আমি এবং কোনো এক নীহারকণা কর : নোয়াখালী ১৯৪৬
---------------------------------------------------------------
আমার ডাক নাম বাবাই, দিদা আদর করে ‘বাবন’ বলে ডাকতো । আমি দিদার খুব প্রিয় আদরের নাতি ছিলাম, আরো বেশি আদর কেননা ছেলে মেয়ে মিলিয়ে একমাত্র নাতি, বাকিরা সব নাতনি । পাঁচ ক্লাস পর্যন্ত পড়া দিদা নিহারকণা দাসের সাথে বিয়ে হয়ে গেল ইঞ্জিনিয়ার গঙ্গাবিমল করের , দিদা হলো নীহারকণা কর। দাদুর পরের ভাই অজয়দাদু হলেন প্রখ্যাত বাংলা চলচিত্র পরিচালক অজয় কর ।
স্বভাবতই এই বাড়িতে বিয়ে হওয়ায় দিদার বেশ একটা ঠমক ছিল । বিয়ের পর ১৯৪৪ এ পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ববঙ্গের নোয়াখালীর মেয়ে নিহারকণা কর চলে এলো বিক্রমপুর শশুরবাড়িতে । ভাগ্যিস এসেছিলো, নয়তো ১৯৪৬ এ তার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি মুসলমান নোয়াখালীতে কি নির্যাতনের ডালা সাজিয়ে উপস্থিত হতো কে জানে ! ঠিক ধরেছেন,এত কথা আগে বললাম তার কারণ হলো আজ থেকে আপনাদের বলবো সেই ১৯৪৬ এর নোয়াখালিতে সংখ্যালঘু হিন্দুদের, সংখ্যাগুরু বাঙালি মুসলমানদের হাতে কি অবস্থা হয়েছিল, কিভাবে নিঃশেষিত হয়েছিল, তার নির্মম সত্য ইতিহাস । নোয়াখালী নিয়ে ফেসবুক, ব্লগে কম লেখালিখি হয়নি । আমার এই ইতিহাস সেই চেনা ছকে যাবেনা । না লেখা, না বলা সত্যগুলো আপনাদের সামনে তুলে ধরার সময় এসেছে । আগামী প্রজন্ম যদি এগুলো থেকে শিক্ষা না নেয়, তাহলে বাঙালি একটা জাতি হিসেবে ভুগতেই থাকবে । ১৯৪৬ এর নোয়াখালী বুঝতে গেলে ১৯৪৬ এর কলকাতা ‘গ্রেট একশন ডে’ একটু আগে বুঝে নিতে হবে:
এই ১৯৪৬ এর কলকাতার ‘গ্রেট একশন ডে’ সম্মন্ধে এত লেখা হয়েছে, সকলেই মোটামুটি জানেন, তাই এই নিয়ে বিস্তারিত লেখা বাতুলতা, কিন্তু এর পেছনের যে রাজনীতির ইতিহাস প্রাধান্য পায়নি সেইটা জানা প্রয়োজন, তবেই ১৯৪৬ এর নোয়াখালির সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিত বোঝা যাবে:
➤১৯৪৬, ১৩ই অগাস্ট বঙ্গীয় আইন পরিষদে কমুনিস্ট পার্টির নেতা জ্যোতি বোস এক প্রচার বিজ্ঞপ্তি দিল মুসলিম লীগের ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ এর সাপেক্ষে:মুসলিম লীগের ডাকা বন্ধে পার্টি চেষ্টা করবে যাতে সার্বিক শান্তি বজায় থাকে, তাই পার্টি যেখানে প্রয়োজন সেখানে বন্ধ সমর্থন করবে আর যেখানে প্রয়োজন নয়, সেখানে বন্ধ সমর্থন করবেনা ।—পাঠক, একবার ভাবুন কি সাংঘাতিক সুবিধাবাদী ভামপন্থী রাজনীতি ! হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা গুলোতে বন্ধের বিরোধিতা করবে আবার পার্ক সার্কাস, মেটিয়াবুরুজ, মৌলালির মত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা গুলোতে বন্ধের পক্ষে থাকবে !!
➤কলকাতায় ১৬ই অগাস্ট ১৯৪৬ ভোরের এল ফুটতে না ফুটতেই বহিরাগত জমায়েত করে আনানো মুসলমানের সাথে কলকাতার বাঙালি, অবাঙালি মুসলমানরা রে রে করে ঝাঁপিয়ে পরলো হিন্দুদের উপরে । দুদিন ব্যাপি অবাধে লুঠ, খুন, ধর্ষণে মেতে উঠলো কলকাতা । সেদিনের বাঙালি মুসলমানেরা ঈমানী জোশে কোনো অংশে কম ছিলোনা, কারণ পাকিস্তানের দাবিতে সংখ্যাগুরু কণ্ঠ উঠেছিল বাঙালি মুসলমানদেরই !
➤কলকাতার মেয়র সেরিফ খান সক্রিয়ভাবে এই দাঙ্গা পরিচালনা করলো ।স্বরাষ্ট্র দফতরের মন্ত্রী সুরাবর্দীর নির্দেশে আগে থেকেই ২৪ টি পুলিশ হেড কোয়ার্টারের হিন্দু পুলিশ অফিসারদের ডিউটি থেকে সরিয়ে দিয়ে ২২ টি তে মুসলমান ডিউটি অফিসার বসানো হয়েছিল আর বাকি ২ টি তে এংলো ইন্ডিয়ান ডিউটি অফিসার দেওয়া হয়েছিল ।
➤বাংলার ব্রিটিশ গভর্নর এফ. ব্যারোজ স্টেটমেন্ট দিলো :সে কোনো দাঙ্গার খবর কোথাও শোনেই নি, অথচ স্টেটসম্যান পত্রিকার ব্রিটিশ সাংবাদিক কিম ক্রিস্টেন লিখলো:’দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতায় আমার নার্ভ যথেষ্ট শক্ত হয়ে গেছে । কিন্তু যুদ্ধও এত পৈশাচিক নয় । এ এক মধ্যযুগীয় বর্বর উন্মাদনা । এবং এটাকে পৈশাচিক রূপ দেওয়া হয়েছিল ।’
দুদিন একতরফা হিন্দু নিধনযজ্ঞ চলার পর কলকাতার বাঙালি ও শিখরা একজোট হলো গোপাল পাঁঠার নেতৃত্বে । পালটা দেওয়া শুরু করলো মুসলমানদের । এমনই পাল্টা যে সুরাবর্দির চামচা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালিকে নতি স্বীকার করতে হলো। তখন ভাবটা এরকম: যা হয়ে গেছে, হয়ে গেছে, আর না, এবারে বন্ধ হোক । প্রশাসনকে সুরাবর্দি লেলিয়ে দিলো এই প্রতিরোধকারীদের উপরে ।কলকাতায় যখন এই ব্যাপক হত্যালীলা চলছিল, তখন লম্পট নেহেরু অন্তরকালীন সরকার নিয়ে ভাইসরয়ের সাথে আলোচনায় ব্যস্ত ছিল । জিন্নাহর হযবরল দ্বিজাতিতত্বের থিওরিতে আপামর মুসলমান তখন এক আলাদা জাতি ‘মুসলমান জাতি ‘ আর তাদের মধ্যে এক কাঠি উপরে সক্রিয়তাই ‘বাঙালি মুসলমান’ । কলকাতার হিন্দুদের এই প্রতিরোধ গলায় কাঁটা হয়ে বিঁধে রইল ‘মুসলমান’ জাতির, লীগের সরকার থাকা সত্ত্বেও হিন্দুদের প্রতিরোধ ? হিন্দুদের হাতে মার খেতে হলো ? উচিত শিক্ষা দিতে হবে এই শালা হিন্দুদের আর এই উচিত শিক্ষা দিতে তারা বেছে নিলো কলকাতা থেকে অনেক দূরে পূর্ব বাংলায় নদী, নালা বেষ্টিত, তাল, সুপারির ছায়া ঘেরা শান্ত শ্যামল নোয়াখালিকে । তখন পূর্ববাংলার নোয়াখালীতে শতকরা ১৮.৬% সংখ্যালঘু হিন্দু আর ৮১.৪% সংখ্যাগুরু বাঙালি মুসলমান । এবার আর কলকাতার পুনরাবৃত্তি হতে দেওয়া যাবেনা । প্রতিরোধ তো দূরের থাক, এইবার আর একটা হিন্দুকেও পালিয়ে বাঁচতে দেওয়া হবেনা । নোয়াখালীর বাঙালি মুসলমানের বুকে তখন বখতিয়ারের ঘোড়ার খুড়ের দামামা বাজছে । রক্ত চাই, হিন্দুর রক্ত চাই………………..!!!
“হুনছেন নি ও মিঞা ভাই
গোলাম সরোয়ার মিঞার মতন
খাট্টি মাইনস আর নাই ।”
১৯৪৬ এ নোয়াখালীর গ্রামে গঞ্জের মানুষের মুখে এই ছড়া তখন ঘুরতো ।প্রাক্তন মুসলিম লীগ এম এল এ, সাহাপুর স্কুলের সভাপতি গোলাম সরোয়ার তখন নোয়াখালীর অবিসংবাদিত নেতা । নোয়াখালীর বাঙালি মুসলমানের নয়নের মনি আর যুব সমাজের প্রেরণা । কলকাতা দাঙ্গায় হিন্দুর প্রতিরোধের বদলা তুলতে নোয়াখালীতে হিন্দুদের নিঃশেষ করে দিতে হবে, তাদের উপর নামিয়ে আন্তে হবে নিদারুন নিপীড়ন- এর ব্লু প্রিন্ট এই গোলাম সরোয়ারের মাথা থেকেই বেরোয় । সেদিনের সেই নৃশংস পরিকল্পনা র সার্থক রূপায়ণে গোলাম সরোয়ারকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো নোয়াখালীর স্কুলগুলোর শিক্ষকরা,মাদ্রাসার মৌলভীরা এমনকি ইউনিয়ন সভাপতিরাও ! ১৯৪৬ এর সেপ্টেম্বর মাস থেকে নোয়াখালীতে চলেছিল একতরফা হিন্দু-বিদ্বেষী প্রচার । শুরুতে হিন্দু ব্যবসায়ীদের দোকান বয়কট করার আহবান জানানো হলো বাঙালি মুসলমান জনগণকে । মুসলিম ন্যাশানাল গার্ডের ভলান্টিয়াররা হিন্দুদের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পাহারা দিতো যাতে কোনো মুসলমান সেই দোকানগুলো থেকে কোনো জিনিস না কেনে । খুব প্রয়োজনে যদি কোনো বাঙালি মুসলমান হিন্দুদের দোকান থেকে কোনো জিনিস কিনতে গিয়ে ধরা পরতো, তাকে জনসম্মুখে, প্রকাশ্যে কানে ধরে ওঠবস করানো হতো । সরকার এর রিপোর্ট গোপনে করেছিল । কোর্ট কাছারিতে সকল মুসলমান মক্কেলদের কোনো হিন্দু উকিলকে কেস দেওয়া থেকে বিরত রাখা হলো । নোয়াখালীতে বিশাল বিশাল পানের মৌজা ছিল । হাটের দিন লীগের কর্মীরা হিন্দুদের পানের আড়ৎ গুলোর সামনে পিকেটিং করতো, যাতে কোনোভাবেই হিন্দুরা পান বিক্রি করতে না পারে । প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে হিন্দুদের ভাতে মারার পর শুরু হলো বাঙালি মুসলমানের সহিংস ক্রিয়াকলাপ । হিন্দুদের বাড়িতে ডাকাতি, মন্দিরের সামনে গরু জবাই, হার মাংসের অংশ মন্দিরে বা হিন্দু বাড়িতে নিক্ষেপ । তৎকালীন বঙ্গীয় আইনসভাতে, গোলাম সরোয়ারের নেতৃত্বে নোয়াখালী হিন্দুশূন্য করার প্রক্রিয়া নিয়ে জানানো হয়েছিল :” Widespread reports of Hindus deprived of their valuables while travelling in boats, of Hindu houses burgled, of cows sacrificed in public places, of Hindu shops looted and temples and idols desecrated.” সেদিনের নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থানার পাঁচ গাঁও এর এক হিন্দুর জবানবন্দিতে : ‘আমাদের পাশেই এক ব্রাহ্মণ পরিবার ছিল । ওরা ছিল চার ভাই । কুরবানীর দিন ওদের ঠাকুর মন্দিরের সামনে গরু কাটা হলো, তারপর ঝুড়ি করে ওদের চার ভাইয়ের ঘরেই মাংস পাঠিয়ে দেওয়া হলো । ওরা তো এসব দেখে একেবারে আঁতকে উঠেছে আর কি ! অনেকে ঘৃনায় বমি করতে শুরু করলো । ব্যাস, আর যায় কোথায় । গ্রামের সমস্ত মুসলমান ওদের বাড়ি ঘিরে ধরলো । বললো :শালা —উন, হারামজাদা, আমাদের খোদার প্রসাদ অপমান করলি ! বিচার বসলো, ওদের শাস্তি হলো । বাড়ির সব পুরুষকে নাকে খৎ দিতে হলো, জরিমানা ধার্য্য হলো
২৫০ টাকা ।’
পাঠক, বুঝতে পারছেন বখতিয়ারের গর্বিত উত্তরসূরী ১৯৪৬ এর বাঙালি মুসলমান কি ধুরন্ধর পরিকল্পনায় নোয়াখালীকে সংখ্যালঘু হিন্দুশূন্য করতে ময়দানে নেমেছিল ? আজ হয়তো এদের পরের জেনারেশনের অনেকেই ব্লগে, মিডিয়ায় কলমে মুক্তচিন্তার আগুন ঝরায়, কিন্তু অতি কৌশলে বাঙালি মুসলমানের নোয়াখালীর গৌরবগাঁথার কথা চেপে যায় !
রেফ: G.D.Khosla-Stern Reckoning- A survey of the Events before and following the partition of India.
Bengal Press Advisory Committee Report, 1946 (Oct)
R.C.Majumdar- History Of freedom Movement
J.B.Kriplani-Gandhi His Life and Thought.
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................