আমাগো এক দ্যাস আসিলো বিপ্লবী বিপিন চন্দ্র পাল।

✍আমাগো এক দ্যাস আসিলো

ভারতবর্ষে হিন্দু জাতীয়তাবাদের পীঠস্থান বাঙ্গালার মাটি। এই কথা আমরা প্রায়ই বলি। বিগত চার দশক যুগপৎ বিপ্লব ও তথাকথিত
অসাম্প্রদায়িকতার ঘোর অমানিশায় অভ্যস্ত জনমানুষ এ কথা সহজে বিশ্বাস করতে চান না। যদি বলি, বাঙ্গালী হিন্দু আরব সাম্রাজ্যবাদের গতিপ্রকৃতির বর্তমান রূপরেখা সম্পর্কে বহু আগেই ভবিষ্যত বাণী করেছিল বাঙ্গালী হিন্দু, ভবিষ্যতে চাইনিজ ড্রাগনের হাতে বিপন্ন হবে ভারতবর্ষ বলেছিল বাঙ্গালী হিন্দুই, খুব অবাক হবেন কি? অথচ আমাদের দুর্ভাগ্য দেখুন, 'চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান' স্লোগান দেওয়া এবং ঐতিহ্য পরম্পরায় আরব সাম্রাজ্যবাদীদের দালালি করা দলগুলো দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকেছে এই বাঙ্গালী হিন্দুর হোমল্যান্ডেই!

২ রা মে, ১৯০৮ এ বিপিন চন্দ্র পাল এবং অরবিন্দ ঘোষ পরিচালিত চরমপন্থী পত্রিকা 'বন্দে মাতরম'-এ লিখিত হয়, "রাজনৈতিক স্বাধীনতার স্বার্থে ইউরোপিয়ান ভাবধারার স্বরাজ ভারতকে উপকৃত করবে না। আধুনিক অবস্থার অধীনে ভারতীয় সনাতন রীতির মেলবন্ধনে, জাতীয় মহত্বের সত্যযুগে, বৈদান্তিক আদর্শের শিক্ষায় জনগণের আত্মোন্নতির মাধ্যমেই ভারতের প্রকৃত স্বরাজ আসবে। ভারতের এই যৌথ সংস্কৃতির ভিত্তি হবে হিন্দু।"

পরবর্তী একশো বছরে বাঙ্গালী খোলনলচে পাল্টে ফেললো! তারা লিবারেল হলো।

লাল-বাল-পাল খ্যাত চরমপন্থী নেতা বিপিনচন্দ্র পাল ১৯১২ খ্রীষ্টাব্দে বিজয়া পত্রিকায় 'রাষ্ট্রনীতি' প্রবন্ধে লিখেছিলেন,

"ভারতীয় মু.সলমানরা প্রথমে মু.সলমান,পরে ভারতীয়। সৈয়দ আমির আলীর মত মু.সলমান নেতারা বলেন,'যদি ই.সলামিক দেশ থেকে আক্রমণকারীরা আসে,তবে ভারতের মু.সলমানদের দায়িত্ব হলাে ভারতের বিরুদ্ধে সেইসব আক্রমণকারীদের সাহায্য করা'। কারণ মু.সলিম আইডেন্টিটি তাদের কাছে অধিক জরুরী।"

এই কংগ্রে.সী নেতার আশংকা যে একেবারেই অমূলক নয় বা তিনি যে 'বিজে.পির এজেন্ট' নন(তখন জনসংঘ বা বি.জে.পি কোনটাই ছিল না। যদিও সেটা বড় কথা নয়।) তার প্রত্যক্ষ প্রমান পাওয়া গেলো ঠিক সাত আট বছর পর ১৯১৯-২০ সালের খেলাফত আন্দোলনে। ভারতের সাথে সম্পর্কশূন্য যে আন্দোলনকে ভারতের জাতীয় আন্দোলন অসহযোগের সাথে জুড়ে ভারতীয় মু.সলমানকে ই.সলামিক ব্রাদারহুডের বখতিয়ার ঘোড়ায় চাপানো হয়েছিলো। তুরস্কের খলিফাকে পুনরায় মসনদে আসীন করার এই খিলাফত আন্দোলন পরিচালিত হয় সর্বভারতীয় মু.সলিম লীগের উত্তর প্রদেশের নেতা মোহাম্মদ আলী ও শওকত আলীর নেতৃত্বে।

কোন রাখঢাক না রেখেই আলী ভাইজনদ্বয় তাদের বক্তৃতায় বলতেন, "ভারতের মু.সলিমদের স্বার্থ ভারতীয় হিন্দুদের সাথে এক নয়, বরং ত্রিপোলি, আলজেরিয়া বা যে বিশ্বের যে কোন মু.সলমানের স্বার্থের সাথে এক।" আফগানিস্তানের আমির ভারত আক্রমণ করতে পারে এমন একটা গুঞ্জন উঠলে, মোহাম্মদ আলী বলেন,' যদি আফগানরা ভারত দখলের পবিত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়, ভারতীয় মু.সলিমরা শুধু তাদের সহায়তাই করবে না। বরং, হিন্দুরা যদি বাধা দেয়, তবে হিন্দুদের সাথে যুদ্ধও করবে।"

ভারতীয় উপমহাদেশে গজবা এ হিন্দ হবে, ইমাম মাহদী আসবেন। যুদ্ধের অন্তিমে শুধু 'শির উঁচু করি মু.সলমান' থাকবে। বাকিদের জন্য বরাদ্দ জাহান্নামের আগুন। এগুলো কেবল অশিক্ষিত মৌলবাদীদের প্রলাপ নয়। বাস্তব-অবাস্তবের মিশেলে এক ভয়াবহ পরিকল্পনার আভাস। অন্যদিকে, চীনের সর্বগ্রাসী নীতির কথা কারো অজানা নয়। অন্দর-বাহিরে দুই সাপ উদ্যত ফণা তুলে দাঁড়িয়ে।

বিপদ কী, কিই বা মুক্তির উপায়, লিখছেন বঙ্গসন্তান বিপিন চন্দ্র পাল,১৯২৩ সালে প্রকাশিত Nationality and Empire" বইতে,

"প্যান ইউরোপিয়ান শক্তি( যা বর্তমানে পশ্চিমা বিশ্ব নামে পরিচিত) নন-ইউরোপিয়ান বিশ্বের সামনে বড়ো বিপদ হতে চলেছে। ভবিষ্যতে প্যান ই.সলামিক( বৈশ্বিক ই.সলাম) এবং প্যান মঙ্গোলিয়ান ( চৈনিক সাম্রাজ্যবাদ) শক্তির সাথে পশ্চিমা বিশ্বের মারাত্মক সংঘর্ষ হবে। ইউরোপ যত দ্রুত সম্ভব অভ্যন্তরীণ তিক্ততা মিটিয়ে ফেলতে পারলে, খুব সহজেই প্যান ই.সলামিক এবং প্যান মঙ্গোলিয়ান বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। সেই ক্ষেত্রে, কোন কিছুই একদিকে মু.সলিম ভুমিগুলোর অন্যদিকে, চীনের টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া আটকাতে পারবে না। কিন্তু, সেই সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। ইউরোপিয়ান দেশগুলোর মধ্যেকার ঈর্ষা এবং তজ্জনিত শত্রুতা ভুলতে অনেক সময় লাগবে। যা চীনের কাছে সুবর্ন সুযোগ। শতাব্দী প্রাচীন নিদ্রা থেকে সে (চীন) জেগেছে তার নিজের ঘরকে সুরক্ষিত করার জন্য এবং সমগ্র বিশ্বের বিরুদ্ধে সে তার বিপুল শক্তিকে সংঘবদ্ধ করবে।

"একই জিনিস ই.সলামিক বিশ্বেও ঘটবে। এবং ইউরোপে তুর্কির পতন এই সমন্বয়কে ত্বরান্বিত করবে। এটা চীন বা জাপানের মত সুসংহত ভুখন্ড না হলেও, তাদের থেকে অনেক গুণ বেশি মারাত্মক। কারণ, অগণিত মানুষের গূঢ় সংযোগ, যাদের কাছে প্রাণ বা জমি, কোন কিছুর মূল্যই ধর্মের থেকে বেশী নয়। এবং বৈশ্বিক ই.সলামের ক্ষমতার প্রকৃত বিস্ফোরণ ঘটবে মিশর ও ভারতে( তৎকালীন অবিভক্ত ভারত), যেখানে ই.সলামিক শক্তি প্যান ইউরোপিয়ান চাপ থেকে মুক্ত। ইংল্যান্ড কখনোই নিজস্ব ঔপনিবেশিক বিষয়ে তার ইউরোপিয়ান জোটসঙ্গীদের হস্তক্ষেপ করতে দেবে না। তাহলে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ভেঙে যাবে। এই প্যান ই.সলামিক সমস্যা যতক্ষণ ইংল্যান্ডের সাম্রাজ্যকে প্রভাবিত করছে, ততক্ষন এই সমস্যার মোকাবিলা ইংল্যান্ডকে একাই করতে হবে।"

ভারতের মূল বিপদ কোন জায়গায় নিহিত, তা বিশ্লেষণ করতে এই বইতে 'Our Real Danger' শিরোনামে তিনি লিখছেন,

"প্যান ইউরোপিয়ান শক্তি থেকে আমাদের সুরক্ষা এখানেই নিহিত রয়েছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে থাকার কারণে প্যান ইউরোপিয়ান শক্তিগুলোর সম্মিলিত ক্ষমতা ভারতের জন্য ভয়ের নয়। কিঞ্চিৎ কম হলেও এটা মিশরের জন্যও সত্য(১৮৮২ সালে ব্রিটিশরা মিশর জয় করলেও মিশরকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করতে পারে নি। নামমাত্র স্বাধীন মিশর সরকার দেশ চালাতো)। আমাদের মূল বিপদ ইউরোপ থেকে আসবে না, আসবে এশিয়া থেকে। প্যান ইউরোপিয়ানিজম নয়, আমাদের সামনে বড়ো বিপদ প্যান ই.সলামিজম এবং প্যান মঙ্গোলিয়ানিজম। ভারত, মিশর এবং গ্রেট ব্রিটেনের জন্য এই বিপদ একই। একে প্রতিহত করতে ইংল্যান্ডকে অবশ্যই ভারত ও মিশরের সমস্যগুলোর স্থায়ী ও সন্তোষজনক সমাধান খুঁজতে হবে। আমাদের তরফ থেকেও যুক্তিযুক্ত রফাসূত্র খোঁজা প্রয়োজন। ভারত এবং মিশরের জাতীয়তাবাদীদের ন্যায্য দাবীগুলি যত শীঘ্র সম্ভব ব্রিটিশ সরকারের মেনে নেওয়া দরকার। ব্রিটিশদের সামনে জাতীয় জীবন এবং স্বাধীনতার দাবিকে মৈত্রীর প্রধান শর্ত হিসেবে রেখে ভারতীয় ও মিশরীয়দের উচিত ব্রিটিশদের সাথে সংযোগকে খোলামনে বিবেচনা করা। বশ্যতা নয়, সংযোগ।"

বইটিতে আলোচিত হয়েছে বৈশ্বিক ই.সলামের সাথে একাত্ম হতে চাওয়া ভারতীয় মু.সলিমরা জাতীয় জীবনে কতবড় বিপদ, সে প্রসঙ্গও 'Our True Safety' শিরোনামায়,

" চিরকাল ব্রিটিশরা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা বা তাকে পদদলিত করতে সক্ষম হবে, এমন সম্ভাবনা আমি দেখছি না। অন্যদিকে, ব্রিটিশদের সাথে কৌশলগত সমন্বয়; প্যান ই.সলামিজম এবং প্যান মঙ্গোলিয়ানিজম উভয় বিপদের মোকাবিলায় আমাদের সহায়ক হতে পারে। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ভবিষ্যৎ চিন্তায় যতদিন আমরা শুধুমাত্র ইংল্যান্ড বা অন্য কোন ইউরোপীয় শক্তিকে বিপদ ভেবেছি, সমস্যা তুলনামূলক সহজ সরল ছিল। কিন্তু, বর্তমানে একদিকে চীন, অন্যদিকে প্যান ই.সলামিক জোটের বিপদ আছে। ভারতের ৬ কোটি মু.সলমানের দেশের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে যা প্রাধান্য ও ক্ষমতা আছে, তা নিয়ে যদি বৈশ্বিক ই.সলামের সাথে তারা একাত্ম হয়ে যায়, তবে যে কোন মুহূর্তে আমাদের সমস্ত জাতীয়তাবাদী আকাঙ্খার পরিসমাপ্তি ঘটবে। বর্তমান ব্রিটিশ প্রভুত্বের ইতি হওয়ার পরেও।"

"৪০ কোটি জনগণের চীন সাম্রাজ্যের পক্ষে ভারতে প্রবেশ করা শুধু সহজই হবে না। বরং, একবার তারা ভারতে ঢুকে পড়লে আমাদের পরাজয় বরণও করাতে পারে। পৃথিবীতে তারাই (মঙ্গোলিয়ান) একমাত্র জনগোষ্ঠী, যারা শারীরিক সক্ষমতায় আমাদের থেকে এগিয়ে আছে। প্রশিক্ষিত আর্মি, নৌ বাহিনীর অনুপস্থিতিতে ভারত ভূখণ্ডের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা রক্ষায় পথে চীন বড় বাধা। যদি আমরা স্বাধীনতা পেয়েও যাই, প্যান ই.সলামিক ও প্যান মঙ্গোলিয়ান চ্যালেঞ্জের সামনে তা রক্ষা করা দুষ্কর হবে। এবং যদি কেউ পরিবর্তিত বিশ্বের এই বিষম পরিস্থিতির দিকে দৃষ্টিপাত করেন, তবে তিনি স্বীকার করতে বাধ্য হবেন, ভারতীয় জাতীয়তাবাদের স্বার্থেই ইউরোপীয় সংযোগ প্রয়োজন। এই সংযোগ ব্যতীত ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও স্থিতি অনিশ্চিত।"

------------

সমীকরণ যদিও খুবই সহজ, তবুও বর্তমানে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও আরব সাম্রাজ্যবাদ কেন এক নয়, সেটা সংক্ষেপে বলে রাখা ভালো। বিজিত বিজয়ীকে চিরতরে ঘৃণা করতে তখনই শেখে, যখন বিজয়ী বলে,'আমার এখনো তোমার থেকে অনেক কিছু জয় করার বাকি।' ইংরেজ ১৫০ বছর আগে ভারতীয়দের চাবুক মেরে জমিতে নীল চাষ করতে বাধ্য করতো। কালক্রমে আমরা স্বাধীন হয়েছি, তারা ভদ্র সভ্য গণতান্ত্রিক হয়েছে। কিন্তু, এক বিশেষ শ্রেণীর অত্যাচারে এই সেদিনও কোন হিন্দু বাঙ্গালী পূর্ব পাকিস্তানের জমি বাড়ি ছেড়ে এক কাপড়ে চলে এসেছেন। এই শ্রেণী গণতান্ত্রিক দূরে থাক, ন্যূনতম সভ্য ভদ্র টুকুও হয় নি। ইংল্যান্ড এখন কলোনি স্থাপন করে না। চীনারা এখনও তিব্বত, লাদাখ, অরুণাচলে নজর দিতে ছাড়ে না। পাগলা কুকুরকে ড্যাঙশ পেটা করতে কখনো সখনো অতীতে বিবাদমান দু পক্ষের স্ট্র্যাটেজিক এলায়েন্স প্রয়োজন। ঠিক যেমন, বৃহত্তর বিপদকে প্রতিহত করতে এক কালের ফরাসি উপনিবেশ চন্দননগরের বাসিন্দাও আরব বর্বরদের বয়কট করে অনায়াসে 'I stand with france' কভার পিকচারে দিতে পারেন।

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted