ওয়াসিম রিজভি যিনি ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে হিন্দু হয়ে নিজের নাম পালটে হয়েছেন জিতেন্দ্র নারায়ণ সিং ত্যাগী। তিনি একটি পুস্তক লিখেছেন, নাম ‘মহম্মদ’। ওয়াসিম রিজভি ছিলেন মুসলিম ওয়াকফ বোর্ডের প্রধান। নিজের লেখা বইটি সম্পর্কে রিজভি বলেছেন যে, এই বইয়ে তিনি নিজের কথা কিছুই লেখেননি। বরং বিভিন্ন হাদিসে মহম্মদ সম্পর্কে যেসব কথা বলা আছে তিনি সেই সব থেকে তথ্য সংগ্রহ করে এই বইয়ে তুলে ধরেছেন। এই বইটি আমি পড়িনি এবং হাদিসে কি লেখা আছে তাও জানি না। তবে আমার বক্তব্যটি অন্য। কংগ্রেস দলের একজন নেতা রসিদ খান সেই ব্যক্তিকে ২৫ লক্ষ টাকা দেবার কথা ঘোষণা করেছেন, যিনি রিজভি ওরফে জিতেন্দ্র নারায়ণের গলা কেটে ফেলবেন। এছাড়া, জিতেন্দ্র নারায়ণকে হত্যা করার জন্য আরো কিছু পুরষ্কারের কথা ঘোষণা করেছেন ভারতের কিছু ধর্মপ্রাণ মুসলমান। এই নিয়ে ভারতের অভিব্যক্তির স্বাধীনতার বড় বড় চ্যাম্পিয়নরা চুপ করে আছেন। কেউ কংগ্রেস নেতার বিরুদ্ধে কিছুই বলেননি। এর আগে মুনব্বর ফারুকি নামের এক কৌতুকাভিনেতা শ্রীরাম সম্পর্কে কটু মন্তব্য করায় তাকে হিন্দুরা কমেডি শো’তে অংশ নিতে দেননি দেখে স্বরা ভাস্করের মতো অভিব্যক্তির আজাদি সমর্থক এর প্রতিবাদ করে টুইট করেছেন। কিন্তু জিতেন্দ্র নারায়ণকে প্রকাশ্যে হুমকি দেওয়ার পরও এই সব আজাদির প্রবক্তারা কোন প্রতিবাদ করেননি। তবে স্বরা ভাস্করের মতো সিলেক্টিভ অভিব্যক্তির আজাদির চ্যাম্পিয়ন ছিলেন মহাত্মা গান্ধী। গান্ধীজীর অভিব্যক্তির আজাদি কেমন ছিল তা আমি ব্যক্ত করবো। শুধু তাই নয় মহাত্মা গান্ধী যে একজন সম্পাদক হত্যাকারীর মহিমা কীর্তন করেছিলেন সেই কথাও বলবো।
১৯২০ সালে ভারতে কিছু বেনামী লেখকরা তিনটি বই লিখে প্রকাশ করেন যে বইগুলো মুসলমানরা মসজিদ থেকে প্রচার করতে থাকেন। বইগুলো হলো ‘কৃষ্ণ তেরি গীতা জ্বালানা পড়েগা’, 'উন্নিশই শদিকা লম্পট মহর্ষি’ ও ‘সীতাকা ছিনালা’। প্রথম বইয়ে শ্রীকৃষ্ণের চরিত্রহনন করার যাবতীয় চেষ্টা করা হয়েছে। দ্বিতীয় বইয়ে আর্য সমাজের প্রতিষ্ঠাতা মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী সম্পর্কে অভদ্র ভাষার প্রয়োগ করে তাঁর নিন্দা করা হয়েছে। তৃতীয় বইয়ে সীতাকে চরিত্রহীনা এক নারী বলে বর্ণনা করা হয়েছে অতি অভদ্র ভাষায়। এই ব্যাপারে কোন হিন্দু বলেননি লেখকের গলা কেটে দাও কিংবা যে লেখককে হত্যা করবে তাকে পুরষ্কার দেওয়া হবে। কারণ অভিব্যক্তির স্বাধীনতা জিনিসটা ভারতে অনেক পুরনো পরম্পরা। তবে কিছু হিন্দুরা এই ব্যাপারে গান্ধীজীর শরণাপন্ন হয়ে বইগুলোর প্রচার বন্ধ করে দেবার জন্য মুসলিমদের অনুরোধ করতে বলেন। গান্ধীজী তাদের বলেন যে প্রত্যেক লোকের অভিব্যক্তির স্বাধীনতা আছে তাই এই ব্যাপারে তিনি হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। এই ব্যাপারে গান্ধীজী কিছু ভুল বলেননি। আমি নিজেও এটাকে সমর্থন করি।
এরপর ১৯২৩ সালে এক হিন্দু প্রকাশক দুটি পুস্তক প্রকাশ করেন। বইগুলোর নাম ‘শয়তান’ ও ‘রঙ্গিলা রসুল’। দুটো বই হজরত মহম্মদকে নিয়ে লেখা। লেখকের ছদ্দনাম 'দুধ কা দুধ পানি কা পানি'। অবশ্যই ছদ্মনাম কারণ লেখক তার পরিচয় গোপন করতে চাইছেন। পরে জানা গেছে লেখকের নাম ছিল পণ্ডিত এম এ ছামুপতি। তবে লাহোরের রাজপাল পাবলিশার্স বইগুলো প্রকাশ করেন যার মালিক তথা সম্পাদক ছিলেন মহাশয় রাজপাল নামের এক হিন্দু। এই বইগুলো প্রকাশিত হওয়ার পরও মুসলিম সমাজে রাজপালের বিরুদ্ধে খুব একটা আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। কিন্তু গান্ধীজী তো রাজপালকে ছেড়ে দেবার পাত্র নন। বিশেষত তিনি তখন মুসলমানদের তল্পি চেটে তাদের নেতা হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। তাই বইটি প্রকাশিত হওয়ার দেড় বছর পর গান্ধীজী তার ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’ পত্রিকায় লিখেন ‘বইগুলো অতি নিম্ন মানসিকতা থেকে এক নীচ ব্যক্তির লেখা যিনি মহম্মদকে বদনাম করে টাকা কামাতে চাইছেন’। গান্ধীজীর বক্তব্য সম্পর্কে আমার কিছুই বলার নেই কারণ মহম্মদ সম্পর্কে আমার কোন জ্ঞান নেই। তবে আগে যখন অভিব্যক্তির স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন তখন এই ব্যাপারের অন্তত চুপ করে থাকতে পারতেন। সেটা না করে তিনি বলেছেন যে মুসলিম সমাজের উচিত প্রকাশক মহাশয় রাজপালকে এই বই প্রকাশ করার জন্য শাস্তি দেওয়া। অর্থাৎ প্রকারান্তরে তিনি মুসলিমকে সমাজকে উস্কানি দিয়েছেন প্রকাশককে শাস্তি দিতে।
এরপর ১৯২৪ সালে মুসলিম সমাজ প্রকাশক মহাশয় রাজপালের বিরুদ্ধে লাহোর কোর্টে মামলা দায়ের করে। আদালত রাজপালের কাছ থেকে জানতে চায় এই পুস্তকগুলোর আসল লেখক কে। রাজপাল লেখকের নাম বলতে অস্বীকার করেন। তিন বছর ধরে মামলা চলার পর ১৯২৭ সালে আদালত অভিব্যক্তির স্বাধীনতার কারণে রাজপালকে নিরপরাধ বলে ঘোষণা করে তাকে এই মামলায় রেহাই দেয়। আদালত যখন এই মামলার রায় দিয়েছে তখন গান্ধীজীর কিছুই বলার ছিল না। কিন্তু তিনি ভেতরে ভেতরে ফুঁসতে থাকেন এবং রাজপালের কঠোর শাস্তি কামনা করেন। আদালতের এই রায়ের পর থেকে মুসলিম সমাজ রাগে ফুসতে থাকে। নানান মিটিং মিছিল করে তারা রাজপালের মুণ্ডপাত করতে থাকেন। রাজপালের প্রাণ সংশয় হয়ে পড়ে। এই সুযোগে গান্ধীজী মুসলমানদের গোসাকে উস্কে দিয়ে তার ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’তে লিখেন যে আদালত যদি মুসলিমদের ন্যায় দিতে অসমর্থ হয়েছে তখন মুসলিম সমাজের উচিত নিজে থেকে রাজপালকে শাস্তি দেওয়া। গান্ধীজী অহিংসার প্রচারক তাই মনের কথা পরিষ্কার করে বলতে পারেননি তবে ইশারায় মুসলিমদের যা বলার তা বলে দিয়েছেন। এরপর রাজপালের ওপর দু’বার প্রাণঘাতী হামলা হয় এবং গান্ধীজী নীরব থাকেন। খুদা বক্স নামে যে কুস্তিগির রাজপালের ওপর হামলা চালিয়েছিল আদালত তাকে দশ বছর কারাবাসের শাস্তি দেয়। তবে খুদা বক্সের হামলায় রাজপাল বেঁচে যান। এরপর ইলমুদ্দিন নামে এক উনিশ বর্ষীয় যুবকের হামলায় অহিংসাবাদী গান্ধীজীর ইচ্ছে পূরণ হয়ে যায়। অর্থাৎ রাজপালের মৃত্যু ঘটে। বিচারে ইলমুদ্দিনের ফাঁসি হয়। ইল্মুদ্দিনের জানাজায় হাজির ছিলেন মহম্মদ আলি জিন্না ও 'সারে জাঁহাসে আচ্ছা' খ্যাত কবি ইকবাল। ইকবাল বলেছেন 'আমরা শিক্ষিত হয়ে যে মহান কাজ করতে পারিনি ইল্মুদ্দিন সেই কাজ করে দেখালো'। গান্ধীজী তার 'ইয়ং ইন্ডিয়া' পত্রিকায় লিখেন যে ইলমুদ্দিনের ফাঁসির দিনটি ইতিহাসে কালো দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এই ভাবেই অহিংসার পূজারী গান্ধীজী ইল্মুদ্দিনের মতো এক আততায়ীকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। এই হলো গান্ধীজীর অহিংসা ধর্মের পালন। সবাইকে ধন্যবাদ।
Ishtiaq Mahmood
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................