বিষয়গুলো যুক্ত হয়েছে। তেমনিভাবে সনাতন জগতের প্রাচীনতম ধর্ম হওয়ায়, এ ধর্মে কোন ধর্মান্তরিত হয়ে আসা বা যাওয়া সংক্রান্ত কোন বিধিবিধানই নেই। বেদে শুধুই ঈশ্বরের মহিমাকে বর্দ্ধিত করতে অনার্য্যগণকে শিক্ষা প্রকৃত বৈদিক জ্ঞান দিয়ে শিক্ষিত করে তুলতে বলা হয়েছে।
ইন্দ্রং বর্ধন্তো অপ্তুরঃ কৃণ্বন্তো বিশ্বমার্য্যম্।
অপঘ্নন্তো অরাব্ণঃ।।
(ঋগ্বেদ সংহিতা: ৯.৬৩.০৫)
"হে মনুষ্যগণ, তোমরা ঈশ্বরের মহিমাকে বর্দ্ধিত করতে স্বত্ত্বাপহারী অনার্য্যগণকে শিক্ষা দাও এবং সমগ্র বিশ্ববাসীকে আর্য করে তোল।"
বর্তমানকালে যাঁর বাণী এবং রচনা দ্বারা অধিকাংশ হিন্দু ছাত্র-তরুণ-যুবক সম্প্রদায় উদ্ধুদ্ধ, তিনি হলেন স্বামী বিবেকানন্দ। ধর্মান্তর প্রসঙ্গে আমরা তাঁর মতামতগুলো বর্তমানকালে গ্রহণ করতে পারি। ধর্মান্তরিত হওয়ার বিধান বৈদিক শাস্ত্রে না থাকার পরেও, বর্তমানকালে কিভাবে পূর্বের বৈদিক পথে সবাই ফিরতে পাররে সে বিষয়ে স্বামী বিবেকানন্দের নির্দেশনা পাওয়া যায় এক ইংরেজি পত্রিকার সাংবাদিকের সাথে কথোপকথনকালে। 'প্রবুদ্ধ ভারত' নামক ইংরেজি পত্রিকার সম্পাদকের আদেশে জনৈক সাংবাদিক স্বামী বিবেকানন্দকে অন্যধর্মাবলম্বীদের হিন্দুধর্ম গ্রহণ প্রসঙ্গে তাঁর মতামত জানতে চান। স্বামী বিবেকানন্দ প্রাসঙ্গিক বিষয়টিতে তাঁর সুস্পষ্ট মতামত এবং নির্দেশনা দান করেন।তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ, বেলুড় মঠের পোস্তার নিকট গঙ্গাবক্ষে নৌকার ছাদে বসে সাংবাদিকের সাথে তার শাস্ত্রীয় শুদ্ধিযজ্ঞ এবং বর্তমানকালের পরিভাষায় ধর্মান্তর প্রসঙ্গে এক সুবিস্তৃত কথোপকথনের হয় স্বামীজীর। সেই আলোচনাটিই 'হিন্দু ধর্মের সীমানা', নামের প্রবন্ধে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল সংখ্যায় 'প্রবুদ্ধ ভারত' পত্রিকায় ছাপা হয়। পরবর্তীতে স্বামীজীর বাণী ও রচনা, নবম খণ্ডতে 'হিন্দু ধর্মের সীমানা' নামে অত্যন্ত মূল্যবান সাক্ষাৎকারটি সংকলিত হয়।
'প্রবুদ্ধ ভারত' নামক ইংরেজি পত্রিকার জনৈক সাংবাদিকের প্রথমেই জিজ্ঞাসা করেন, "স্বামীজী, যাহারা হিন্দুধর্ম ছাড়িয়া অন্য ধর্ম গ্রহণ করিয়াছে, তাহাদিগকে হিন্দুধর্মে পুনর্গ্রহণ-বিষয়ে আপনার মতামত কি জানিবার জন্য আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছি। আপনার কি মত, তাহাদিগকে আবার গ্রহণ করা যাইতে পারে?"
স্বামীজী বলিলেন, "নিশ্চয়। তাহাদের অনায়াসে গ্রহণ করা যাইতে পারে, করা উচিতও।"
স্বামী বিবেকানন্দ মুহূর্তকাল গম্ভীরভাবে চিন্তা করে আবার বলতে শুরু করিলেন:
"আর এক কথা তাহাদিগকে পুনর্গ্রহণ না করিলে আমাদের সংখ্যা ক্রমশঃ হ্রাস পাইবে। যখন মুসলমানেরা প্রথমে এদেশে আসিয়াছিলেন, তখন প্রাচীনতম মুসলমান ঐতিহাসিক ফেরিস্তার মতে ভারতে ৬০ কোটি হিন্দু ছিল, এখন আমরা বিশ কোটিতে পরিণত হইয়াছি। আর, কোন লোক হিন্দুসমাজ ত্যাগ করিলে সমাজে শুধু যে একটি লোক কম পড়ে, তাহা নয়; একটি করিয়া শত্রু বৃদ্ধি হয়।
তারপর আবার হিন্দুধর্মত্যাগী মুসলমান বা খ্রীষ্টানের মধ্যে অধিকাংশই তরবারিবলে ঐ-সব ধর্ম গ্রহণ করিতে বাধ্য হইয়াছে, অথবা যাহারা ইতঃপূর্বে ঐরূপ করিয়াছে, তাহাদেরই বংশধর। ইহাদিগের হিন্দুধর্মে ফিরিয়া আসিবার পক্ষে নানারূপ আপত্তি উত্থাপন করা বা প্রতিবন্ধকতা করা স্পষ্টতই অন্যায়। আর যাহারা কোনকালে হিন্দুসমাজভুক্ত ছিল না, তাহাদের সম্বন্ধেও কি আপনি জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন? দেখুন না, অতীতকালে এইরূপ লক্ষ লক্ষ বিধর্মীকে হিন্দুধর্মে আনা হইয়াছে, আর এখনও সেরূপ চলিতেছে।
আমার নিজের মত এই যে, ভারতের আদিবাসিগণ, বহিরাগত জাতিসমূহ এবং মুসলমানাধিকারের পূর্ববর্তী আমাদের প্রায় সকল বিজেতৃবর্গের পক্ষেই ঐ কথা প্রযুক্ত হইতে পারে। শুধু তাহাই নহে, পুরাণসমূহে যে-সকল জাতির বিশেষ উৎপত্তির বিষয় কথিত হইয়াছে, তাহাদের সম্বন্ধেও ঐ কথা খাটে। আমার মতে তাহারা অন্যধর্মী ছিল, তাহাদিগকে হিন্দু করিয়া লওয়া হইয়াছে।
যাঁহারা ইচ্ছাপূর্বক ধর্মান্তর গ্রহণ করিয়াছিল, কিন্তু এখন হিন্দুসমাজে ফিরিয়া আসিতে চায়, তাহাদের পক্ষে প্রায়শ্চিত্ত-ক্রিয়া আবশ্যক, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু যাহাদিগকে বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করা হইয়াছিল—যেমন কাশ্মীর ও নেপালে অনেককে দেখা যায়, অথবা যাহারা কখনও হিন্দু ছিল না, এখন হিন্দুসমাজে প্রবেশ করিতে চায়, তাহাদের পক্ষে কোনরূপ প্রায়শ্চিত্ত-ব্যবস্থা করা উচিত নহে।"
সেই সাংবাদিক আবার জিজ্ঞাসা করলেন,"স্বামীজী কিন্তু ইহারা কোন্ জাতি হইবে? তাহাদের কোন-না-কোনরূপ জাতি থাকা আবশ্যক, নতুবা তাহারা কখনও বিশাল হিন্দুসমাজের অঙ্গীভূত হইতে পারিবে না। হিন্দুসমাজে তাহাদের যথার্থ স্থান কোথায়?"
উত্তরে স্বামীজী ধীরভাবে বললেন, "যাহারা পূর্বে হিন্দু ছিল, তাহারা অবশ্য তাহাদের জাতি ফিরিয়া পাইবে। আর যাহারা নূতন, তাহারা নিজের জাতি নিজেরাই করিয়া লইবে।
স্মরণ রাখিবেন, বৈষ্ণব-সমাজে ইতঃপূর্বেই এই ব্যাপার ঘটিয়াছে এবং অহিন্দু ও হিন্দুধর্মের বিভিন্ন জাতি হইতে যাহারা ধর্মান্তর গ্রহণ করিয়াছিল, সকলেই বৈষ্ণব-সমাজের আশ্রয় লাভ করিয়া নিজেদেরই একটা জাতি গঠন করিয়া লইয়াছিল, আর সে-জাতি বড় হীন জাতি নহে, বেশ ভদ্র জাতি। রামানুজ হইতে আরম্ভ করিয়া বাঙলাদেশে শ্রীচৈতন্য পর্যন্ত সকল বড় বড় বৈষ্ণব আচার্যই ইহা করিয়াছেন।"
'প্রবুদ্ধ ভারত' পত্রিকার জনৈক সাংবাদিক আবার জিজ্ঞাসা করেন, "এই নূতন যাহারা আসিবে, তাহাদের বিবাহ কোথায় হইবে?"
স্বামীজী অত্যন্ত স্থিরভাবে বললেন, "এখন যেমন চলিতেছে, নিজেদের মধ্যেই।"
সাংবাদিক আবার বললেন, "তারপর নামের কথা। আমার বোধ হয়, অহিন্দু এবং যে-সব স্বধর্মত্যাগী অহিন্দু নাম লইয়াছিল, তাহাদের নূতন নামকরণ করা উচিত। তাহাদিগকে কি জাতিসূচক নাম বা আর কোনপ্রকার নাম দেওয়া যাইবে?"
স্বামীজী চিন্তা করিতে করিতে বলিলেন, "অবশ্য নামের অনেকটা শক্তি আছে বটে।"
কিন্তু তিনি এই বিষয়ে আর বেশি কিছুই বললেন না। এরপর সেই সাংবাদিকের প্রশ্নে স্বামীজী আগ্রহান্বিত এবং উদ্দীপ্ত হলেন। প্রশ্ন করলেন—"স্বামীজী, এই নব আগন্তুকগণ কি হিন্দুধর্মের বিভিন্ন প্রকার শাখা হইতে নিজেদের ধর্মপ্রণালী নিজেরাই নির্বাচন করিয়া লইবে, অথবা আপনি তাহাদের জন্য একটা নির্দিষ্ট ধর্মপ্রণালী নির্বাচন করিয়া দিবেন?"
স্বামীজী বলিলেন, "এ-কথা কি আবার জিজ্ঞাসা করিতে হয়? তাহারা আপনাপন পথ নিজেরাই বাছিয়া লইবে। কারণ নিজে নির্বাচন করিয়া না লইলে হিন্দুধর্মের মূলভাবটিই নষ্ট করা হয়। আমাদের ধর্মের সার এইটুকু যে, প্রত্যকের নিজ নিজ ইষ্ট-নির্বাচনের অধিকার আছে।"
স্বামী বিবেকানন্দের দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন শ্রীচৈতন্যদেবকে। শ্রীচৈতন্যদেব দক্ষিণ ভারত ভ্রমণের সময়ে অনেক বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ভিক্ষুসহ সাধারণ মানুষেরা তাঁর কাছে শ্রীকৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ করে। ভক্ত হরিদাস ছিলেন শ্রীচৈতন্যদেবের অন্যতম প্রধান পর্ষদ। তিনি জন্মসূত্রে ছিলেন, ইসলাম ধর্মালম্বী। ভক্ত হরিদাস প্রতিদিন নিষ্ঠার সাথে লক্ষবার হরিনাম জপ করতেন। বিদেশি তুর্কি শাসিত মধ্যযুগে মুসলিম পরিবারের সন্তান হয়ে সর্বদা হরিনাম করাটা ছিল ভয়াবহ জীবন নিয়ে খেলা। হরিনাম জপ করার অপরাধে তাকে বেত্রাঘাত করতে করতে বাইশটি বাজার ঘুরানো হয়। এরপরেও ভক্ত হরিদাস হরিনাম পরিত্যাগ করেননি। নাম করতে করতে বৃদ্ধ বয়সে ভক্ত হরিদাসের মৃত্যু হলে, শ্রীচৈতন্যদেব স্বয়ং ভক্ত হরিদাসের দেহকে সমাধিস্থ করেন পুরীর সমুদ্রতীরে এবং নিজে বাজারে ভিক্ষা করে শ্রাদ্ধ দ্রব্যাদির আয়োজন করেন। হরিদাস ঠাকুর ছাড়াও অসংখ্য তুর্কি-পাঠানকেও শ্রীচৈতন্যদেব শ্রীকৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষিত করেন। যাদের মধ্যে বিজলী খাঁ অন্যতম। শ্রীচৈতন্যেদেবের ভালবাসার দ্বার ছিল সবার জন্য উন্মুক্ত-অবারিত। স্বামী বিবেকানন্দও তাঁর ধর্মান্তর প্রসঙ্গে আলোচনায় শ্রীরামানুজ শ্রীচৈতন্যদেবের পথকে সবাইকে অনুসরণ করতে বলেছেন। তিনি বৈদিক পথে নিয়ে আসার বিষয়টির দিকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। সাংবাদিক এবং স্বামীজীর ধর্মান্তর প্রসঙ্গে আলোচনার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল নিজের উপাস্য ইষ্ট নির্বাচনের স্বাধীনতা। এ ইষ্ট নির্বাচনের স্বাধীনতারূপ তত্ত্বটি এত উদার যে, সমগ্র জগতের সকল মতপথ নিজ নিজ সম্প্রদায়ের বিশ্বাসে অটুট থেকে আবহমান সনাতন বিশ্বাসে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................