কেন মহান নবী হযরত মহম্মদ তাঁর ছবি মূর্তি নিষিদ্ধ করেছিলেন!

অগ্রগতির উত্তর দক্ষিণ / দেবাশিস লাহা 

কী এবার বুঝলেন তো, কেন মহান নবী হযরত মহম্মদ তাঁর ছবি মূর্তি নিষিদ্ধ করেছিলেন!  উঁহু, ভুঁড়ি, চর্বি ভুলে যান, যতটা সুদর্শন করে আঁকা সম্ভব, বিশ্বসেরা শিল্পী দিয়ে, এশিয়ান পেইন্টস, বার্জার থেকে শুরু করে মোনালিসা, লাস্ট সাপারে ব্যবহৃত ভিঞ্চির রঙ তুলি দিয়ে এক খানা এঁকে ফেলুন দেখি। ফল হাতে নাতে পাবেন!  আর কার্টুন?  কল্পনাতেও আনবেননা!  নবীর কার্টুন আঁকার অপরাধে ফ্রান্সের চার্লি হেবদো নামক পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত সম্পাদক সহ বারো জন কর্মীকে কোথায় পাঠানো হয়েছিল, না জানলে জেনে নিন। কিন্তু কেন?  নবী কি আহাম্মক ছিলেন?  ওঁর কি বুদ্ধি সুদ্ধি ছিলনা?  উঁহু, একেবারেই বিপরীত!  ওঁর মত দূরদর্শী, মহান যুগ দ্রষ্টা এ জগতে অত্যন্ত বিরল। তা, কেন তিনি তাঁর এবং সৃষ্টি কর্তার ছবি মূর্তির অনুমোদন দিলেন না?  মুড অফ ছিল বলে?  কিছু না ভেবেই?  বরং উল্টোটা। অগ্রপশ্চাৎ ভেবেই এই সিদ্ধান্ত। নবীই বলুন আর সৃষ্টি কর্তাই বলুন যথেষ্ট ছবি আঁকার অনুমোদন থাকলে তা জনগণের সম্পত্তি হয়ে যায়। ক্রমে ক্রমে লোকায়ত হয়ে ওঠে। যেমনটি ঘটেছে হিন্দু দেবদেবীর ক্ষেত্রে। মহাদেব, কৃষ্ণ, পার্বতী, গনেশ কেউই বাদ পড়েননি। গাঁজাখোর, ভুঁড়িওয়ালা শিব থেকে শুরু করে গনেশ কার্তিকের পেছনে  ছুটে বেড়ানো মা দুর্গা, ননীচোর কানু এসব লোকায়ত ছবি, গল্প, কবিতা নিঃসন্দেহে শিল্প সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। মনননের অগ্রগতি ঘটিয়েছে।" দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়রে দেবতা!" বাহ বেশ!  কিন্তু ওই যে সব কিছুরই দুটি দিক আছে। নদীর পাড়ের মত। একূল যখন গড়ে ওঠে ওকূল তখন ভাঙতে থাকে!  দেব দেবী লোকায়ত হয়ে গেলে শ্রদ্ধা ভক্তিটিও কেমন ইয়ে হয়ে যায়। ম্যাজেস্টিক মহাদেবটি ঘর গেরস্থালির  ভুঁড়িদার মেসো মশাই হয়ে উঠলে ভক্তি কতটা থাকে জানা নেই, তবে ভয় ব্যাপারটা ফুড়ুৎ করে কেটে পড়ে।  কী ভাবছেন?  ভয় না থাকাই ভাল?  হা হা হা!  ভয় না থাকলে যে কী পরিণতি হয় ভাগাড়ের অধিবাসী হয়েও বুঝতে পারছেননা।  মেকিয়াভেলি, চাণক্য পড়ে দেখুন। দেবতা বাদ দিন, শাসকের  প্রতিও ভয় যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ উপলব্ধি করবেন। আর এই সত্যটিই এঁদের অনেক অনেক আগে নবী মহম্মদ উপলব্ধি করেছিলেন ( ওঁকে যত পড়ি, বিস্মিত হই।)  তাই সৃষ্টি কর্তাকে যতনা ভালবাসা, ভক্তির কথা বলেছেন, ভয় দেখিয়েছেন অনেক বেশি। মানুষ ভক্তিতে যতটা মানে, ভয়ে মানে তার চেয়ে অনেক বেশি। এই সত্যটি তিনি বুঝেছিলেন। তাই " অগ্রগতি " নামক বিষটিকে রুখে দেওয়ার জন্য পরবর্তীকালের ইসলামি ব্যক্তিত্বরাও অক্লান্ত প্রয়াস করে গেছেন!  কী! অগ্রগতিকে বিষ বললাম বলে চটে গেলেন নাকি!  উঁহু একদম চটবেন না। অমৃত, বিষ সবই আপেক্ষিক মশাই। ওই যে ইংরেজি প্রবাদটি -- One man's meat,  another man's poison.  আপনার কাছে যাহা অমৃত অন্যের নিকট তাহা বিষও হইতে পারে। কেন বলুন তো?  "অগ্রগতি " নামক প্রতীতিটি প্রকৃতি  সৃষ্টি করেনি। এটি পুরোপুরি মানুষের বানানো।প্রকৃতি জ্ঞান বিজ্ঞান প্রজ্ঞার পরোয়া করেনা৷ সে কেবল টিঁকে থাকায় বিশ্বাস করে।  পরিষ্কার হল না তো?  সহজ করে বুঝিয়ে দিচ্ছি। ধরা যাক আমি এবং আপনি একটি নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে হাঁটছি। আপনি উত্তর মেরু, আমি দক্ষিণ মেরু। আপনি প্রায় পৌঁঁছে গেছেন। ধরুন নওয়ের ট্রমসা নামক একটি ভূখণ্ডে। আর কিছুটা এগোলেই উত্তর মেরুর সেই অভীপ্সিত পয়েন্ট!  আমিও প্রায় পৌঁছে গেছি। ঢিল ছুঁড়লেই এন্টার্টিক।  ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? আপনি ভাবছেন আমি কত পিছিয়ে আছি!  আর আমি ভাবছি আপনি কত পিছিয়ে আছেন। কারণ আমরা উভয়েই নিজের গন্তব্যটিকেই একমাত্র সঠিক বলে মনে করি!  "অগ্রগতি" ও তেমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি মাত্র। প্রকৃতি নয়, মানুষের সৃষ্ট।  তাই আপনি ভাবেন আমি কত পিছিয়ে আছি!  আমি ভাবি আপনি কত পিছিয়ে আছেন!  তবে অগ্রগতি ফলে কি কোনো লাভ হয়নি!  আলবাত হয়েছে!  ব্যক্তিস্বাধীনতা, দেবদেবীর লোকায়ত করণ, ভয় বিসর্জন দিয়ে শুধুই ভালবাসা, ভক্তি, সৃষ্টি কর্তাকে অস্বীকার, প্রশ্ন করার অধিকার এসবই তো আমাদের কত মণিমাণিক্য দিয়েছে! বেদ বেদান্ত  নালন্দা, বিক্রমশীলা, ওদন্তপুরি, তক্ষশীলা,  গীতগোবিন্দ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, চণ্ডী  মঙ্গল , পুরান -- এমন কত কী!  আর ওরা?  না ওদের একটা ওদন্তপুরিও নেই। নালন্দা তো দূরের কথা!  তবে কি ওদের কিছুই নেই!  আছে, অনেক কিছুই আছে। যা আমরা আবর্জনা ভেবে বাতিল করেছি, তাকেই ওরা সম্পদ বানিয়ে নিয়েছে। ওই যে নদীর কূলের মত। একটি গড়া নিয়ে আপনি যখন ব্যস্ত, ঠিক তখন নিঃশব্দে, নীরবে আর একটি কূল ভেঙে পড়তে থাকে। আপনি আমি যেমন একটি কূল রেখে আর একটি কূল হারিয়ে ফেলছি, ওরাও ঠিক তাই করছে। কী ভাবছেন?  আমি "অগ্রগতির" বিরুদ্ধে?  উঁহু একদম নয়। আমি নিজেই তো অগ্রগতির ফসল!  না, আমি বিরোধীও নই, সমর্থকও নই। বিশ্লেষক মাত্র। নির্মোহ, নির্মম। তবে আমরা কী হারাচ্ছি!  এখনও বোঝেননি?  উত্তরমেরুর দিকে হেঁটে যাওয়া মানুষটির "অগ্রগতি" তাকে একদিন ঊর্ধ্বগামী কর্পূরে পর্যবসিত করবে!   খুব বেশি উচ্চতায় উঠতে চাইলে যা হয়। আর দক্ষিণ মেরুর দিকে হেঁটে যাওয়া মানুষটি? কেন বোঝেন নি?  সে আরও কিছুকাল মাটির কাছাকাছি থেকে যাবে! টিকে যাবে!  তারপর?  তারপর আবার কি?  উত্তরমেরু অভিমুখী সবাইকে কর্পূর বানিয়ে দেওয়ার পর দক্ষিণ মেরু অভিমুখী মানবগোষ্ঠীটিও একদিন উত্তর মেরুর অগ্রগতি চেখে দেখতে চাইবে। তবে ততদিনে হয়ত পৃথিবীটাই ---- ভাবুন, ভাবা প্র‍্যাকটিস করুন ( আমার প্রথম উপন্যাসের অন্যতম বিষয় এই dilemma) কী ভয় পেলেন বুঝি! আর একটি সম্ভাবনাও আছে। সে বিষয়েও একটি আলোচনা থাকছে অমৃতস্য পুত্রাঃ দ্বিতীয় খণ্ডে।

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted