ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রের ইতিবৃত্ত।

ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রের ইতিবৃত্ত -

নতুন দিল্লি থেকে ১৬০ কিমি এবং চণ্ডীগড় থেকে ৯৩ কিমি দূরে অবস্থিত, হরিয়ানা রাজ্যের কুরুক্ষেত্র শহরটি 'ধর্মক্ষেত্র' ও 'ভগবৎ গীতার ভূমি' বলে পরিচিত। মহাভারত ও পুরানে বর্ণিত তথ্য অনুসারে, কুরু ও পাণ্ডবদের পূর্বপুরুষ রাজা কুরুর নাম অনুসারে এই স্থানের নাম হয় কুরুক্ষেত্র। মহাভারতে বর্ণিত কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ এই স্থানেই হয়েছিল এবং এখানেই শ্রী কৃষ্ণ, অর্জুন কে ভগবৎ গীতার ব্যাখ্যা করেছিলেন বলে বর্ণিত আছে। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময়, এই স্থানে কুরুক্ষেত্র নামে একটি রিফিউজি ক্যাম্প থাকার পূর্বে এই শহরের তহশীল ও প্রধান কার্য্যালয়ের নাম ছিল থানেশ্বর। থানেশ্বর বা স্থানেশ্বর, একটি ঐতিহাসিক শহর যেটি বর্তমানে নতুন গঠিত কুরুক্ষেত্র শহরের পাশেই অবস্থিত। থানেশ্বর শব্দটি এসেছে স্থানেশ্বর নামক শব্দটি থেকে যার অর্থ "ঈশ্বরের স্থান"। স্থানেশ্বর মহাদেব মন্দির, এই স্থানের অন্যতম প্রাচীন মন্দির। কুরুক্ষেত্র থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে আমিন নামক একটি গ্রাম আছে, যেখানে একটি প্রাচীন দুর্গের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। স্থানীয় মানুষের মতে সেটি অর্জুন পুত্র অভিমন্যুর দুর্গ ছিল।

বেশিরভাগ প্রাচীন হিন্দু গ্রন্থ অনুসারে, কুরুক্ষেত্র প্রাচীন কালে কোনও শহর বা জনপদ ছিল না। এটি ছিল একটি অঞ্চল। সংস্কৃত শব্দ "ক্ষেত্র" এর অর্থ অঞ্চল। ভৌগোলিক ভাবে কুরুক্ষেত্র অঞ্চলের সীমানা বর্তমান হরিয়ানা রাজ্যের মধ্য ও পশ্চিম অংশ এবং পাঞ্জাব রাজ্যের দক্ষিণ অংশের মধ্যে অবস্থিত। হাজার খ্ৰীস্টাব্দে রচিত তৈতরেয় আরণ্যক অনুসারে, কুরুক্ষেত্র অঞ্চল, তুর্ঘন (বর্তমানে পাঞ্জাব রাজ্যের সিরহিন্দ এর শ্রুঘ্ন/সুঘ) এর দক্ষিণ দিক, খণ্ডব (বর্তমানে দিল্লি ও মেরাট অঞ্চল) এর উত্তর দিক, মরু (মরুভূমি) এর পূর্ব দিক এবং পারিন (বর্তমান অঞ্চল চিহ্নিত করা সম্ভব হয় নি) এর পশ্চিম দিকের মধ্যে অবস্থিত ছিল।

পুরানে ও মহাভারতে লিখিত হয়েছে যে, ভারত বংশীয় রাজা, কুরু ও পাণ্ডবদের পূর্বপুরুষ কুরুর নাম অনুসারে এই স্থানের নাম হয়। বামন পুরানে বর্ণিত আছে যে কি ভাবে রাজা কুরু এই স্থানে এসে নিজের রাজত্ব স্থাপন করেন। পুরানে বর্ণিত আছে যে তিনি সরস্বতী নদীর তীর কে নিজের রাজত্ব স্থাপনের জন্য চিহ্নিত করেছিলেন। নদীটি খ্ৰীস্টিয় ১৯ শতকের পূর্বেই শুকিয়ে যায়। আটটি সদগুনের মাধ্যমে মোক্ষ লাভের জন্য, রাজা কুরু এই স্থান কে চিহ্নিত করেছিলেন। সেই আটটি সদগুন হল-
১) তপস
২) সত্য
৩) ক্ষমা
৪) দয়া
৫) শুদ্ধ
৬) দান
৭) যজ্ঞ
৮) ব্রহ্মচর্য।
শ্রী বিষ্ণু, রাজা কুরুর কর্মে খুশি হয়ে তাঁকে আশীর্বাদ করেছিলেন বলে কথিত আছে। বিষ্ণু তাঁকে দুটি বর প্রদান করেছিলেন। প্রথমটি হল, যুগ যুগ ধরে এই পবিত্র ভূমি তাঁর নামে পরিচিত হবে। দ্বিতীয়টি হল, এই পবিত্র স্থানে যার মৃত্যু হবে তাঁর স্বর্গ লাভ হবে।
মূলত কুরুক্ষেত্র স্থানটি দুটি নদীর তীরের মধ্যবর্তী অঞ্চল ছিল, সরস্বতী এবং দৃশ্যাদবতী। দুটি নদীই বর্তমানে শুকিয়ে গিয়েছে।
বিভিন্ন সময়ে, এই স্থান, উত্তরভেদী, ব্রহ্মভেদী, ধর্মক্ষেত্র, কুরুক্ষেত্র নামে পরিচিত হয়েছে। যখন রাজা কুরু এখানে আসেন তখন এই স্থানের নাম ছিল উত্তরভেদী।
মহাভারতের যুদ্ধ হয়েছিল কিনা তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, কিন্তু ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ প্রমান পেয়েছে যে মৌর্য্য বংশীয় সম্রাট অশোক এই স্থানকে সারা পৃথিবীর মানুষের জন্য একটি শিক্ষা লাভের স্থান রূপে গড়ে তুলেছিলেন। বর্ধন বংশীয় সম্রাট হর্ষবর্ধনের আমলে এই স্থান নিজের উন্নতির শীর্ষে পৌঁছেছিল। হর্ষবর্ধনের সময়ে চৈনিক পরিব্রাজক হিউ-এন-সাং এখানে এসেছিলেন।

এখানকার উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানগুলো হল -

১) ব্রহ্ম সরোবর - সোমবতী অমাবস্যায়, ও গ্রহণের দিন, প্রতি বছর লক্ষাধিক মানুষ এই সরোবরে স্নান করেন। বিশ্বাস যে এই সরোবরে বিশেষ দিনে স্নান করলে পুণ্য হয় ও জন্ম - মৃত্যু চক্র থেকে মানুষের মুক্তি ঘটে। এটি পৃথিবীর সর্ব বৃহৎ মনুষ্য নির্মিত সরোবর।

২) সন্নিহিত সরোবর - বিশ্বাস করা হয় যে এই সরোবরে সরস্বতী নদীর সাতটি পবিত্র ধারা এসে মিলিত হত। বিশ্বাস অনুসারে এই সরোবরের জল পবিত্র। কথিত যে, এই সরোবরে অমাবস্যায় ও গ্রহণের দিন স্নান করলে, অশ্বমেধ যজ্ঞের ন্যায় পুণ্য অর্জন করা যায়।

৩) জ্যোতিসায়র - পুরান ও মহাভারত অনুসারে, এই স্থানেই একটি বৃক্ষের নিচে শ্রী কৃষ্ণ, অর্জুন কে ভগবৎ গীতা শুনিয়েছিলেন। বর্তমানে সমগ্র স্থানটি নতুন করে গড়ে তোলা হচ্ছে। বৃক্ষের নিচে অর্জুনের রথ ও তাঁকে গীতা শোনানোরত শ্রী কৃষ্ণের, কাঁচের ঘেরাটোপে অবস্থিত একটি শ্বেত পাথরের স্থাপত্য রয়েছে।

৪) কুরুক্ষেত্র প্যানোরোমা এন্ড সায়েন্স সেন্টার - এটি একটি অডিও ভিজুয়াল মিউজিয়াম। কুরুক্ষেত্রের কাহিনী ও বিষয় বর্ণিত হয়েছে। দেখতে বেশ ভালো লাগে। টিকিট কেটে ঢুকতে হয়। টিকিটের মূল্য ত্রিশ টাকা। ভিতরে ক্যামেরা ও মোবাইলের ব্যবহার নিষিদ্ধ।

৫) ধারোহর মিউজিয়াম - কুরুক্ষেত্র বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে অবস্থিত। হরিয়ানার লোক ও সমাজ বিষয় নিয়ে মিউজিয়ামটি তৈরি। টিকিট কেটে ঢুকতে হয়। টিকিট মূল্য ৩০ টাকা। ভিতরে মোবাইল ও ক্যামেরা নিষিদ্ধ।

৬) স্থানেশ্বর মহাদেব মন্দির - এটি দর্শন ছাড়া কুরুক্ষেত্র তীর্থ অসম্পূর্ণ বলে ধরা হয়। মন্দিরের সংলগ্ন সরোবরে স্নান করলে কুষ্ঠ রোগ সেরে যায় বলে বিশ্বাস প্রচলিত আছে। রাজা কুরুর সাথে যুদ্ধে বহু ক্ষত্রিয় এই স্থানে পরাজিত ও নিহত হয়েছিলেন বলে পুরানে বর্ণিত আছে। মন্দিরের ভিতরে বিনা অনুমতিতে ছবি তোলা নিষেধ এবং ধরা পড়লে জরিমানা করা হয়।

৭) সুফি শেইখ চিল্লির সমাধি - মুঘল আমলে নির্মিত শেইখ চিল্লির সমাধি এখানকার অন্যতম প্রধান দর্শনীয় স্থান। সুফি শেইখ চিল্লি ছিলেন, মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের ভ্ৰাতা, শাহজাহানের জ্যেষ্ঠ পুত্র দারার গুরু। দারা কে হত্যা করে ঔরঙ্গজেব সিংহাসনের দখল নেন। সকল সম্প্রদায়ের মানুষ এই স্থানে দর্শনে আসেন।

৮) কুমির প্রজনন ক্ষেত্র - এখানে কুমিরের প্রজনন ঘটানো হয় ও সেগুলি কে বিভিন্ন অভয়ারণ্যে ও সংরক্ষিত অরণ্যে সরবরাহ করা হয়।

৯) ছিলছিলা অভয়ারণ্য।

১০) সরস্বতী অভয়ারণ্য।

১১) কল্পনা চাওলা তারামণ্ডল - ব্রহ্ম সরোবর ও জ্যোতিসায়রের মাঝখানে এটি অবস্থিত। ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রথম মহিলা মহাকাশচারীনী কল্পনা চাওলার স্মৃতিতে হরিয়ানা সরকার এটি নির্মাণ করিয়েছেন।

সমগ্র শহরটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। বহু মন্দির ও গুরুদ্বারা এখানে রয়েছে। তীর্থক্ষেত্র হবার জন্য এটি নিরামিষ অঞ্চল। বর্তমানে সমগ্র শহর কে সুন্দর ভাবে সাজিয়ে চলার কাজ চলছে। বলা হয় গোটা কুরুক্ষেত্র জুড়েই যুদ্ধ হয়েছিল। বিশেষ কিছু স্থান চিহ্নিত করা আছে যেখানে যুদ্ধ সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে স্নারক হিসাবে স্থাপত্য ও মন্দির রয়েছে। এখানে প্লাস্টিক নিষিদ্ধ নয়। তবে এই স্থান পরিবেশ বান্ধব। শীত ও বসন্তে বহু পরিযায়ী পাখি এখানকার সরোবরে আসে। পাখি শিকার এখানে সম্পুর্ন ভাবে নিষিদ্ধ। সংগৃহীত।

(সহায়ক গ্রন্থ: Mahabharata, the epic of ancient India by Romesh Chunder Dutt.)

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted