উপনয়ন ও যজ্ঞোপবীত

উপনয়ন ও যজ্ঞোপবীত

উপনয়ন
‘উপনয়ন’ শব্দের অর্থ ‘নিকটে নিয়ে যাওয়া’। যে অনুষ্ঠানের পর ছাত্রকে বিদ্যাশিক্ষার জন্য গুরুর নিকটে নিয়ে যাওয়া হতো তার নাম ‘উপনয়ন’। উপনয়ন শব্দের সহজ অর্থ যজ্ঞপবীত বা পৈতা ধারণ।

উপ = নিকটে, নয়ন = চোখ। উপনয়ন একটি হিন্দু শাস্ত্রানুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে হিন্দু বালকেরা ব্রাহ্মণ্য সংস্কারে দীক্ষিত হয়। হিন্দু ঐতিহ্য অনুসারে, উপনয়ন হিন্দু বালকদের শিক্ষারম্ভকালীন একটি অনুষ্ঠান বা বৈদিক শিক্ষাদীক্ষা আরম্ভকালীন একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সনাতন ধর্মাবলম্বী বালকেরা গায়ত্রী মন্ত্র সংস্কারে দীক্ষিত হয়। শাস্ত্র অনুযায়ী বালক-বালিকা উভয়ই উপনয়ন গ্রহণ করতে পারে, যা পরবর্তীতে দেখেতে পাবো।

হিন্দুধর্মে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য বর্ণের জন্য উপনয়নের ন্যূনতম বয়স যথাক্রমে সাত, তেরো ও সতেরো বছর। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে বয়স সীমা ১৮, ২১ ও ২৪ বছর। উপনয়নকালে বালকদের ব্রহ্মোপদেশ শিক্ষা দেওয়া হয়। মনুস্মৃতি অনুযায়ী, এরপর তারা ব্রহ্মচারী হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। আপস্তম্ব গৃহসূত্র (১.১.১.২৭) মতে, উপনয়ন ও বিদ্যারম্ভের সর্বোচ্চ বয়স ২৪ হলেও, গৌতম গৃহসূত্র এবং অন্যান্য প্রাচীন শাস্ত্র বয়সের ক্ষেত্রে কোন সময়সীমা রাখছে না। অর্থাৎ যেকোনো বয়সেই উপনয়ন নেওয়ার বিধান রয়েছে। তাদের মতে, "There is no age restriction and anyone of any age can undertake Upanayanam when they feel they initiate their formal studies of the Vedas."

বাঙালি হিন্দু সমাজে অবশ্য কেবলমাত্র ব্রাহ্মণদের ক্ষেত্রেই উপনয়ন সংস্কার প্রচলিত। উপনয়ন অনুষ্ঠানে শরীরে যজ্ঞোপবীত বা উপবীত (চলিত বাংলায় পৈতে) ধারণ করা হয়। উপবীত প্রকৃতপক্ষে তিনটি পবিত্র সুতো যা দেবী সরস্বতী, গায়ত্রী ও সাবিত্রীর প্রতীক। উপবীত ধারণের সময় উপবীতধারী গায়ত্রী মন্ত্র শিক্ষা করে।

উপনয়নের পর ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের দ্বিজ বলা হয়, দ্বিজ শব্দের অর্থ দুইবার জাত। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, প্রথমবার ব্যক্তির জন্ম হয় মাতৃগর্ভ থেকে এবং দ্বিতীয়বার জন্ম হয় উপবীত ধারণ করে। ভগবানকে পাওয়ার জন্য যে জ্ঞান, সেই জ্ঞান অর্জনের জন্য গায়ত্রীমন্ত্র সাধনের অধিকার লাভ করবার অনুষ্ঠানকে উপনয়ন বলে৷ আয়ুর্বেদিক ব্রাহ্মণ যখন অধ্যয়ন ও ব্রহ্মচর্য শেষ করে ‘বৈদ্য’ জীবনে প্রবেশ করে তখন আরেকবার উপনয়ন করে এবং ত্রিজ হয়, এই উপনয়ন বিবাহের সময় হয়ে থাকে। প্রাচীনকালে উপনয়ন সংস্কার পশ্চাৎ কুলগুরু ও আচার্য ব্রহ্মচারী বালকদের গুরুকুলে নিয়ে যেতেন এবং পরিবারের পরম্পরা অনুযায়ী বালকদেরকে কোন এক বেদের কোন এক নির্দিষ্ট শাখার সহস্বর শিক্ষা দেওয়া হত। তার সাথে বিভিন্ন শাস্ত্রীয় শিক্ষা দেওয়া হত। ভারতের বিভিন্ন বহির্গত আক্রমণকারীদের শাসনকালে গুরুকুল ও গুরুশিষ্য পরম্পরা বিনষ্ট হয়ে যায়। ফলস্বরূপ বহু জ্ঞান লুপ্তপ্রায় হয়ে যায়, যার কারণে সমাজে বহু ভুল ধারণাদি ভর করে।

যজ্ঞোপবীতের/পৈতার একেকটি সূত্রে এক-একজন দেবতা আছেন, ১ম তন্তুতে ওঁকার, ২য় তন্তুতে অগ্নি, ৩য় তন্তুতে অনন্তনাগ, ৪র্থ তন্তুতে চন্দ্র, ৫ম তন্তুতে পিতৃগণ, ৬ষ্ঠ তন্তুতে প্রজাপতি, ৭ম তন্তুতে বসুগন, ৮ম তন্তুতে যক্ষ এবং ৯ম তন্তুতে শংকর৷

এই যজ্ঞোপবীতের/পৈতার ঊৎপত্তি সম্বন্ধে গৃহ্যাসংগ্রহে বর্ণিত আছে।
“ব্রহ্মেণোৎপাদিতং সূত্রং বিষ্ণুনা ত্রিগুণীকৃতম্।
রুদ্রেণ তু কৃতো গ্রন্থিঃ সাবিত্রায়াচাভিমন্ত্রিতম্.”
অর্থাৎ ব্রহ্মা সূত্র প্রস্তুত করেন, বিষ্ণু ৩ দণ্ডী করেন, রুদ্র গ্রন্থি দেন ও সাবিত্রী মন্ত্র পূত করেন৷

মনুষ্যদেহ ৯ দ্বার যুক্ত - ২ চোখ, ২ কান, ২ নাক, মুখ, লিঙ্গ ও পায়ু এই ৯ দ্বার দিয়েই আমাদের শরীরে পাপ প্রবেশ করে। এই নবদ্বার বন্ধ করার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি স্বরূপ ৯ টি তন্তু সমৃ্দ্ধ যজ্ঞোপবীত বা পৈতা৷ যজ্ঞোপবীতে ৩টি গিঁট বা ‘ব্রহ্ম গ্রন্থি’ থাকে। এই সূত্রত্রয় কর্তব্যপরায়ণ মানুষকে তিনটি ঋণের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সেই ঋণত্রয় হল: ১) দেব-ঋণ, ২) পিতৃ ঋণ এবং ৩) ঋষি-ঋণ।

যজ্ঞোপবীত
যজ্ঞোপবীত বা পৈতার অপরনাম প্রতিজ্ঞাসূত্র বা ব্রতসূত্র। নির্দিষ্ট বয়সের ভেতর প্রতিটি সনাতন ধর্মালম্বীর উপনয়ন আবশ্যক এবং উপনয়নের মাধ্যমে এই পবিত্র সুত্রটি সে গুরুকর্তৃক প্রাপ্ত হয়। যদিও বর্তমানে পুরুষশাসিত ঘুণে ধরা সমাজ নারীদের থেকে এই অধিকার কেড়ে নিয়ে বেদের বিরুদ্ধাচরণ করছে।

প্রতিটি পৈতা তিনটি আলাদা সূত্রকে গিট দিয়ে বেঁধে তৈরী। এই গিট বা বন্ধনকে ব্রহ্মগ্রন্থি বা ঈশ্বর কর্তৃক প্রদত্ত গ্রন্থি বলা হয়। এই তিনটি সূত্র ঈশ্বর কর্তৃক নির্দেশিত প্রতিটি মানুষের তিনটি ব্রত বা ঋণ বা দায়িত্বের প্রতীক। কী সেই তিনটি ঋণ, যা প্রত্যেকটি মানুষকে শোধ করতে হয়?
“আচার্য ব্রহ্মচারীকে উপনয়ন দিয়া নিজের সাহচর্যে রাখেন। আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক ও আধিদৈবিক এই তিন অবিদ্যা অন্ধকার দূর করিতে নিজের বিদ্যার বেষ্টনীর মধ্যে তাহাকে ধারণ করেন। যখন ব্রহ্মচারী বিদ্যালাভ করিয়া দ্বিতীয় জন্ম লাভ করে তখন তাহাকে দেখিবার জন্য সব দিক হইতে বিদ্বানেরা আসিয়া সমবেত হন।” (অথর্ববেদ ১১/৫/৩)
এই তিনসূত্র পরিধান করতে হয় জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য জানতে। যে ব্যক্তি যজ্ঞোপবীত ধারণ করেন তিনি গুরুর কাছে এটা অবগত হন যে, তিনটি ঋণ তার শোধ করতে হবে- দেব, পিতৃ ও ঋষি। (ঋগ্বেদ ৯/৮৬/৩)

যজ্ঞোপবীত সনাতনীদের কেন ধারণ করা উচিৎ?

ওঁ যজ্ঞোপবীতং পরমং পবিত্রং প্রজাপতের্যৎ সহজং পুরস্তাত্।
আয়ুষ্যমগ্রয়ং প্রতিমুঞ্চ শুভ্রং যজ্ঞোপবীতং বলমস্ত তেজঃ।।১।।
ওঁ যজ্ঞোপবীতমসি যজ্ঞস্য ত্বা যজ্ঞোপবীতেনোপনহ্যামি।।২।। (পারস্কর কান্ড ২। কন্ডিকা ২। সূত্র ১১)
অর্থাৎ যজ্ঞোপবীত পরম পবিত্র, প্রজাপতি হতেই এর উদ্ভিব, এই শুভ্র পবিত্র সূত্র আয়ু, বল ও গৌরবের বর্ধক।

যজ্ঞোপবীত ধারণ না করলে সনাতনীদের ক্ষতি কি?

ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুদ্রের উপনয়ন সংস্কার হওয়া অতি আবশ্যক, কেননা উপনয়ন সংস্কার না হলে মানুষ বৈদিক কর্মকান্ডে অধিকারী হয় না। উপবীতহীন ব্যক্তি মন্ত্রপাঠ এবং বৈদিক ক্রিয়া করবার যোগ্য নয়। এই অধিকার প্রাপ্ত হেতু যজ্ঞপবীত ধারণ করানো হয়।

যজুর্বেদে বলা হয়েছে – “তদেতৎ সর্বমাপ্নোতি যজ্ঞে শ্রোত্রামণি সুতে” (যজুর্বেদ ১৯.৩১)
অর্থাৎ গ্রন্থিযুক্ত যজ্ঞোপবীত সূত্র ধারণ করিয়া যজ্ঞ করলে যজ্ঞের সম্পূর্ণ ফল পাওয়া যায়।

যজ্ঞোপবীত বা প্রতিটি পৈতা তিনটি আলাদা সূত্রকে গিট দিয়ে বেঁধে তৈরী। এই গিট বা বন্ধনকে ব্রহ্মগ্রন্থি বা ঈশ্বর কর্তৃক প্রদত্ত গ্রন্থি বলা হয়। এই তিনটি সূত্র ঈশ্বর কর্তৃক নির্দেশিত প্রতিটি মানুষের তিনটি ব্রত বা ঋণ বা দায়িত্বের প্রতীক। কি সেই তিনটি ঋণ যা প্রত্যেকটি মানুষকে শোধ করতে হয়। সেগুলো হচ্ছে দেবঋণ, পিতৃঋণ ও ঋষিঋণ।

১) দেবঋণ- ঈশ্বর কর্তৃক প্রদত্ত আমাদের বেঁচে থাকার অপরিহার্য এ পৃথিবী, পরিবেশ ও প্রাণীকুলের প্রতি দায়িত্ব। পৃথিবীকে সুন্দর করে গড়ে তোলা, পরিবেশ শুদ্ধ করা ও জীব সেবা করা দেবঋণের অন্তর্গত।

২) পিতৃঋণ- পিতামাতার প্রতি ঋণ। নিঃস্বার্থভাবে এই দুই জীবন্ত দেবতা আমাদের মানুষ করেন, তাদের যথাসাধ্য সেবাযত্ন করা আমাদের কর্তব্য।

৩) ঋষিঋণ- প্রাচীন বৈদিক ঋষিগণ থেকে শুরু করে নিজের গুরু-শিক্ষক, এরাই আমাদের প্রকৃত মানুষ করে গড়ে তোলেন। এদের সেবা, অনুস্মরণ করা-ই ঋষিঋণ।

পঞ্চগিট- যজ্ঞোপবীত বা পৈতাতে মোট পাঁচটি গিট থাকে। এই পাঁচটি গিট উপরোক্ত ঋণসমূহ পরিশোধে পাঁচটি বাঁধার কথাকে স্মরণ করিয়ে দেয়-কাম, ক্রোধ, লোভ, হিংসা ও মোহ। 

অবস্থান- যজ্ঞোপবীত বাঁম কাধ থেকে ঝুলিয়ে ডান দিকের কোমর পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে কেননা এতে সূত্রটি ঠিক হৃদপিন্ডের উপর দিয়ে যায়, যার মাধ্যমে প্রতীকিভাবে বোঝানো হয় নিজের দায়িত্বগুলো হৃদয় থেকে পালন করতে।

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted