সালমান রুশদীর দ্য স্যাটানিক ভার্সেস (শয়তানের আয়াত) উপন্যাস পাঠ প্রসঙ্গে আলোচনা।
..................................
প্রসঙ্গত, আপনি যদি বইটি পড়ার ইচ্ছে পোষণ করে থাকেন তাহলে এই লেখা না পড়াই ভালো। মূল গল্পের অনেককিছুই এখানে বর্ণনা করা হয়েছে, ফলে বইটি পড়ার মজা হারাতে পারেন। যেহেতু এই বইয়ের বাংলা অনুবাদ নেই, তাই বাঙালি পাঠকদের বেশিরভাগেরই উপন্যাসটি পড়ার সুযোগ কম, তাই মূল গল্পটাও তুলে দিয়েছি। এছাড়া আপনার ধর্মানুভূতি প্রগাঢ় হলেও পড়ার দরকার নেই, যদিও এই লেখায় বা উপন্যাসেও লেখকের উপস্থাপনের কৌশলের জন্য ধর্মানুভূতিতে আঘাত করার মতো কিছু রয়েছে বলে আমার মনে হয়নি।
৫৪৬ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটি যদিও আমি মাত্র ছয় দিনে পড়ে শেষ করেছি, তবে এটি আমার পঠিত বইয়ের মধ্যে অন্যতম দুর্বোধ্য পাঠ তালিকায় স্থান পাবে। এর আগেও তিনবার পড়া শুরু করেছিলাম কিন্তু কোনোবারই ২০/৩০ পৃষ্ঠার বেশি আগাতে পারিনি। এর অন্যতম প্রধান কারণ সম্ভবত ভাষা এবং দ্বিতীয়ত গল্প বলার রুশদীয় ঢং। মূল গল্পে ঢোকার সামান্য ইঙ্গিত দিয়ে ক্রমাগত পিছনের ইতিহাসে চলে গিয়ে গল্পকে বেড়ি দিয়ে আটকানোর যে রুশদীয় কায়দা, সেটা দেখা যায় তাঁর ‘মিডনাইট’স চিলড্রেন’ উপন্যাসেও। এখানেই আটকে যান বেশিরভাগ পাঠক। আর তাঁর ভাষা তো সেইরকম সমৃদ্ধ - দুনিয়ার যত দুর্বোধ্য শব্দ আছে, তার হদিস মিলবে রুশদীর লেখায়।
লেখায় শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সালমান রুশদীর দুটো প্যাটার্ন আমার কাছে স্পষ্ট হয়েছে। প্রথমত, যেখানে যে-বিষয়ক শব্দ তিনি লেখা শুরু করেন, সেখানে ঐ বিষয়ক শব্দের চৌদ্দগুষ্ঠি নিয়ে আসেন। তখন তিনি কেবল ইংরেজি শব্দে সীমাবদ্ধ থাকেন না, হিন্দি-স্প্যানিশ-ইতালী-ফরাসি-জার্মান-ল্যাটিন-স্ক্যান্ডিনেভীয় বহুবিধ ভাষার শব্দ নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েন। এমনকি কখনো কখনো জাপানি-চাইনিজও বাদ রাখেন না।
দ্বিতীয়ত, তাঁর লেখায় রস আনার জন্য তিনি প্রায়শই শব্দ তৈরি করেন। সেটা হতে পারে হিন্দি শব্দের ইংরেজায়ন বা দুই-তিন-চার-পাঁচটা ছোটো শব্দকে একত্র করে লেখা। আমরা নেটিজেনরা যেভাবে ‘কী একটা অবস্থা’কে ‘কীয়েক্টাবস্থা’ লিখি। এছাড়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর বাক্য গঠন। একটা প্রশ্নবোধক বাক্যে ৫০/১০০/২০০ শব্দ চিন্তা করে দেখুন একবার।
আমার কাছে মনে হয় উপমহাদেশের বাইরের মানুষের পক্ষে রুশদীর লেখার রস সেইভাবে ধরা সম্ভব না, অন্তত আমার পড়া দুটো বইয়ের ক্ষেত্রে তো অবশ্যই। বাক্যের মধ্যে কোনোরকম ইঙ্গিত বা অর্থ উল্লেখ না করেই যেভাবে দেদারছে হিন্দি শব্দ ব্যবহার করে লেখায় রস ছড়িয়েছেন অন্য ভাষাভাষীর পক্ষে ধরা সত্যিই দুঃসাধ্য হওয়ার কথা। উদাহরণস্বরূপ, একটা বাক্য তিনি লিখেছেন এভাবে - Knocked me bilkul cold. স্যাটানিক ভার্সেসে দুটো বাংলা বাক্যও তিনি ব্যবহার করেছেন। ‘তিনি বেঁচে আছেন’- এটাকে ফোনেটিকে লিখেছেন - ‘Tini bénché achén’।
হ্যাঁ, মিডনাইট’স চিলড্রেন-এর মতো স্যাট্যানিক ভার্সেসও যাদু বাস্তবতায় (Magic Realism) লেখা। উদ্ভট গল্প দিয়ে বাস্তবতাকে প্রকাশ করার এই ধারার শুরু দক্ষিণ আমেরিকায় তা পাঠকমাত্রই জানেন। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ ও শহীদুল জহিরের ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’র জন্য বাঙালি পাঠকও এর সাথে পরিচিত। তবে আমার পড়া অন্যসব যাদুবাস্তবতায় লেখা বইয়ের থেকে স্যাটানিক ভার্সেস-এর পার্থক্য রুশদির সাহিত্যিক পাণ্ডিত্য প্রদর্শনে। উপন্যাসটিতে এত এত বেশি উদ্ধৃতি রয়েছে যে তা বলে শেষ করা যাবে না। পৃথিবীর প্রায় সকল অঞ্চলের পৌরাণিক চরিত্র, কাহিনী, বিখ্যাত লেখক, দার্শনিক, ইত্যাদির উদ্ধৃতি দিয়ে ভরে রেখেছেন বইয়ের এ মাথা থেকে ও মাথা। বাদ যায়নি বাঙালি লেখকগণও। সংক্ষেপে রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরে উপন্যাসের গল্প বর্ণনা করেছেন। রয়েছে নিরোদ সি চৌধুরী, বিভূতিভূষণসহ আরো কয়েকজন লেখকের নাম। লেখক ছাড়াও রয়েছে দুনিয়ার সিনেমা, টিভি সিরিজের নাম, পরিচালক, চরিত্র ও নায়ক-নায়িকার নাম, যার মধ্যে বাঙালি চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটকও রয়েছেন।
এবারে মূল গল্পে আসি। উপন্যাসে দুটো প্রধান চরিত্র রয়েছে - গিবরিল/জিবরিল ফারিশতা ও সালাউদ্দিন চামচাওয়ালা ওরফে সালাদিন চামচা। একজন বলিউডের হার্টথ্রব নায়ক, আরেকজন ইংল্যান্ডের কণ্ঠ অভিনেতা (কার্টুন, বিজ্ঞাপন, টিভি সিরিজ, সিনেমায় ব্যাকগ্রাউন্ড কণ্ঠ দেন)। সালাদিন চামচার নামটা দিয়েই বুঝানো হয়েছে যে সে আসলে ইংরেজ কালচারের চামচা; জন্মসূত্রে ভারতীয় হলেও ভারতের সবকিছু ঘৃণা করে এবং ইংরেজদের সবকিছু ভালোবাসে।
দুজনের পরিচয় উড়োজাহাজে। দুই সন্তানসহ পরকীয়া প্রেমিকার আত্মহত্যার পরে ফারিশতা ভারত থেকে পালাচ্ছে ইংল্যান্ডে তার প্রেমিকার কাছে, আর চামচা দেশে বাবার জীবন যাপন তথা ভারতীয় সংস্কৃতিকে ঘৃণা করে পরকীয়া প্রেমিকার কাছ থেকে পালাচ্ছে ইংল্যান্ডে তার ইংরেজ স্ত্রীর কাছে। প্লেন ছিনতাইয়ের কবলে পড়লে দেড় মাস তাদের একই প্লেনে অবস্থান করতে হয় এবং সেখানেই তাদের বন্ধুত্ব হয়। ইংলিশ চ্যানেলের ওপরে ৩০০০০ ফুট ওপরে ছিনতাইকারীরা প্লেনে গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটালে সবাই মরে গেলেও এই দুজন বেঁচে যায়। উপন্যাসের শুরু এখানে।
ফারিশতা একজন সিজোফ্রেনিয়ার রোগী। নামের জন্য হোক, আর যে কারণেই হোক, সে নিজেকে জিব্রাইল ফেরেশতা মনে করে, এবং জিব্রাইল যেভাবে মোহাম্মদের কাছে আয়াত নিয়ে হাজির হতো, সে স্বপ্নের মধ্যে বা তার সিজোফ্রেনিক ভিউতে দেখে যে সে নিজেই ফেরেশতা হিসেবে ‘কোন’ পর্বতে ‘মহুন্দ’ নামক নবীকে আয়াত দিচ্ছে। এই মহুন্দ নবীর জীবনী আসলে হুবহু নবী মোহাম্মদের জীবনী। পার্থক্য শুধু - এখানে মক্কা নামে নগরী নেই, নগরীটার নাম ‘জাহিলিয়া’ এবং মহুন্দ নবীর প্রচারিত ধর্মের নাম ‘সাবমিশন’। জমজম কুপসহ মোহাম্মদের সকল স্ত্রী, খালিদ, ওমরসহ সকল চরিত্র হুবহু একই আছে। সেই সাথে আছে জাহিলিয়ার সকল প্রাচীন দেব-দেবীগণ, যার মধ্যে অন্যতম মানাত, উজ্জা ও লাত নামক তিন দেবী, আরবীয় প্যাগানিজম ধর্মে যারা আসলে আল্লাহ দেবতারই তিন কন্যা। চলচ্চিত্র অভিনেতা জিবরিল ফারিশতা স্বপ্নে দেখে কিভাবে নবী মহুন্দ এই তিন দেবীকে স্বীকার করে আয়াত নাজিল করে এবং পরে তা শয়তানের আয়াত বলে প্রত্যাখ্যান করে।
উড়োজাহাজ থেকে ইংলিশ চ্যানেলে পতিত হয়ে সালাদিন চামচা পুলিশি নির্যাতনের স্বীকার হয় এবং পরবর্তীতে সে সত্যিকারের শয়তানে রূপান্তরিত হয় - তার দেহ থাকে মানুষের মতো কিন্তু সারা শরীরে ছাগলের মতো লোম জাগে, পায়ের পরিবর্তে খুর ও মাথায় দুটো শিং গজায় এবং শরীরে থেকে দুর্গন্ধ ছড়ায়। তার স্ত্রী তাকে গ্রহণ না করে চামচারই বাসায় আরেকজন নিয়ে বসবাস করে এবং চামচার আশ্রয় জোটে হাজি সুফিয়ানের পরিবারে, যিনি হাজি হলেও সেক্যুলার এবং ঢাকা থেকে লন্ডনে স্থায়ী হওয়া একজন অতিথিপরায়ন বাঙালি। একটা রেস্তোরা কাম আবাসিক বোর্ডিংয়ের মালিক। সেই মহাভারতে আর না যাই। তবে শুধু এটুকু বলি, চামচা সেই শয়তান রূপ থেকে পরবর্তীতে ফের মনুষ্যত্ব রূপ ফিরে পায়। তবে এর মাধ্যমে সে ইংরেজদের আসল রূপটাও চিনে ফেলে। যাদেরকে সে সবসময় ঘৃনা করতো, তার বিপদে আশ্রয় দিয়েছে ও সাহায্য করেছে সেই প্রবাসী সমাজই, তার আদর্শের ইংরেজ সমাজ তাকে বরং উল্টো দূরেই ঠেলে দিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে তার ইংরেজ স্ত্রীও।
এদিকে জিব্রিল ফারিশতা লন্ডনে তার প্রেমিকার কাছে সেবা সুশ্রুষা পেয়ে সুস্থ হলেও তার স্বপ্ন অব্যাহত থাকে। সে স্বপ্নে একগাদা ‘আয়েশা’কে দেখে। এর মধ্যে একজন আয়েশা প্রজাপতিখাদক। সেই আয়েশাও জিব্রাইলকে (ফারিশতা নয়, ফেরেশতা) স্বপ্নে দেখে এবং একদিন স্বপ্নে দেখা জিব্রাইলের কথামতো পুরো গ্রামবাসী নিয়ে হেঁটে মক্কায় রওয়ানা হয়। আয়েশার দাবি তাদের জন্য আরব সাগরের জল দুই ভাগ হয়ে যাবে এবং তারা হেঁটেই মক্কা চলে যেতে পারবে। সেখানে হিন্দু-মুসলিম সমস্যাসহ বহুবিধ ঘটনা ঘটে। পরবর্তীতে আরব সাগর থেকে তাদের লাশ ভেসে আসার খবর পাওয়া যায়, তবে প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি তারা দেখেছে আয়শা ও প্রায় একশর মতো গ্রামবাসী জলে নামলে আরব সাগরের জল দুই ভাগ হয়ে গিয়েছিল।
স্যাটানিক ভার্সেস উপন্যাসের সবচেয়ে বিতর্কিত পর্ব সম্ভবত ‘রিটার্ন টু জাহিলিয়া’। এখানে দেখা যায় বাল নামক কবি, যে একসময় মহুন্দ নবীর নবীত্বকে উপহাস করে কবিতা লিখত, মহুন্দ নবী জাহিলিয়ায় ফিরে এসে ৩৬০ দেবীর মন্দির ও মূর্তি ভেঙে তার ‘সাবমিশন’ নামক ধর্ম প্রচার শুরু করলে, সেই কবি বাল মহুন্দ নবীর বারো স্ত্রীর নামে পতিতালয়ে বারোজন পতিতার নাম রাখে। কবি বাল এতেই ক্ষান্ত হয় না, মহুন্দ নবীকে অনুসরণ করে সে এই বারো পতিতাকে বিয়েও করে এবং পালাক্রমে একেকজন একেকদিন তার ঘরে আসে। এতে দেখা যায় হঠাৎ করে পতিতা ব্যবসা খুব জমে ওঠে। তবে পরে মহুন্দ নবী পতিতা ব্যবসা তুলে দেয়; কবি বালের বারো পতিতা স্ত্রী আত্মহত্যা করে এবং কবিকে হত্যা করে মহুন্দ নবীর সহকারী খালিদ। এদিকে কবি বালের কাছে সালমান ফার্সি নামক নবীর প্রাক্তন সহকারী, যে নবীর আয়াত লিপিবদ্ধ করত, সে জানিয়ে যায় যে নবী আসলে নবী না, কারণ যদি নবী হতো, তাহলে সালমান ফার্সি যে আয়াতের মধ্যে নিজের মনগড়া শব্দ ঢুকিয়ে দিয়েছে, সেগুলো ধরতে পারত। এই পর্বে মহুন্দ নবীর মৃত্যু পর্যন্ত বর্ণিত হয়। তবে উপন্যাসের গল্পে এ সবের কোনোকিছুই আসলে বাস্তব ঘটনা নয়, বলিউড নায়ক জিব্রিল ফারিশতার স্বপ্নে দেখা ঘটনা।
তবে এরপরে ফারিশতা আর স্বপ্নে সীমাবদ্ধ থাকে না, এতদিন স্বপ্নে দেখলেও সিজোফ্রেনিয়া চরমে পৌঁছানোর ফলে এখন সে বাস্তবেই নিজেকে ফেরেশতা ভাবতে শুরু করেছে। সে লন্ডনকে ট্রপিকালাইজেশনের প্রজেক্ট নেয়, এজন্য প্রথমেই সে লন্ডনের বৃষ্টি মেঘ ও শীতে বিরক্ত হয়ে আবহাওয়া পরিবর্তন করে ফেলে, অথবা সে তাই ভাবে। গরমে অতীষ্ট হয়ে যায় লন্ডনবাসী। মার্গারেট থ্যাচারের ডানপন্থী রাজনীতির কারণে লন্ডনে তখন সাদা-কালো তথা ইংরেজ-অভিবাসীদের বিরোধ চরমে। খুনোখুনি, দাঙ্গা, ইত্যাদির মধ্যে ফারশিতা এবার নিজের ফেরেশতাসুলভ ক্যারামতি দেখাতে শুরু করে। নিজেকে সে কেবল জিব্রাইল ফেরেশতায় সীমাবদ্ধ রাখে না, দাঙ্গার মধ্যে সে শিঙ্গা হাতে নেমে যায় আজরাইল ফেরেশতা হয়ে। তার শিঙ্গার ফুঁতে ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে যায় (অন্তত সে তাই দেখে)।
একসময় সবকিছুরই অবসান হয়। ফারিশতা ও চামচা দুজনেই দেশে অর্থাৎ ভারতে ফিরে আসে। সেখানেও কিছু ঘটনা ঘটে। আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ হয়ে যায় সালাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ। সেটাতে ঘষা দিয়ে সালাদিন পায় তার প্রেমিকা জিনাত ভাকিলকে এবং জিব্রিল ফারিশতা পায় রিভলবার। তারপর যা হবার তাই হয়।
এই উপন্যাস ইস্যুতে মুসলমানদের ক্ষেপে যাওয়ার বিষয়টা বোধগম্য, কিন্তু খোমেনির এতটা ক্ষেপার কারণ কি উপন্যাসে তাঁর নাম উল্লেখ? তবে সেটা একটা ভালো কাজে, সিম্বা নামক এক লন্ডন প্রবাসী আফ্রিকানের গ্রেফতার ইস্যুতে খোমেনি প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন এমনটা বলা হয়েছে।
এক কথায় স্যাটানিক ভার্সেস একটি মহাকাব্যিক উপন্যাস। তবে সম্ভবত ইংরেজ এবং অইংরেজ দুই তরফের পাঠকের জন্যই এটি কিছুটা দুর্বোধ্য। প্রথমত এই বই পড়ার জন্য ভাষার সীমাবদ্ধতা রয়েছে দুই তরফ থেকেই। সেই সাথে এর রসবোধ ধরার জন্য প্রয়োজন রয়েছে একইসাথে ইসলামের ইতিহাস ও ভারতসহ বিবিধ অঞ্চলের পৌরাণিক জ্ঞান।
চামে নিজের একটু প্রচার করে নিই। স্যাটানিক ভার্সেস পড়তে গিয়ে আমার লেখা Black Ants and White Pigeons উপন্যাসের একটা মিল পেয়ে খুব ভালো লেগেছে। আমার উপন্যাসের প্রধান চরিত্র আজাদও একজন সিজোফ্রেনিক রোগী, সে সবখানে কালো পিঁপড়া দেখতে পায়, যেখানে কালো পিঁপড়া আসলে প্রতীকি - মেয়ের কাছে শোনা লাল (হিন্দু) পিঁপড়া ও কালো (মুসলিম) পিঁপড়ার গল্প থেকে আসা।
তবে উপন্যাসটার একটা ব্যাপার আমার কাছে খুব খটকা লেগেছে। উপন্যাসটা যাদুবাস্তবতায় লেখা হলেও সত্যিকারার্থে যাদুবাস্তবতার উপাদান খুব সামান্যই। বড় ধরনের উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায়ও মাঝে মাঝে দুয়েকজন বেঁচে যায়, তাই সেটাকে যাদুবাস্তবতায় না ফেলেও শুধু বাস্তবতা দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। যাদুবাস্তবতার একমাত্র উপাদানটুকু পাওয়া যায় কেবল সালাদিন চামচার শয়তানে রূপান্তরিত হওয়ার মধ্য দিয়ে। এখানে শয়তানের স্বর্গ থেকে পতনের তুলনাই নয় কেবল, আমার মতে এর মাধ্যমে লেখক সম্ভবত বুঝিয়েছেন যে চামচা বাইরে যতো ভালো মানুষের লেবাস ধরেই থাকুক, নিজের সমাজ সংস্কৃতি পরিচয় ভুলে গেলে মানুষ আসলে মানুষ থাকে না, শয়তানে রূপান্তরিত হয়ে যায়। একটি বিশেষ ধর্মের লোকদের অধিকাংশ যে নিজের জাতিসত্ত্বাকে অস্বীকার করে আরবীয় সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরতে চায়, এর মধ্যে তার ইঙ্গিত রয়েছে কিনা, সেটা অবশ্য তিনি স্পষ্ট করেননি।
মহুন্দ নবীর ঘটনাটাকে জিব্রিল ফারিশতার স্বপ্ন ও সিজোফ্রেনিয়ার চিত্রায়ন হিসেবে না দেখিয়ে বাস্তবে দেখালে উপন্যাসটা প্রকৃত অর্থেই যাদুবাস্তবতার উপন্যাস হতো। লেখক সম্ভবত ধর্মানুভূতিকে এড়াতে চেয়েই এখানে লুকোচুরির আশ্রয় নিয়েছেন। তবে তাতে যে তিনি পরিপূর্ণ রূপে ব্যর্থ হয়েছেন, তা আমরা সবাই জানি। এক্ষেত্রে আমি হুমায়ুন আজাদকে বেশি বুদ্ধিমান বলব - তাঁর ‘শুভব্রত ও তার সম্পর্কিত সুসমাচার’ উপন্যাসে হুবহু জীবনী তুলে ধরলেও এ নিয়ে কেউ টু শব্দটিও করেনি কেবল নামগুলোকে হিন্দুয়ানি করে দেয়ার ফলে।
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................