দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম নারী চিকিৎসক বাংলার গর্ব কাদম্বিনী গাঙ্গুলী।

দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম নারী চিকিৎসক বাংলার গর্ব কাদম্বিনী গাঙ্গুলী

কাদম্বিনী গাঙ্গুলী ইউরোপীয় চিকিৎসা শাস্ত্রে শিক্ষিত দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা চিকিৎসক। তিনি ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ১৮ জুলাই বিহারের ভাগলপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তবে মূল বাড়ি ছিল বর্তমান বাংলাদেশের বরিশাল জেলার চাঁদসিতে। তিনি ছিলেন ভাগলপুর স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও ব্রাহ্ম সংস্কারক ব্রজকিশোর বসু। ব্রজকিশোর বসু অভয়চরণ মল্লিকের সাথে ভাগলপুরে মহিলাদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন করেছিলেন । তাঁরা ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে মহিলাদের অধিকার আদায়ের জন্য মহিলাদের সংগঠন ভাগলপুর মহিলা সমিতি স্থাপন করেন। এটি ছিল ভারতে প্রথম। বঙ্গমহিলা বিদ্যালয়ে কাদম্বিনী অধ্যয়ন শুরু করেন। তাঁর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বেথুন কলেজ প্রথম এফএ (ফার্স্ট আর্টস) ও অন্যান্য স্নাতক শ্রেণি শুর করা হয়। ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে কাদম্বিনী ও চন্দ্রমুখী বসু বেথুন কলেজের প্রথম গ্র্যাজুয়েট হয়েছিলেন। উভয়ে ছিলেন ভারতে এবং সমগ্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট । কাদম্বিনী গাঙ্গুলী কাদম্বিনী দেবী নামে সমধিক পরিচিত।

ঐ যুগে নারীদের শিক্ষালাভের সুযোগ ছিল না বললেই চলে। তবু পুরুষের ন্যায় যে কয়জন নারী সে সময় অধ্যায়নের সুযোগ পেয়েছিলেন তাদের মধ্যে আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর বোন স্বর্ণপ্রভা, দুর্গামোহন দাসের কন্যা সরলা দাস ও মোনমোহন ঘোষের বোন বিনোদমণি প্রমূখ উল্লেখযোগ্য। ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এন্ট্রাস পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ পান দুজন ছাত্রী। তারা হলেন সরলা দাস ও কাদম্বিনী। তবে সরলা দাস পরীক্ষা দিতে পারেন নি। কাদম্বিনী বসু পরীক্ষায় অংশ নিয়ে দ্বিতীয় বিভাগে এন্ট্রাস পাস করেন।

১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার বেথুন কলেজের ছাত্রী হিসেবে কাদম্বিনী বসু বি এ পরীক্ষায় অংশ নেন এবং কৃতিত্বের সাথে বি এ ডিগ্রি লাভ করেন। তখন তাকে বাংলার প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট হিসেবে স্বিকৃতি দেয়া হয়। ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে কাদম্বিনী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। 
একই বছর ২১ বছর বয়স্ক কাদম্বিনীর সাথে মেডিকেল কলেজের খ্যাতিমান শিক্ষক বিপত্নীক দ্বারকানাথ গাঙ্গুলীর (৩৯ বছর বয়স্ক) শুভ পরিণয় সম্পন্ন হয়। মেডিকেলের ছাত্রী হিসেবে সে সময় তিনি মাসিক কুড়ি টাকা বৃত্তি পেতেন। তিনি ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে মেডিকেলের চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নেন। লিখিত পরীক্ষার পাস করলেও ব্যবহারিক পরীক্ষার একটি অপরিহার্য অংশে অকৃতকার্য হন। তারপরও কতৃপক্ষ তার দীর্ঘদিনের অধ্যয়ন ও নিষ্ঠার কথা বিবেচনা করে ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে তাকে গ্র্যাজুয়েট অব বেঙ্গল মেডিকেল কলেজ ( জিবিএমসি ) ডিগ্রি দেন। এটি পাওয়ার পর তিনিই হন প্রথম ভারতীয় ডিগ্রিপ্রাপ্ত নারী চিকিৎসক। উল্লেখ্য উপমহাদেশের প্রথম মুসলমান বাঙালি মহিলা চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. জোহরা বেগম কাজী (১৯১২-২০০৭)।

কাদম্বিনী প্রথম বাঙানি নারী চিকিৎসক হিসেবে ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে মাসিক তিনশ টাকা বেতনে যোগ দেন লেডি ডাফরিন মহিলা হাসপাতালে। ডাক্তার হিসেবে পেশাগত কারণে কাদম্বিনী গাঙ্গুলীকে রোগিদের সেবায় দিবারাত্র হাসপাতালে বা রোগিদের বাড়ি যেতে হত। তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজ বিষয়টি ভালো চোখে দেখে
নি। তারা কাদম্বিনীর নামে নানা রকম নোংরা কথা বলতে শুরু করে। ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে সনাতনপন্থী সাময়িকী ‘বঙ্গবাসী’ তাকে পরোক্ষভাবে বেশ্যা অভিহিত করে। কাদম্বিনী গাঙ্গুলী বঙ্গবাসী পত্রিকার সম্পাদক মহেশ পালের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেন। মামলায় কাদম্বিনী জয়লাভ করেন। মহেশ পালের ৬ মাসের কারাদন্ড ও ১০০ টাকা জরিমানা হয়। কাদম্বিনী গাঙ্গুলী ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে চিকিৎসাশাস্ত্রে উচ্চতর ডিগ্রির জন্য এডিনবার্গে গমন করেন। এক বছর পরে এল আর সি পি (এডিনবরা), এল আর সি এস (গ্লাসগো) এবং ডি এফ পি এস (ডাবলিন) উপাধি নিয়ে দেশে ফেরেন । বিলেত যাবার আগে ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি কিছুদিন লেডি ডাফরিন মহিলা হাসপাতালে মাসিক ৩০০ টাকা বেতনে কাজ করেছিলেন । 

১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে বোম্বে শহরে কংগ্রেসের পঞ্চম অধিবেশনে প্রথম যে ছয় জন নারী-প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিলেন তম্মধ্যে কাদম্বিনী ছিলেন অন্যতম। পরের বছর তিনি কলকাতার কংগ্রেসের ষষ্ঠ অধিবেশনে বক্তব্য রাখেন । কাদম্বিনী ছিলেন কংগ্রেসের প্রথম মহিলা বক্তা। কাদম্বিনী গান্ধীজীর সহকর্মী হেনরি পোলক প্রতিষ্ঠিত ট্রানসভাল ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম সভাপতি এবং ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় অনুষ্ঠিত মহিলা সম্মেলনের সদস্য ছিলেন । ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতায় সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের অধিবেশনে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন । এই অধিবেশন মহাত্মা গান্ধীর সম্মানের আয়োজন করা হয়েছিল। কাদম্বিনী চা বাগানের শ্রমিকদের শোষণের বিষয়ে অবগত ছিলেন। তিনি আসামের চা বাগানের শ্রমিকদের কাজে লাগানোর পদ্ধতির নিন্দা করেছিলেন । কবি কামিনী রায়ের সাথে কাদম্বিনী দেবী ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে বিহার এবং ওড়িষ্যার নারীশ্রমিকদের অবস্থা তদন্তের জন্য সরকার দ্বারা নিযুক্ত হয়েছিলেন । 

১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ৩ অক্টোবর তিনি মৃত্যুবরন করেন।

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted