দ্য স্যাটানিক ভার্সেস এর ধারাবাহিক বাংলা অনুবাদ প্রকাশ।
দ্য স্যাটানিক ভার্সেস
মূল: সালমান রুশদি
অনুবাদ: ইবলিস ঠাকুর #ইবলিস_ঠাকুর
পর্বঃ ০১ #TheSatanicVerses_BN_01
পরের পর্বঃ #TheSatanicVerses_BN_02 (will be available soon)
সকল পর্বঃ #TheSatanicVerses_BN
শয়তান এভাবেই ভবঘুরে, বিচরণশীল, অস্থির এক অবস্থার মধ্যে আবদ্ধ। সে আবাসহীন, তার কোনো নির্দিষ্ট ঘরবাড়ি নেই। তবে তার ফেরেশতাসুলভ প্রবৃত্তির কারণে, তরল বর্জ্য কিংবা বাতাসের জগতে সে একটা সাম্রাজ্যের মালিক। কিন্তু সাম্রাজ্যের মালিক হয়ে লাভটা কী! এই রাজত্বের মালিক হওয়াটাও তো তার শাস্তিরই অংশ, শয়তানের জীবনটা এমনই.....কোনো স্থান বা জায়গায় তার পা ফেলবার অনুমতি নেই।
-ড্যানিয়েল ড্যাফো, শয়তানের ইতিহাস
১
ফেরেশতা জিবরিল
আকাশ থেকে ডিগবাজি খেতে খেতে জিবরিল ফেরেশতা গেয়ে উঠলেন, “পুনরায় জন্ম নিতে হলে তোমাকে আগে মরতে হবে। হোজি! হোজি! পৃথিবীর বুকে নামতে হলে তো আগে উড়তে হবে। তাত-তা! তাকা-থুন! তুমি যদি প্রথমে না-ই কাঁদো তাহলে কখনো হাসবে কীভাবে? দীর্ঘশ্বাস ছাড়া প্রিয়তমর প্রেমকে কীভাবে জয় করবে তুমি? বাবা, তুমি যদি আবারো জন্ম নিতে চাও.....” ভোর হওয়ার ঠিক আগে এক শীতের সকালে, সময়টা নববর্ষের দিন অথবা, নববর্ষের আশেপাশেই হবে, এ-রকম সময়ই পরিষ্কার আকাশ থেকে দুজন সত্যিকারের, প্রাপ্তবয়স্ক, জীবন্ত মানুষ কোনোরূপ প্যারাসুট বা ডানার সাহায্য ছাড়াই ইংলিশ চ্যানেলের ওপর এসে ধপাস করে পড়ল। “তোমাকে বলেছিলাম, বলেছিলাম আমি, বলেছিলাম না যে, তোমাকে মরতে হবে,” আর এভাবেই, ঠিক এ-রকমভাবেই আলবাস্টারের চাঁদের নিচে রাত পার না হওয়া পর্যন্ত চিৎকার ভেসে আসতে থাকে, “সিনেমার মধ্যে শয়তানের সাথে তুমি তোমার সুরগুলো দিয়ে শুধু প্লেব্যাক গায়কদের অনুকরণই করে গিয়েছ, তাই এখন আমাকে এই নারকীয় শব্দগুলো থেকে রেহাই দাও।” বরফ আচ্ছাদিত শুভ্র রাতে কথাগুলো যেন স্ফটিকের মতো ঝুলে থাকে।
পৃষ্ঠা-১
জিবরিল একজন গায়ক, তবে তার গলায় কোনো সুর নেই। সেই জ্যোৎস্নারাতে তিনি এমনভাবে তিড়িং-বিড়িং করে লাফাচ্ছিলেন যে, তার লাফানো দেখে মনে হচ্ছিল, তিনি বিনা প্রস্তুতিতেই তার গজল গেয়ে চলেছেন। তার উন্মত্ত লম্ফ-ঝম্ফ দেখে এমনটাও মনে হচ্ছিল যে, তিনি হয়তো বাতাসের মধ্যে সাঁতার কেটে চলেছেন। বাতাসের ওপর একনাগাড়ে বাটারফ্লাই-স্ট্রোক, ব্রেস্ট-স্ট্রোক দিয়েই যাচ্ছেন। নিজেকে তিনি এমনভাবে গুটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন যেমনটা একটা বলের মধ্যে কোনোকিছুকে গুঁজে দেওয়া হয়। ভোর হওয়ার ঠিক পূর্বমুহুর্তে প্রায়-সীমাহীনতার মতো যে অবস্থাটার সৃষ্টি হয় না, জিবরিল সেই অন্তহীনতার প্রতিকূলে একটা ইগলের মতোই নিজেকে ছড়িয়ে দিলেন। মাধ্যাকর্ষণের শক্তি পাশ কাটাতে তিনি এমন অঙ্গিভঙ্গি করলেন, যেন তিনি কোনো ওহি নিয়ে আগমন করছেন। তাছাড়াও, এই মাধ্যাকর্ষণকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য তাকে বাধাহীনভাবে মাথা উঁচু রেখে শরীরটাকে শুইয়ে অসভ্য রসিকতারও সাহায্য নিতে হয়েছিল। এখন তিনি মনের সুখে বিদ্রূপাত্মক সেই কণ্ঠটার দিকে ঝুঁকলেন। “আরে, সালাদ বাবা যে, খুবই ভালো, কী হে, বুইড়া চামস।” যাকে উদ্দেশ্য করে এই কথাগুলো বলা, সে ব্যক্তি একটি ধূসর বর্ণের সুট পরিধান করে আছেন। সেই সুটের জ্যাকেট-বোতামগুলো সব লাগানো। একটি চটকদার ছায়ার মাথাসদৃশ অংশটা এসে সেই ধূসর সুটের ওপর পড়ল। ভদ্রলোকের মাথায় থাকা গোল-হ্যাটটা যে পড়ে গিয়েছে সেটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য তিনি তার দুহাতকে মাথার দুপাশে নিয়ে বিষয়টির সত্যতা পরখ করে দেখলেন। ঘৃণাকারীর মুখের ওপর একটা বিকৃত নাম ছুঁড়ে দিলেন। “হেয়, স্পোনো,” জিবরিল চিৎকার করে উঠলেন, দ্বিতীয়বারের মতো উলটা-পালটা ঝাঁকুনি দিয়ে আবারো বলা শুরু করলেন, “প্রোপার লন্ডন ভাই! এই যে আমরা এসে গেছি! নিচে থাকা জারজগুলো কখনো জানতেও পারবে না যে তাদেরকে কীসে আঘাত করেছে। এই আঘাত উলকা, বজ্রপাত কিংবা, ঈশ্বরের প্রতিশোধ। ওরা একেবারে হালকা বাতাসের বাইরে চলে যাবে, বেবি। _ধ্রাআআআমমম_হোয়াম, না? কী দারুণ আগমন, ইয়ার। আমি কসম করে বলছি: শব্দটা পানিতে পিছলে পড়ার মতোই।”
হালকা বাতাসের বাইরে: বিগ ব্যাং, বিগ ব্যাংকে অনুসরণকারী পতনশীল নক্ষত্রপুঞ্জ। মহাজাগতিক সূচনা, জন্মের সময়কার একটি ক্ষুদ্র প্রতিধ্বনি......জাম্বো জেট_বোস্টন_, ফ্লাইট এআই-৪২০ কোনোরূপ সতর্কতা ছাড়াই উড়ে গেছে। বিমানটি উড়ে গিয়েছে বিশাল, পচতে থাকা, অপরূপ, তুষার-শুভ্র, আলোকিত শহর, মাহাগনি, ব্যবিলন, আলফাভিলের ওপর দিয়ে। কিন্তু জিবরিল তো ইতোমধ্যেই এই শহরটির নাম দিয়েই দিয়েছেন, এই নামে আমার হস্তক্ষেপ করা মোটেই উচিত নয়: প্রোপার লন্ডন, ভিলায়েতের রাজধানী, রাত্রিবেলা চোখের পলক ফেলে যে শহরটা মাথা নাড়ে। হিমালয়ের উচ্চতায় যখন একটা ক্ষণস্থায়ী ও অকালপক্ক সূর্য জানুয়ারি মাসের মিহি বাতাসে ফেটে যায়, বিমানের রাডার স্ক্রিন থেকে তখন ব্লিপ শব্দটা গায়েব হয়ে যায়। হালকা বাতাস এখন দেহ দিয়ে পূর্ণ। দেহগুলো সব সর্বনাশা এভারেস্ট থেকে সমুদ্রের দুধের পাণ্ডুরতায় অবতরণ করে।
আমি কেডা!
আর কে কে আছে এখানে?
উড়োজাহাজের অর্ধেকটা দুমড়ে-মুচড়ে গেল, যেন অঙ্কুরোদগম হওয়ার সময় বীজের খোলসটা ভেঙে গেল, ডিম যেন তার রহস্যকে উন্মোচন করে দিলো। লাফালাফি করা জিবরিল আর বোতামওয়ালা, টাকাওয়ালা জনাব সালাদিন চামচা দুজনই অভিনেতাই এমনভাবে ভূ-পাতিত হলেন যেমনভাবে তামাকের চূর্ণ টুকরোগুলো একটি পুরোনো ভাঙা সিগার থেকে ঝড়ে পড়ে। তাদের ওপরে, পেছনে, নিচের শূন্যস্থানে হেলান দেওয়া আসন, স্টেরিওফোনিক হেডসেট, ড্রিঙ্ক ট্রলি, গতির কারণে সৃষ্ট অস্বস্তি রোধকারী যন্ত্র, অবতরণ কার্ড, শুল্ক-মুক্ত ভিডিয়ো গেম, বিনুনি করা টুপি, কাগজের পেয়ালা, কম্বল, অক্সিজেন মাস্ক ঝুলে ছিল। এছাড়াও -- সেখানে বেশ কয়েকজন অভিবাসী ছিল, হ্যাঁ, বেশ কয়েকজন বিবাহিত নারীও ছিল যারা স্বাভাবিকভাবেই পুড়ে আঙ্গার হয়ে গিয়েছিল। এই নারীরা তাদের স্বামীর যৌনাঙ্গে থাকা তিলের দৈর্ঘ্য ও পার্থক্য নির্ণয়কারী অফিসিয়াল হিসেবে কাজ করত। স্থানটিতে পর্যাপ্তসংখ্যক শিশুও রয়েছে যাদের বৈধতার ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকার তাদের সদা-অযৌক্তিক সন্দেহ জারি রাখে। এরা সবাই, সবকিছুই বিমানের অবশিষ্টাংশের সাথে মিশে গিয়েছে, সবকিছুই সমানভাবে খণ্ডিত, একই রকম কিম্ভূতিকিমাকার। আত্মার ধ্বংসাবশেষ সেখানে ভেসে গিয়েছে। ভাঙা স্মৃতি, ছিন্নভিন্ন আত্মা, নিদারুণ পীড়াদায়ক মাতৃভাষা, ভেঙে যাওয়া গোপনীয়তা, অনুবাদের অযোগ্য কৌতুক, নিভে যাওয়া ভবিষ্যৎ, হারিয়ে যাওয়া প্রেম, ‘শূন্যতার’ ভুলে যাওয়া অর্থ, বিস্ফোরণজাতীয় শব্দ, _জমি_অধিকারভুক্ত_আবাস। বিস্ফোরণের ফলে, জিবরিল ও সালাদিন কিছুটা বোকা বনে যান। তারা দুজন এত দ্রুত গতিতে পড়তে থাকেন, যেন কোনো খোলা-ঠোঁটওয়ালা সারস অসতর্কভাবে তার মুখ থেকে কোনো কিছুর গোছা ফেলে দিয়েছে। প্রথম প্রথম চামচা মাথা নিচু করে ছিল। তার মাথা নিচু করার ভঙ্গিটা ঠিক সেরকমই যেরকমটা একজন শিশু তার জন্ম-নালীতে প্রবেশ করার সময় করে থাকে। অন্যদের মতো স্বাভাবিকভাবে ভূপাতিত হওয়াটাকে তিনি গ্রহণ না করায় অন্যদের তুলনায় তিনি কষ্ট খানিকটা কম অনুভব করেছিলেন। সালাদিন খাঁড়াভাবেই বিমান থেকে পড়ে যাচ্ছিলেন। তবে ফারিশতা যিনি কি-না সংযমের কৌশলবিহীন উত্তেজিত, অপ্রতিরোধ্য একজন অভিনেতা, তিনি বাতাসকে তার হাত আর পা দিয়ে আলিঙ্গন করে ধরে রাখতে চাইছিলেন। নিচে মেঘে-আচ্ছাদিত ইংলিশ স্লিভের ধীর গতির স্রোত, যে স্থানটা তাদের জলমেয় পুনর্জনমের নির্ধারিত অঞ্চল, তাদের আগমনের অপেক্ষায় রয়েছে।
জিবরিল গেয়ে উঠলেন, “ও, আমার জুতা জাপানি,” পুরোনো এই গানটিকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে অর্ধচেতন অবস্থায় আশ্রয়-দানকারী ইংরেজ জাতিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে গাইলেন, “এই পাজামাগুলো ইংলিশ, দয়া করো। আমার মাথায় লাল রাশিয়ান টুপি; এ-সব কিছুর জন্যই আমার হৃদয়খানা ভারতীয়।” মেঘগুলো বুদবুদ হয়ে তাদের দিকে ধেয়ে আসছিল। আর এই মেঘের ধেয়ে আসা কারণটা সম্ভবত, জলভরা মেঘ ও সাধারণ মেঘপুঞ্জর বিভ্রান্ত-বিমূঢ় অবস্থা, যেটা অবস্থাটাকে বলা যায়, ভোরবেলায় হাতুড়ির মতো দাঁড়িয়ে থাকা শক্তিশালী ঘূর্ণায়মান বজ্রপাত। কিংবা, মেঘের ধেয়ে আসাটা ছিল একটা গানের আসর (একজন গান গাইছে, আরেকজন সেই গান শুনে দুয়োধ্বনি দিচ্ছে), কিংবা মেঘের এগিয়ে আসার কারণটা হয়তো, ভূপাতিত হতে যাওয়া এই দুই ব্যক্তির বিস্ফোরণ—প্রলাপ ছিল, যা পতিত হতে যাওয়া ব্যক্তিদের অনিবার্যভাবে ঘটতে যাওয়া ঘটনাগুলোর পূর্বসচেতনতা থেকে রেহাই দিয়েছিল। মেঘের ধেয়ে আসার কারণ যা-ই হোক না কেন, এই দুজন ব্যক্তি, জিবরিলসালাদিন ফারিশতাচামচা, এই অন্তহীন কিন্তু ফেরেশতা-শয়তানমূলক পতনের নিন্দা জানিয়েছিলেন। তবে যে মুহুর্তে তাদের রূপান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছির সে সম্পর্কে তারা সচেতন হননি।
রূপান্তর?
জি, স্যার। তবে এলোমেলো রূপান্তর নয়। মহাজগতের সেই নরম, অদৃশ্য ক্ষেত্রটিতে, লক্ষ-কোটি বছর পর যে ক্ষেত্রটির সৃষ্টি হওয়া সম্ভব হয়েছে, এবং এই ক্ষেত্রটিই লক্ষ-কোটি বছরকে সম্ভব করে তুলেছে, ঠিক সেই স্থানটিতেই মহাজগৎ তার নির্ধারিত অবস্থানগুলোর মধ্যে একটি হয়ে উঠছে। আন্দোলন ও যুদ্ধের ক্ষেত্র, গ্রহ-সংকোচনকারী, সবচেয়ে অনিরাপদ ও ক্ষণস্থায়ী অঞ্চলগুলোর একটি, অলীক, বিচ্ছিন্ন, রূপান্তরিত,--কারণ আপনি যখন সবকিছুকে বাতাসে ছুঁড়ে ফেলেন তখন যে-কোনোকিছু হওয়াই সম্ভব—এই স্থানটিতেই, উন্মত্ত সব অভিনেতার মাধ্যমেই একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ পরিবর্তন স্থান করে নিয়েছিল, যে বিষয়টা জনাব ল্যামার্ক সাহেবের অন্তরটাকে যারপরনাই আনন্দিত করেছিল: চরম পরিবেশগত চাপের মধ্যেই, বৈশিষ্ট্যসমূহ
অর্জিত হয়েছিল।
কী কী বৈশিষ্ট্য?
https://www.facebook.com/100064819032406/posts/pfbid0jJqhBCTUJayJcMx2Tfdv3vyQmxo5hvV2JKwPvXWKA8FaaScVz3B2y689KyffpaHZl/
ধীরে বৎস ধীরে; তুমি কি এমনটা ভাবো যে কোনো কিছুর সৃষ্টি খুব তাড়াহুড়ো করে ঘটে? তাই তো, স্বর্গীয় ওহিতেও এমনটা বলা নেই......এক নজরে ওহির বাক্যজোড়ার ওপর চোখ বুলিয়ে নাও। অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ্য করলে কী? কেবল দুটি বাদামি বর্ণের মানুষ খুবই জোরে ধপাস করে আপতিত হয়, তুমি হয়তো ভাবতে পারো যে এখানে নতুন কিছুই নেই; তারা আসলে অনেক উঁচুতে আরোহণ করেছিল, নিজেদেরকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল, সূর্যের খুবই কাছে উড়ে গিয়েছিল, এমনটাই কী?
না, এমনটা না। শোনো:
জনাব সালাদিন চামচা, জিবরিল ফারিশতার মুখ থেকে নির্গত শব্দে যারপরনাই আতঙ্কিত বোধ করলেন। তিনি তার নিজের আয়াত দিয়েই ফারিশতাকে পালটা আক্রমণ করলেন।
[চলবে]
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................