বাঙালি মুসলমান যেদিন মদ খায় তার পরবর্তী শুক্রবার জুম্মার নামাজ পড়তে সবার আগে ছুটে আর মুনাজাতে হুঁ হুঁ কাঁদে। কাজি নজরুল ইসলামকে বাঙালি মুসলমানের জাতীয় কবি বানানো সেই রকম অপরাধবোধ থেকে সৃষ্টি! রবীন্দ্রনাথের গানকে জাতীয় সংগীত বানানোর পর সেকি হিন্দু হয়ে গেলো কিনা, মুসলমান হিসেবে নিজেদের কিছু থাকলো কিনা সেই অস্বস্তি থেকেই নজরুল হলেন ‘জাতীয় কবি’। নজরুলকে মুসলমানদের মধ্যে বড় কবি ধরে এটা করা হয়েছে অনুমাণ করি। না হলে নজরুলের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অতি ক্ষীণ। নজরুলের সাহিত্যে এই বাংলার প্রকৃতি জীবনযাপন নেই বলতে গেলে। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প কবিতা ও গানে পূর্ববঙ্গের প্রভাব চোখ বুজে বলে দেয়া যায়। তবু ‘জাতীয় কবি’ এই অপশনটি যতই হাস্যকরই হোক তার যেহেতু প্রয়োগ আছে সেই নিরিখে বলা চলে, যদি বাংলাদেশে কারোর জাতীয় কবি হওয়ার কথা থাকে তিনি জীবনানন্দ দাশ। কেন?
জীবনানন্দ লিখেছেন-
“আমি যে দেখিতে চাই, -আমি যে বসিতে চাই বাংলার ঘাসে;
পৃথিবীর পথে ঘুরে বহুদিন অনেক বেদনা প্রাণে স’য়ে
ধানসিড়িটির সাথে বাংলার শ্মশানের দিকে যাব ব’য়ে,
যেইখানে এলোচুলে রামপ্রসাদের সেই শ্যামা আজো আসে,”
জীবনানন্দের এই বাংলা তো আহমদ ছফাদের বাংলা নয়। ছফাদের বাংলা হচ্ছে ‘বাঙালি মুসলমানের বাংলা’। সেই বাংলায় শ্যামা আর তার ভক্ত রামপ্রসাদের স্থান কোথায়? কারণ বাঙালি মুসলমান নিজেকে এক স্বাতন্ত্র জাতিসত্ত্বা বলে দাবী করেছে বাঙালি হিন্দুর সঙ্গে বিরোধীতা করে। বাঙালি মুসলমানের নিজস্বতা ঠিক কি সে বিষয়ে কোন ধারণা না থাকলেও বাংলার নদী ফুল জল মাঠ ঘাট থেকে শ্মশান শ্যামা রামপ্রসাদও বিতাড়িত হয়ে গেছে দেশেভাগের সঙ্গে সঙ্গে। বাংলা সাহিত্যে মুসলমানিত্ব আনাকেই বাঙালি মুসলমানের নিজস্বতা বলে কেউ কেউ দাবী করেছে। তাই জীবনানন্দও কোলকাতায় নির্বাসনে গিয়ে ফেলে আসা বাংলায় আবার কি সেই সুর বেজে উঠবে কিনা তেমন স্বগক্তি প্রশ্ন সুধায়-
“যেইখানে কল্কাপেড়ে শাড়ি প’রে কোনো এক সুন্দরীর শব
চন্দন চিতায় চড়ে- আমের শাখায় শুক ভুলে যায় কথা;
যেইখানে সবচেয়ে বেশি রূপ- সবচেয়ে গাঢ় বিষণ্নতা;
যেখানে শুকায় পদ্ম- বহু দিন বিশালাক্ষী যেখানে নীরব;
যেখানে একদিন শঙ্খমালা চন্দ্রমালা মানিকমালার
কাঁকন বাজিত, আহা, কোনদিন বাজিবে কি আর!”
সমস্যা হচ্ছে, জীবনানন্দ বা রবীন্দ্রনাথ তাদের কাউকে জাতীয় কবি বানালে আবহমান বাংলাকে মেনে নিতে হয়। যেখানে গাঙুড় নদীতে ভেলা ভাসিয়ে বেহুলা ইন্দ্রের সভায় পৌঁছে গিয়েছিলো। বেহুলা বাঙালি মুসলমানের কে হয়? এই প্রশ্নের মিমাংসা হয়নি বলেই বাঙালি মুসলমান কখনো তুর্কি কখনো সৌদিতে কিবলা করেছে। সে নৌকা ছেড়ে দিয়েছে মদিনার উদ্দেশ্যে। কিন্তু জীবনানন্দ দৃঢ় দ্বিধাহীনভাবে বলে গেছেন-
“তোমরা যেখানে সাধ চ’লে যাও- আমি এই বাংলার পারে
র’য়ে যাব; দেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে;
দেখিব খয়েরি ডানা শালিখের সন্ধ্যায় হিম হয়ে আসে
ধবল রোমের নিচে তাহার হলুদ ঠ্যাং ঘাসে অন্ধকারে
নেচে চলে- একবার- দুইবার- তারপর হঠাত তাহারে
বনের হিজল গাছ ডাক দিয়ে নিয়ে যায় হ্রদয়ের পাশে;
দেখিব মেয়েলি হাত সকরুণ- শাদা শাঁখা ধূসর বাতাসে
শঙ্খের মতো কাঁদে; সন্ধ্যায় দাঁড়াল সে পুকুরের ধারে,”
বাংলার রূপ-প্রকৃতির সঙ্গে জীবনানন্দের এত গাঢ় নিবিড় আলিঙ্গন তিনিই তো বাংলার ‘জাতীয় কবি’ হবেন! এক রবীন্দ্রনাখ তার ছিন্নপত্রে পূর্ববঙ্গে যে ছবি এঁকেছেন তার সমতুল্য শৈল্পিক তুলনা বাংলা ভাষা দ্বিতীয়টি কি পাওয়া সম্ভব? নজরুল ইসলাম আমাদের বাংলা সাহিত্যের এক নক্ষেত্রের নাম। রবীন্দ্র আলোতে যখন রাতের সমস্ত তারা মিলিয়ে যায় তখন নিজেকে আলাদা করে পরিচিত করাটা চাট্টিখানি কথা নয়। তিনি নমস্র। তাকে মুসলমান বানানোর হীন চেষ্টাকেই আমি আঘাত করেছি। যদি কেউ দাবী করেন নজরুলের বিদ্রোহী চরিত্রটিকেই বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে ধারণ করা হয়েছে- তাহলেও সে যুক্তি টেকে না। কারণ নজরুলের একটি ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ছাড়া তার সাহিত্যে বিদ্রোহের ছিটেফোটা নেই। তিনি প্রেমের কবি। যদি বিদ্রোহ খুঁজতে যান তো সুকান্তের কাছে যান! তার স্বল্ব কবি জীবনের ছত্রে ছত্রে বিদ্রোহ আর আগুন। তাঁকে তো জাতীয় কবি বানাননি!
-সুষুপ্ত পাঠক
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................