মাকে অস্বীকার করলে, সন্তান পরিচয়হীন হয়।

মাকে অস্বীকার করলে,
সন্তান পরিচয়হীন হয়

বাঙালির সমষ্টিগত ভাব দর্শনের অন্যতম প্রাণপুরুষ লালন সাঁই (১৭৭২-১৭ অক্টোবর, ১৮৯০)।  লালন সাঁই তাঁর একটি বিখ্যাত গানে খুবই তীর্যক ভাষায় বলেছেন, জন্মদাতা বাপের ঠিকানা পেতে হলে আগে মাকে ভজনা করতে হবে। সন্তান মায়ের শরণ নিলে, জন্মদায়িনী মাতাই তবে সন্তানকে পিতার পরিচয় এবং ঠিকানা প্রদান করবে। কিন্তু কোন সন্তান যদি অকৃতজ্ঞতার অন্ধকার  সমুদ্রে ডুবে, জন্মদাত্রী মাতাকেই অস্বীকার করে ফেলে তবে মায়ের ক্ষতি হয় না। সন্তানই পিতৃপরিচয়হীন হয়ে সমাজ সংসারে নিন্দিত হয়ে যায়।

"নিগম বিচারে সত্য গেলো জানা
মায়েরে ভজিলে হয় তার বাপের ঠিকানা।।"

এ দেশ, আবহমান সহস্র সহস্র বছরের এ সংস্কৃতি সকলই আমাদের জন্মদাত্রী জননীর মত।এ জন্মভূমিরূপ জননীকে যদি আমরা ভালোবাসতে না পারি। তবে জননী স্নেহের আঁচল বিছিয়ে সন্তানবাৎসল্যে কি করে তাঁর কোলে আমাদের তুলে নিবেন? তাই জন্মদাত্রী মায়ের মত জন্মভূমি এবং জন্মভূমির শাশ্বত সংস্কৃতি রূপ মাকেও সমানভাবে ভালোবাসতে হবে। বিভিন্ন কবিরা বিভিন্ন সময়ে দেশমাতৃকাকে আমৃত্যু প্রাণ দিয়ে ভালোবাসার কথা বলে গিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত (৭ মে, ১৮৬১-৭ আগস্ট ১৯৪১) আমাদের জাতীয় সংগীতেও এক স্নিগ্ধ ভাষায়  দেশমাতৃকাকে ভালবাসার কথা বলা হয়েছে। বিভিন্ন কবিদের পরম্পরায় আধুনিক বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান কবি জীবনানন্দ দাশ (১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৯-২২ অক্টোবর, ১৯৫৪) তাঁর একটি কবিতায় , বাংলার মায়ের সৌন্দর্যমণ্ডিত অপরূপ রূপের বর্ণনা করেছেন। তিনি সেই অপরূপ রূপের মাঝেই পৃথিবীর সকল রূপ এবং সৌন্দর্যকে দেখতে পেয়েছেন।তাই তিনি পৃথিবীর রূপ সৌন্দর্য খুঁজতে কোথাও আর যান না। তিনি মাতৃভূমি বাংলার রূপের মাঝেই আত্মহারা হয়ে পৃথিবীকে দেখতে পান।


"বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, 
তাই আমি পৃথিবীর রূপ
খুঁজিতে যাই না আর :"

সবার আগে প্রিয় স্বদেশ, বিষয়টি দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা অনেকেই ভুলে যাই। নিজস্ব বিশ্বাস এবং নিজস্ব ভালো লাগা এবং মন্দ লাগাকেই  আমরা আসেপাশের মানুষের উপরে চাপিয়ে দিতে চাই। সেকারণেই বিভিন্ন বিড়ম্বনার উৎপত্তি হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে মানুষের পারস্পরিক সম্প্রতি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ধীরেধীরে চিন্তার সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ হয়ে যাচ্ছে।বাঙালির পরিচয় শুধুই তাঁর ভাষাতেই সীমাবদ্ধ নয়; আবহমান সমৃদ্ধ সংস্কৃতির সে উত্তরাধিকারী। এ সমৃদ্ধ সংস্কৃতি হাজার বছর ধরে সুন্দরবনের মধুর মৌচাকের মত, অসংখ্য মৌমাছির বিন্দু বিন্দু মাধুকরী বৃত্তিতে গড়ে উঠা। এই শাশ্বত সংস্কৃতির কিছুই পরিত্যজ্য নয়। হাজার হাজার বছরের পথরেখায় সে এ এমন মূর্তিমান রূপ লাভ করেছে। বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী তুর্কি, পাঠান এবং ইউরোপীয়দের শাসনামলে তাদের রাজশক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় এ ভূখণ্ডের অনেকেই ধর্মান্তরিত হয়েছে বা হতে বাধ্য হয়েছে । ধর্মান্তরিত হলেও এই ভূখণ্ডের মানুষদের সর্বদা মনে রাখা প্রয়োজন। ধর্ম যার যার আলাদা আছে এবং থাকবে; কিন্তু আমাদের ধর্মীয় পরিচয়ের পূর্বে আমাদের সমষ্টিগত একটি শাশ্বত পরিচয় আছে। সে শাশ্বত সাংস্কৃতিক গৌরবের পরিচয়টি  হলো- আমরা বাঙালি। এ বাঙালি জাতীয়তাবাদ আমাদের সংবিধানের চারটি মূলনীতির অন্যতম। তাই রাষ্ট্রীয় মূলনীতির চারটি মূলস্তম্ভকে অস্বীকার করার কোন সুযোগ দেশে বসবাসরত কোন নাগরিকের নেই। বাঙালি জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের নবম অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, "ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্তাবিশিষ্ট যে বাঙালী জাতি ঐক্যবদ্ধ ও সংকল্পবদ্ধ সংগ্রাম করিয়া জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করিয়াছেন, সেই বাঙালী জাতির ঐক্য ও সংহতি হইবে বাঙালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তি।"

