কেবলমাত্র মননশীলদের উদ্দেশ্যে।

কেবলমাত্র মননশীলদের উদ্দেশ্যে

বহু বছর আগে একজন বয়স্কা নারীর সঙ্গে আমার দীর্ঘ আলোচনা হয়েছিল, যার জন্ম হিন্দু পরিবারে। তিনি স্কুল জীবনে এক মুসলিম যুবকে বিয়ে করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। আলোচনার প্রারম্ভেই আমি লক্ষ‍্য করি, প্রবীণা অত্যন্ত জ্ঞানী এবং চিন্তাশীল। তিনি জানান, তার নিঃসঙ্গ জীবনের একমাত্র অবলম্বন বই।

ভদ্রমহিলা যে ব‍্যক্তির হাত ধরে কুল-ধর্ম ত্যাগ করেছিলেন এবং তার যাবতীয় জাগতিক আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রস্থলে ছিল যে ব‍্যক্তি - সেই ব‍্যক্তি ছ'টি সন্তান জন্মদানের পর স্ত্রীর যৌবনে সামান্য ভাটা লাগতেই, তাকে ত‍্যাগ করে - পুনরায় নিকাহ করতে একটুও দ্বিধা করেনি।

 ভদ্রমহিলার বক্তব্যের কিছু অংশ নিচে তুলে ধরছি ―

"... অনেক বছর হয়ে গেছে স্বামী আমার সঙ্গে কোন যোগাযোগ রাখে না। বিয়ের পর থেকে পিতৃকুলের কারো সঙ্গে সম্পর্ক থাকা তো দূরের কথা, ঘটনাচক্রে বছর ত্রিশেক আগে একবার জন্মদাতা পিতা-মাতার  মুখোমুখি হয়েছিলাম, তারা আমার সঙ্গে কথা তো বলেই নি, মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়েছিল- আমার দিকে কেউ দ্বিতীয়বার ফিরেও তাকায়নি; যেন আমার মুখদর্শন করাও পাপ।... ছেলে মেয়েদের সঙ্গে আমি ইচ্ছে করেই যোগাযোগ কম রাখি। আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি, রোজা রাখি, প্রতিদিন কোরআন তেলাওয়াত করি; তা সত্বেও মেয়ের জামাই ও ছেলের বউদের আশঙ্কা, আমার সঙ্গে মিশলে তাদের সন্তানরা হিন্দুয়ানী কালচার শিখবে।...

"...আমাদের দেশে হিন্দু ও মুসলমান ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রচুর বিয়ে হচ্ছে। কোন মুসলিম ছেলে বা মেয়েকে, হিন্দু সমাজ কী তাদের ধর্মে একান্ত আপন করে নিতে পেরেছে? বিয়ের পর আমার স্বামীকে সনাতন ধর্ম গ্রহণ করতে বলার বিন্দুমাত্র উৎসাহ বোধ করিনি। কেননা আমি জানতাম, হিন্দু সমাজ তো বটেই, এমনকি আমার পরিবার পর্যন্ত তাকে গ্রহণ করবে না। তাছাড়া সে যদি সনাতন ধর্ম গ্রহণ করত, তাহলে হিন্দু সমাজে কোন বর্ণে সে অন্তর্ভুক্ত হতো?...আমার কথাই ধরো,আমি স্বামী কর্তৃক পরিত্যক্তা, সন্তানদের পরিবারে অপাংক্তেয়। কিন্তু যেহেতু আমি ভিন্ন ধর্ম থেকে মুসলমান সমাজে এসেছি, এজন্য ... (একটি ইসলামী সংস্থা) আমার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। আমি কারো মুখাপেক্ষী নই। আমি এখন যদি হিন্দু সমাজে ফিরে যেতে চাই, হিন্দু সমাজে কী আমার জায়গা হবে? অথচ আমার বয়সী কোন মহিলা যদি অন্য ধর্ম থেকে মুসলমান সমাজে আসে, তাকে বিয়ে করার জন্য অনেক লোক এসে হাজির হবে।...

"... মুসলমানরা যদি হিন্দুর থেকে অধিকতর যোগ্যই না হবে, তাহলে ভারতে মুসলমানরা সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের কীভাবে হাজার বছর শাসন করতে পারলো!  হিন্দুদের কাছ থেকে এতগুলো দেশ কী, মুসলমানরা এমনি এমনি ছিনিয়ে নিতে পেরেছে? আমি মনে করি, খ্রিস্টানরা মুসলমানদের থেকেও অনেক বেশি যোগ্য। পৃথিবীতে একমাত্র খ্রিস্টানরাই মুসলমানদের শাসন করতে পেরেছে; মুসলমানদের কাছ থেকে রাষ্ট্র ছিনিয়ে নিতে পেরেছে।...ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করলে কঠিন শাস্তির বিধান। খ্রিস্টানরা ভয় দেখিয়ে কাউকে সমাজে ধরে রাখার চেষ্টা করেনা, সেবা দিয়ে মানুষের মন জয় করে..."

"...আমরা দিন-রাত খ্রিস্টানদের গালিগালাজ করি, অথচ তুমি-আমি সবাই খ্রিস্টান দেশে যাওয়ার জন্য পাগল। কেন আমরা বিজাতি খ্রিস্টানদের রাষ্ট্রে  যাওয়ার জন্য উতলা? আমরা সবাই খ্রিস্টানদের দেশে যেতে চাই- এই কারণে যে, তারা কতগুলো অত্যন্ত উন্নত রাষ্ট্র বানাতে পেরেছে, আমরা যা পারিনি। হারাম-শুয়োর খাওয়া, মদখোর, জেনাকারী খ্রিস্টান দেশে না গিয়ে, আমরা নিজেদের দেশটাকে কেন ইউরোপ-আমেরিকা বানানোর চেষ্টা করি না!...

 "...ইসলাম ধর্মকে জেনেবুঝে বা ইসলাম ধর্মকে ভালোবেসে আমি মুসলমান হইনি।  আমি ধর্মান্তরিত বৈবাহিক সূত্রে। ইসলাম ধর্মালম্বী একজন যুবকের সঙ্গে প্রেম করে- পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করার সময় ভালো করেই জানতাম যে, পিতৃপরিবারে আমার আর কোনদিন জায়গা হবে না। আমার বয়স তখন কম ছিল, তাছাড়া একজনের উপর অন্ধ মোহগ্রস্ত ছিলাম- যেকারণে আমার পক্ষে অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করা সম্ভব ছিল না যে, স্বামী যদি আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়, তখন আমার কী অবস্থা হবে। আমি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর, মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে, অধিক সন্তান জন্মদানের মনোযোগী হয়েছি; নিজের স্বাস্থ্য ও দাম্পত্য জীবন উপভোগের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিনি এবং প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষা গ্রহণের প্রতিও ছিলাম সম্পূর্ণ উদাসীন। আমার সৌভাগ্য, মানুষের বাড়িতে দাসী-বান্দীর কাজ করে এখন পেট চালাতে হচ্ছে না। আল্লাহর হুকুমে, মুসলমান ভাইয়েরা আমার সম্মানজনক রুটিরুজির ব্যবস্থা করে দিয়েছে।...
 
"... ধর্মান্তরিত হওয়ার সময় সনাতন ধর্ম সম্পর্কে তেমন কিছু জানতাম না। এখন অনেক কিছুই জানি এবং এখন যা জানি, তা যদি তখন জানতাম- তবুও সেই ধর্মজ্ঞান, ধর্মান্তরের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতো না।
জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই হিন্দু সমাজের প্রতি আমার প্রচণ্ড ঘৃণা ছিল। তুমি হয়তো ভাবছো, আমি যেহেতু ধর্মান্তরিত হয়েছি - এইজন্য ফেলে আসা সমাজের কুৎসা করছি। মোটেও তা নয়। জ্ঞান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে বিষয়টি আমাকে পীড়িত করেছে, অপমান বোধ জাগ্রত করেছে- তা হচ্ছে, যাদের স্বজাতি হিসেবে জানি, তাদের একটি অংশ আমাদের ছোঁয়া খায় না, আমাদের ঘরে উঠতে দেয় না। যেটা মুসলিম সমাজে নেই...

 "... অনেক হিন্দু আমাকে বলেছে, আমার বাবা-মা যদি আমাকে ছোটবেলা সঠিক ধর্ম শিক্ষা দিত, তাহলে আমি নাকি ধর্মান্তরিত হতাম না। এই  অভিযোগের প্রেক্ষিতে আমি লাইব্রেরী থেকে সনাতন ধর্মের অনেক বই এনে পড়েছি।...আল্লাহ তোমাকে হাতরথ-মাথায় বুদ্ধি কেন দিয়েছেন; দিয়েছেন এজন্য যে, তুমি কামাই-বাণিজ্য করবে, বিয়ে করবে, বাচ্চাকাচ্চা জন্ম দেবে, তাই তো। এটাই সৃষ্টির নিয়ম এবং এভাবেই মানবজাতি টিকে আছে। এখন তুমি যদি বল, 'আমার জীবনের একটাই উদ্দেশ্য ঈশ্বর-প্রাপ্তি; আমি কামনা-বাসনা ত্যাগ করলাম, বিয়ে-শাদী করবো না' ― আরে বাপু, তোমরা সবাই যদি কামনা বাসনা ছেড়ে দিয়ে আয়-রোজগার না করো, সন্তান জন্ম না দাও, মানবজাতি টিকে থাকবে কীভাবে!..."

কৃত্তিবাস ওঝা
২৩/১১/২০২০খ্রিঃ

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted