লাহোরের আজকের মুসলমানদের অধিকাংশই হিন্দু এবং শিখ থেকে ধর্মান্তরিত মুসলমান।

আজ "লাহোর" বললেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে পাকিস্তানের সুন্দর, সাজানো-গোছানো, আপাদমস্তক ইসলামিক, এক আধুনিক শহর। আমাদের অনেকেরই বিশ্বাসই হবে না, ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এই শহরের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন হিন্দু অথবা শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ। কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ছিল তারাই, মুসলমানরা নয়। ১৯২৯ সালে কংগ্রেস নেতারা এই শহর থেকেই পূর্ণ স্বরাজের শপথ নিয়েছিলেন। এই শহরকে কেন্দ্র করে মহারাজা রঞ্জিত সিং শিখ সাম্রাজ্য  গড়ে তুলে ছিলেন। সুলতানী ও মোঘল আমলেও এটি গুরুত্বপূর্ণ হিন্দু শহর ছিল। লাহোরের আজকের মুসলমানদের অধিকাংশই হিন্দু এবং শিখ থেকে ধর্মান্তরিত মুসলমান। নিজের অজান্তেই তারা তাদের হিন্দু পূর্বপুরুষদের চেহারা, দৈহিক গড়ন, চুলের গড়ন, চোখের রঙ, দেহের রঙ এবং নামের শেষে টাইটেল বহন করে চলেছে। যেমন, শাহ, মালেক, রাঠোর, ভুট্টো, খান ইত্যাদি। খান অবশ্য মঙ্গলীয় টাইটেল, মুসলমানদের টাইটেল নয়। খান মানে শাসক। মঙ্গলীয় আক্রমণের পরে ভারতে হিন্দু এবং মুসলমানদের মধ্যে খান টাইটেলের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। ভারতে হিন্দুদের মধ্যে এখনো খান টাইটেল আছে। আর শাহ তো আছেই। শাহ মানেও শাসক। ভুট্টো মানে ভট্ট অর্থাৎ ভট্টাচার্য মানে ব্রাক্ষ্মণ। তবে এই ব্রাক্ষ্মণ মানে পুরুত ঠাকুর নয়। এরা ছিল প্রবল প্রতিপত্তি ওয়ালা ভূস্বামী। জমিদার। যেমন বেনজির ভুট্টো। 

লাহোর শহরটি দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্য এশিয়াকে সংযুক্তকারী একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথের উপর অবস্থিত। ফলে দীর্ঘ ইতিহাস জুড়ে বহু রাজ্য ও রাজবংশের রাজধানী হিসেবে শহরটি ব্যবহৃত হয়েছে। হিন্দু পুরাণমতে, রামের সন্তান লব বা লও বা লোহ এই শহরের পত্তন করেন। ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে চীনা পুরোহিত চুয়ান জাং ভারতে তীর্থযাত্রায় যাওয়ার পথে লাহোর দিয়ে যান এবং তিনি এখানকার বিবরণ দিয়ে গেছেন। ১১শ শতকে মুসলিম গজনভিরা স্থানীয় হিন্দুদের পরাজিত করে তাদের হাত থেকে শহরটির নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নেয় বলে জানা যায়। পরবর্তী আফগান ও মুঘল শাসকদের নথি থেকে বিবরণ জানা যায় (তথ্যসূত্রঃ about Lahore: the heart of Pakistan) প্রাচীন ইতিহাস অনুসারে এই শহরের নাম ছিল লোওহর। অর্থাৎ রামের দুই পুত্রের নামে। বাংলায় লব আর কুশ হলেও হিন্দি ও সংস্কৃতে লব (লও) আর হর। সেই জন্যেই গোনার সময় এক এর ভগ্নাংশ লব আর হর। কলকাতা শহর ভারতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় লাহোর শহরটি স্বভাবতই পাকিস্তানে পরে। 

স্বাধীনতার সময় লাহোরের ভারতে আসার যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল। ওখানকার জমি জমার বেশীরভাগ অংশ হিন্দু ও পাঞ্জাবীদের নামে ছিল। কিন্ত Radcliff লাহোরকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করে কারণ কলকাতাকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল এবং পাকিস্তানে নাকি বড় শহর ছিল না। তারপর আর কি, হিন্দু এবং শিখদের সবাইকে নিজের জায়গা ছেড়ে Refugee হয়ে ভারতে আসতে হয় এবং সেই সাথে ভারত থেকে বিপুল সংখ্যক মুসলমান লাহোরে পাড়ি জমান। এইভাবে এই এলাকার ডেমোগ্রাফি বা জনবিন্যাস পরিবর্তিত হয়ে যায়।

আরেকটা দেশ যেমন আফগানিস্তানের পুরনো নাম গান্ধার, এখনো সেখানে কান্দাহার নামে একটা জায়গা আছে যেটা গান্ধার থেকে এসেছে। গান্ধারের রাজকুমারী গান্ধারী মহাভারতের অন্যতম চরিত্র। গান্ধারীর ভাই রাজকুমার শকুনি পাকতুন উপজাতিদের নিয়ে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। গান্ধারের পরে আফগানিস্তানের নাম হয়েছিল "উপ গানা স্থান"। কথিত আছে এখনে বেদের কয়েকটি শাখা রচিত হয়েছিল। উপ গানা স্থান থেকে পরবর্তী কালে এই স্থানের নাম হয় আফগানিস্তান। 

মহাকাব্যগ্রন্থ মহাভারতেও গান্ধারের উল্লেখ আছে, গান্ধার রাজ্য এবং গান্ধারীর নাম নিশ্চয়ই সবাই শুনেছেন। পরবর্তীকালে একটা নির্দিষ্ট সময়ে আফগানিস্তানের ইসলামাইজেশন হয়েছে এবং মধ্য এশিয়া তুর্কিদের একটা সামান্য অংশ এখনো আফগানিস্থানে আছে, তারা দেখতে কিছুটা চাইনিজ টাইপের এবং অন্যান্য আফগানিদের থেকে আলাদা। এদের নাম হাজরা উপজাতি। এদের সামাজিক মর্যাদা কম, Khaled Hosseini রচিত The Kite Runner বইটি পড়লে, কিংবা এই বই এর উপরে হলিউডে নির্মিত The Kite Runner নামের ছায়ছবিটি দেখলে এটি পরিষ্কার বুঝতে পারবেন। যাইহোক, আজকের পাকতুন অর্থাৎ তালিবানদের আদি পূর্বপুরুষরা ছিল হিন্দু ক্ষত্রিয়রা। অর্থাৎ হিন্দু Warrior Class, এরা মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে কৌরবদের পক্ষে অংশ নিয়েছিল গান্ধার রাজ্যে রাজকুমার শকুনির নেতৃত্বে। পাকতুন উপজাতিদের কথা মহাভারতে লেখা হয়েছে পাখা উপজাতি হিসাবে। পাকতুনদের বীরত্বের কথা মহাভারতে বিশেষ ভাবে লেখা আছে। সম্রাট অশোকের আমলে এরা এক সময় বৌদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। এখনো আফগানিস্তানের যেখানে সেখানে একটু মাটি খুঁড়লেই বৌদ্ধ মূর্তি এবং বিভিন্ন বৌদ্ধ স্মৃতি চিহ্ন (Buddhist Relic) উঠে আসে। কিন্তু পাকতুনরা এত দুর্ধর্ষ যে তারা বেশি দিন বৌদ্ধ থাকতে পারেনি। বৌদ্ধ ধর্মের অহিংসা তাদের রক্তে নেই। আর তাই ইসলামিক আগ্রাসনে প্রথমেই তারা খুব সহজেই ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়ে যায়। তবে এখনো আফগানিস্তানের যেখানে সেখানে পরিত্যাক্ত এবং ভগ্ন হিন্দু মন্দির দেখা যায়। তবে এই সব ইতিহাস বিস্মৃতির অন্তরালে চলে গিয়েছে।

Ishtiaq Mahmood

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted