বিনায়ক দামোদর সাভারকার। বহুচর্চিত, বহুল নিন্দিত এই মানুষটির সম্পর্কে আজ কিছু কথা। নাহ, কোনো হিন্দুত্ববাদী বলবেন না। বলবেন বঙ্গীয় সেকুলারিজমের অন্যতম কান্ডারি। দেখা যাক, 'দু টাকার আইটিসেল' তকমা এই লিবারেল সাহিত্যিকের কপালে জোটে কিনা!
---------
“...এই শতাব্দীর গোড়ার দিকে যে-কটি বিপ্লবী কার্যকলাপ হয়েছে, তার অনেকগুলির পেছনেই রয়েছে বীর বিনায়ক সাভারকরের সক্রিয় উৎসাহ। বাংলার বিপ্লবীরা যখন বােমা তৈরীর মালমশলা শেখার জন্য একজন প্রতিনিধিকে লন্ডনে পাঠায়,তখন সাভারকর তাকে সাহায্য করেছিলেন। (মদনলাল) ধিংড়া সাভারকরের হাতে গড়া ছেলে। আবার মহারাষ্ট্রের "অভিনব ভারত" দলের যুবকদের কাছেও তিনি গােপনে পাঠিয়েছিলেন কুড়িটি রিভলবার। এই জ্বলন্ত পুরুষটি চেয়েছিলেন তখনকার রুশ বিপ্লবীদের মতন সারা ভারতে গুপ্ত সমিতি স্থাপন করে নিজেদের প্রস্তুত হয়ে নিতে হবে। তারপর এক সময় হবে অভ্যুত্থান। কিন্তু তার আগেই সাভারকর ধরা পড়ে গেলেন।
সাভারকর শুধু অস্ত্র সংগ্রহ করতেন না, রণকৌশলও তিনি ঠিক করতেন। এ বিষয়ে তার ছিল তীক্ষ্ণ বুদ্ধি। এবং এই জন্যই সাভারকরের পক্ষে প্রয়ােজন ছিল একটু আড়ালে থাকার। কিন্তু ভারতের কোনো একজন তরুণ বিপ্লবী নিজের ফাঁসীর হুকুম শােনার পর একটু ক্ষোভের সঙ্গে বন্ধুদের কাছে বলেছিল, সাভারকর আমাদের মরণের দিকে ঠেলে দিয়ে নিজের প্রাণ বাঁচিয়ে আড়ালে লুকিয়ে থাকেন।
এই কথা ঘুরতে ঘুরতে একদিন সাভারকরের কানে গেল। তার মতন তেজী পুরুষের পক্ষে একথা সহ্য করা সম্ভব নয়। হঠকারীর মতন তিনি তখুনি নিজের অজ্ঞাতবাস থেকে চলে এলেন লণ্ডনে। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ধরা পড়ে গেলেন ভিক্টোরিয়া স্টেশনে।
সাভারকরের নামে ভারতে তখন দু' দুটো কেস ঝুলছে। বিচারের জন্য তাকে নিয়ে আসতে হবে ভারতে। কঠোর পাহারায় তাকে তোলা হলো মুরিয়া জাহাজে। সাভারকর সাংঘাতিক আসামী। রক্ষীরা এক মুহূর্তের জন্যেও তাকে চোখের আড়াল করে না। এমন কি তার বাথরুমের দরজার মাঝখানেও কাঁচে বসানো আছে। তিনি বাথরুমে গেলেও রক্ষীর। কাঁচে চোখ লাগিয়ে নজর রাখে। কিন্তু এত করেও তাকে আটকে রাখা গেল না। সাভারকর বাথরুমের দরজা বন্ধ করেই সেই কাচের ওপর তােয়ালে চাপা দিয়ে দিলেন। তারপর পাের্ট হােলের মধ্য দিয়ে লাফিয়ে পড়লেন সমুদ্রে।
জাহাজ তখন মার্সেই বন্দরের কাছে এসে ভিড়েছে। সভারকর প্রাণপণে সাঁতরে তীরের দিকে যেতে লাগলেন,ততক্ষণে রক্ষীরা টের পেয়ে গুলি চালাতে শুরু করেছে। তবু সাভারকর ঠিক পৌছে গেলেন ।
আগে থেকেই খবর পাঠানো ছিল, সাভারকর এইখানে জাহাজ থেকে পালাবেন। বীরেন চট্টোপাধ্যায় এবং মাদাম কামা আগে থেকেই গাড়ি নিয়ে উপস্থিত থাকবেন সেখানে। কিন্তু শেষরক্ষা হলো না। আসবার পথে গাড়ি খারাপ হয়ে যাওয়ায় বীরেন চট্টোপাধ্যায় আর মাদাম কামা ঠিক সময়ে পৌঁছাতে পারেননি। সাভারকর একজন ফরাসী পুলিসকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আমাকে থানায় নিয়ে চলা। ফরাসী দেশের মাটিতে ইংরেজ আমাকে গ্রেপ্তার করতে পারে না।
ফরাসী পুলিস কিছুই বুঝতে পারলো না। সারা গা ভিজে, একজন বিদেশী মানুষ হাত পা ছুড়ে কি বলছে কি ? সাভারকর ফরাসী ভাষা ভালো জানতেন না। ততক্ষণে ইংরেজ রক্ষীরা এসে পৌঁছে গেছে। তারা ফরাসী পুলিসকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে সাভারকরকে আবার জাহাজে তুললেন। আন্তর্জাতিক কানুন অনুসারে এই কাজটা বে-আইনি। আন্তর্জাতিক আদালতে এই নিয়ে মামলাও উঠেছিল। কিন্তু এশিয়ার কলোনীর ব্যাপারে তখন ইংরেজ আর ফরাসী সরকারের খুব ভাব। একজন ভারতীয় বন্দীকে ইংরেজের হাতে তুলে দিতে ফরাসী সরকার আপত্তি করলেন না। সাভারকরকে এনে ভরা হলো ভারতের জেলে। নাসিক ষড়যন্ত্র মামলায় আলাদা আলাদা ভাবে সাভারকরকে দুবার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হলো।
দণ্ডাদেশ শুনে সাভারকর কারারক্ষীকে বললেন, আমার তো জীবন একটাই। দু’বার যাবজ্জীবন দণ্ড ভােগ করবাে কি করে ? কারারক্ষী বললো, তুমি এমন সাংঘাতিক অপরাধী যে শুধু এ জন্মে নয়, পরের জন্মে ঐ তােমাকে জেলে পুরে রাখা হবে। সাভারকর হাসতে হাসতে মন্তব্য করলেন, যা আমার জন্য তা হলে খৃষ্টান ইংরেজদেরও পরজন্মে বিশ্বাস করতে হলো।
বেঁচে থাকলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মেয়াদ হয় পঁচিশ বছর। সেই হিসেব করে সাভারকর পরমুহূর্তেই ব্যঙ্গের সুরে কারারক্ষীকে বললেন, তােমার কি ধারণা, পঞ্চাশ বছর পরেও ইংরেজ এ দেশে টিকে থাকবে? দেখা যাক!
সাভারকর জেলে গিয়েছিলেন ১৯১১ সালে। আমরা জানি, তার পরে আর পঞ্চাশ বছর ইংরেজ এদেশে থাকতে পারেনি।
আন্দামান জেলে কী অসহ্য অত্যাচার ও নিপীড়ন সহ্য করতে হয়েছে তাকে, তার বিবরণ আছে সাভারকরের আত্মজীবনীতে। তার দাদা গণেশও তখন আন্দামানে। ওঁদের আর এক ভাইও কারারুদ্ধ। আন্দামান জেলে অধিকাংশ ওয়ার্ডার এবং রক্ষীই ছিল উত্তর ভারতের অশিক্ষিত মুsলমান। এদের নৃশংস উৎপীড়নে অনেক রাজনৈতিক বন্দী আত্মহত্যা করেছে, অনেকে পাগল হয়ে গেছে। অনেকটা এদের জন্যই, দুঃখের বিষয়, সাভারকরের মতন সংস্কারমুক্ত তেজস্বী মানুষের মধ্যেও পরবর্তী জীবনে ধর্মীয় গোঁড়ামি এসে গিয়েছিল।
জেলখানায় বসে তিলক, শ্ৰীঅরবিন্দ, গান্ধীজী, জহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র, সরােজিনী নাইডু প্রভৃতি অনেকেই উৎকৃষ্ট সাহিত্য সৃষ্টি করে গেছেন। কিন্তু সাভারকর যদিও কবি ছিলেন, তবু তাকে এক টুকরাে কাগজও দেওয়া হয়নি। তাতেও নিরস্ত হননি তিনি। তার ছােট্ট কুঠরির দেয়ালেই তিনি কাঠকয়লা দিয়ে লিখতে শুরু করলেন একটি গাথা কাব্য। কারারক্ষীরা কিছুদিন অন্তর অন্তর ঘরে ঢুকে দেখতে পেলেই সেই লেখা মুছে দিয়ে যেত। তার আগেই সাভারকর সেই অংশটুকু মুখস্থ করে ফেলতেন। ঘরের দেওয়াল যেন তার কাছে শ্লেটের মতন। এই ভাবে তিনি সমাপ্ত করেছিলেন 'কমলা' মহাকাব্য —যা মারাঠি ভাষায় একটি উল্লেখযােগ্য সৃষ্টি।
১৮৫৭ সালের হিন্দু-মু.সলমানের মিলিত প্রয়াসে সিপাহী অভ্যুত্থানের যে সার্থক ইতিহাস সাভারকর লিখেছিলেন, তা বহুদিন ধরে ভারতীয় মুক্তিকামীদের প্রেরণা জুগিয়েছে। গদর পার্টির লালা হরদয়াল, ভগৎ সিং এবং নেতাজী সুভাষ সেই বইয়ের বিভিন্ন সংস্করণ বার করে প্রচার করেছিলেন।
..........জিন্না তখন ভারত বিভাগ এবং পাকিস্তানের দাবিতে অনড়। কংগ্রেসের মধ্যে এক রাজাগােপালাচারি ছাড়া আর কেউ ভারত বিভাগের কথা স্বপ্নেও স্থান দিতে চায় না। ভারতের কমুনিস্ট পার্টি তখন বিভিন্ন অঞ্চলের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের প্রশ্নে ভারত বিভাগ ব্যাপারে নৈতিক সমর্থন জানিয়েছে। পরস্পর বিরােধী দাবি এবং ব্রিটিশ সরকারের কৌশলে ক্রিপস মিশন ব্যর্থ হয়ে গেল।...”
**********
-অগ্নিপুত্র, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
উক্ত লেখকের আরব এপলোজি ব্রায়ান লারার কভার ড্রাইভের মত নিখুঁত হলেও, লেখনীর ধার ঘেঁষে বেরিয়ে এসেছে সেই অমোঘ সত্য। আমরা কেউ নিছক কবি হতে চেয়েছিলাম, কেউ শুধু খেলোয়াড়, কেউ বা অমলকান্তির মত রোদ্দুর হতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তোমরা আমাদের সাম্প্রদায়িক হতে বাধ্য করলে। সাভারকারের মত মুক্তমনা উদারবাদী পুরুষও জেলে আরব সাম্রাজ্যবাদী অবমানবদের সংস্পর্শে থেকে প্রতিক্রিয়াশীল হিন্দুত্ববাদের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন, জানাচ্ছেন ব|মমনস্ক সাংস্কৃতিক জগতের ব্লু আইড বয় সুনীল। সেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যার বদান্যতায়,পূর্ববঙ্গের হিন্দু উদ্বাস্তুদের দেশত্যাগের ঘটনাকে একটি মায়াময় ধর্মনিরপেক্ষ ন্যারেটিভ হিসেবে উপস্থাপন করার কালচারটি দশকের পর দশক ধরে প্রবহমান ছিলো। দৈবকুৎসাকারী সাহিত্যিক অচিরেই লিখে ফেলেছেন হিন্দুফোবিক কমিউ_নিস্টদের কুকীর্তির কথাও। যে বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণে বাদ যাচ্ছে না, “কোন দলই যখন দেশভাগে রাজি নয়, তখন বিচ্ছিন্নতাবাদী মু.সলিম লীগের দাবির সমর্থনে ছিলো তাদের বিশ্বস্ত বন্ধু কমিউ_নিস্টরা” মর্মে সত্যদর্শন।
'সুনীল পার্টির কেউ নয়' এই যুক্তি আসার কথা নয়। তবুও যদি আসে, জেনে রাখা ভালো । রাজ্যে মার্ক্স_বাদী কমিউ_নিস্ট পার্টির নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরে প্রগতিশীল সাহিত্যিক সুনীল মিশে গিয়েছিলেন সেই নন্দনীয় স্রোতে, ২০০৭ সালে নন্দীগ্রামে গুলি চালানোর ঘটনার পরে কমিউ_নিস্ট মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধ_দেব ভট্টাচার্যর পক্ষে লেখা তাঁর সেই যুক্তি "তিনি নিশ্চয়ই নিভৃতে বিষণ্ন হয়ে আছেন" জনগণ বিস্মৃত হয় নি।
ওপার বাংলার রয়্যালটির টাকা হয়ত তার অন্ত:করণের সবটুকু অধিকার করতে পারে নি। 'উগ্রতার একটাই প্রত্যুত্তর, ততোধিক উগ্রতা', লেখকের ধমনীতে বয়ে চলা উদ্বাস্তু বাঙালের রক্তই যেন সাভারকার স্তুতির আড়ালে তাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিল একুশ শতকে আরব সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জনযুদ্ধের মূল শ্লোগানটি।
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................