অনেকেই ইদানীং নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাসের দোহাই দিয়ে বাঙালির বছরের প্রথম দিন নববর্ষ, কৃষকের খেতের নতুন ধানের উৎসব নবান্ন, ঋতু ভিত্তিক বিভিন্ন সার্বজনীন অনুষ্ঠান সহ অধিকাংশ অসাম্প্রদায়িক সার্বজনীন উৎসবের বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছে। এই সকল সংকীর্ণ মানসিকতার  ব্যক্তিরা বাঙালি হয়ে বাংলা ভাষায় সন্তানের নামকরণ নিজেরা তো করবে না, অন্যদের করতে দেখলেও তাদের গায়ে জ্বালাপোড়া শুরু হয়ে যায়। বাঙালি হয়ে এদেশীয় শাশ্বত সংস্কৃতির অধিকাংশ উপাদানই তাদের ভাষায় 'হিন্দুয়ানী'। তাই এগুলোকে বিদায় করতে হবে, এমন তাদের মানসিকতা। এদের কারণে বাঙালি সংস্কৃতির বৈচিত্র্যময় বিভিন্ন রঙের ফুলগুলো ধীরেধীরে বিবর্ণ হয়ে এক অনিশ্চিত গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাচ্ছে। বাঙালি সংস্কৃতি বিরোধী দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল এ মানুষগুলোই ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিলো।পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সাহায্য সহযোগিতা করেছিলো। এরা নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থে সকল কিছুই করতে পারে। সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষদের ব্যক্তিস্বার্থে, সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে প্ররোচিত করে তাদের প্রতারিত করে।ধর্মের রাজনৈতিক মুখোশ পরে দেশ এবং বাঙালিজাতি বিরোধী অবস্থান তারা যুগে যুগে নিয়েছ,  যা ইতিহাস সাক্ষ দেয়। সেই ধারাবাহিকতায় আজও তারা সক্রিয়। সংগীত, নৃত্য, যাত্রা, নাটক পালাগান সহ বাঙালির সাংস্কৃতিক সকল বিষয়ই এ অন্ধদের কাছে দৃষ্টিকটু এবং অসহ্য। তারা জানে, যতদিন বাঙালির এ সাংস্কৃতিক গৌরব চলমান থাকবে, ততদিনই বাঙালি সংস্কৃতিকে তারা ধ্বংসস্তুপে পরিণত করতে পারবে না। বাঙালিকে ধ্বংস করতে হলে আগে তার শাশ্বত সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে হবে। তারা চায় সুজলা, সুফলা, শস্য, শ্যামলা এ ভূখণ্ড কণ্টকাকীর্ণ মরুভূমি হয়ে উঠুক। কারণ মরুভূমির ধুধু রুক্ষ বালি তাদের খুব পছন্দের। 

তবে এ কথাও সত্য যে, এ ভূমি কখনই কোন বিদেশি সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করেনি এবং আগামীতে করবেও না।এদেশের মানুষের স্বভাব বেতগাছের মত, 'বেতসবৃত্তি'। বেতগাছ যেমন ঝড়-ঝঞ্জাট দেখলে মাটিতে নুয়ে পড়ে নিজেকে আগে রক্ষা করে। পরবর্তীতে যখন ঝড়-ঝঞ্জাট চলে যায় তখন সে আবার সগৌরবে মাথা তুলে দাঁড়ায়।তেমনি পশ্চাদগামী মৌলবাদীদের আপাতদৃষ্টিতে যতই আস্ফালন করুক না কেন, এরা কখনই বেড়ে সর্বোচ্চ সীমানায় পৌঁছতে পারে না। এর দৃষ্টান্ত আমরা ১৯৭১ সাল পরবর্তী গত পঞ্চাশবছরে অসংখ্যবার দেখেছি। তাই ভয়ের কিছুই নেই নির্ভীক মনোভাব নিয়ে শুধুই প্রতিরোধ করলেও হলো। মধ্যযুগে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে জন্ম নেয়া কবি হাকিমও, তাঁর কবিতায় নিজ সংস্কৃতির বিরুদ্ধ আচরণকারীদের প্রতি তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে গিয়েছেন। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে জন্ম নেয়া আব্দুল হাকিমের সময়কাল হলো, আনুমানিক ১৬২০-১৬৯০ খ্রিস্টাব্দ। ধর্ম ভিত্তিক কাব্যচর্চা করলেও কবি আবদুল হাকিমের মাতৃভাষা এবং সংস্কৃতির প্রতি প্রেম ছিলো অতুলনীয়। তাঁর রচিত 'নূরনামা' গ্রন্থের বাংলা ভাষা প্রসঙ্গে কয়েকটি পঙক্তি আজও বাঙালি ঘরে ঘরে প্রবাদবাক্যের মতই ব্যবহৃত হয়।সৃষ্টিকর্তার কোন নিজস্ব ভাষা নেই। জগতের সকল ভাষাই তাঁর সৃষ্টি এবং তিনি সকল ভাষাই বুঝতে পারেন এবং সকল ভাষাই ভালোবাসেন। তাই কোন ভাষার প্রতি তুচ্ছতাচ্ছিল্য বা হিংসা-বিদ্বেষ করা সমুচিত নয়।  বঙ্গভূমিতে জন্মগ্রহণ করে বাংলা অক্ষর এবং বাংলা ভাষাকে মনেপ্রাণে ভালো  না বেসে যারা  সর্বদা বিদ্বেষ করে বেড়ায় কবি আবদুল হাকিম যে সকল অধম ব্যক্তিদের জন্ম নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। কবি আরও উপদেশ দিয়েছেন, পুরুষানুক্রমে মাতৃভূমি বসবাস করেও  মাতৃভাষার প্রতি যাদের প্রেম নেই, তারা যেন মাতৃভূমি পরিত্যাগ করে চলে যায়। তাদের এ ভূখণ্ডে থাকার কোন প্রয়োজন নেই।

"যেই দেশে যেই বাক্যে কহে নরগণ। 
সেই বাক্য বুঝে প্রভু আপে নিরঞ্জন।। 
সর্ববাক্য বুঝে প্রভু কিবা হিন্দুয়ানী।
বঙ্গদেশী বাক্য কিবা যত ইতি বাণী।।
মারফত ভেদে যার নাহিক গমন। 
হিন্দুর অক্ষর হিংসে সে সবের গণ।। 
যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।। 
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়।
নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশ ন যায়।।
মাতা পিতামহ ক্রমে বঙ্গেত বসতি।
দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি।।"

আজ এ ভূখণ্ডের সন্তান হয়েও দেশমাতৃকাকেই অস্বীকার করে, অসম্মান করে বিদেশি সংস্কৃতির স্বপ্নে কিছু মানুষ বিভোর। তারা বাংলা মায়ের সন্তান হলেও সন্তান নামের কুলাঙ্গার।সন্তান তার জন্মদায়িনী মাকে অস্বীকার করলে, মায়ের যেমন কিছুই আসে যায় না। পক্ষান্তরে সেই কুলাঙ্গার সন্তানই নিজেই আত্মপরিচয়ের সংকটে পরে সামাজিক মর্যাদা হারায়। সমাজ পিতৃপরিচয়হীন সন্তানকে খুব একটি সুনজরে দেখে না। মাতৃরূপা এদেশীয় সংস্কৃতিকে অস্বীকার করে ঠিক এ কাজটিই করছে এদেশের সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তি। এই মৌলবাদীরা যুগে যুগে ছিলো এবং আগামীতেও থাকবে। কারণ এরা না থাকলে, সাধারণ মানুষ ভালো মন্দের পার্থক্য এবং নিজ সংস্কৃতির অমূল্য  মূল্য কোনদিনই উপলব্ধি করতে পারবে না। 

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী 
সহকারী অধ্যাপক, 
সংস্কৃত বিভাগ, 
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted