ইতিহাসের পাতা থেকে - প্রথম পর্ব
মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের কলকাতা ভ্রমণ।
মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত দুদিনের অবসর পেয়েছেন। ভাবলেন মর্ত্যে একবার মাতৃভূমি দর্শন করে আসবেন। আড়াই হাজার বছর হতে চললো প্রায়। মর্ত্যের খবর পেয়ে যান বিভিন্ন স্বর্গীয় ট্যাবলয়েডে। তাই মোটামুটি একটু ধারণা আছে। কিন্তু গত একশ বছর খুব বিশেষ কিছু খবর দেখতে পাননি। তাই ঠিক করলেন একবার সশরীরে, না না শরীর তো নেই, ওই মূর্তিটাই আছে, সমূর্তিতেই ঘুরে আসবেন। দেশকাল, মানুষজন, সভ্যতা একটু জানা দরকার।যাই হোক ভারতবর্ষকে প্রথম এক রাষ্ট্র হিসাবে যে সম্রাট গঠন করেছিলেন, তাঁর এমন ইচ্ছা খুব স্বাভাবিক।
পাটলিপুত্রের নিকটতম মহানগর কলকাতায় সরাসরি অবতীর্ণ হলেন। অনেক রকম গুপ্ত বিদ্যা শিখেছিলেন চাণক্যর কাছে। দেখলেন এখনো ভোলেননি। বাতাসের সাথে ভাসতে ভাসতে আলোর গতিতে স্বর্গ থেকে একদম কলকাতা ময়দান। বিদ্বান সাহসী চন্দ্রগুপ্ত প্রথমেই উচ্চ শিক্ষার খবর নিতে উৎসাহী হলেন। যে কোনো জাতির মানদণ্ড, মূলভিত্তি তার শিক্ষা। ময়দানে অনেক লোক। ইতস্ততঃ ঘুরছে। এক জন, " চলছে না, চলবে না " বলে জোরে জোরে কিছু বলছে। চন্দ্রগুপ্ত কিছূই বুঝলেন না।
এত ভাষার সমস্যা হবে ভাবেননি। তাঁর আশা ছিল এদের ভাষা বুঝতে পারবেন। না সে আশা নেই। মনে মনে ভাষার দেবীর স্তব করে নিতেই সব জল। এক অনুবাদক এসে মিশে গেল অন্তরাত্মায়।তারপর নিমেষে পৌঁছে গেলেন শহরের নামকরা উচ্চ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সামনেই কাঁধে ঝোলা নিয়ে এক ছাত্রকে দেখে একটু অবাক হলেন। ছাত্র সুলভ নম্র আচরণ নয়, একটু উদ্ধত যেন। তক্ষশিলার সাথে অনেক পার্থক্য। সেখানে সবাই খুব বিনয়ী ছিল। চাণক্যের কড়া শাসন ছিল। ছাত্ররা তটস্থ থাকতো। তিনি সামনের বিরাট প্রান্তর পেরিয়ে গম্বুজ আকারের এক ঘরে উপস্থিত হলেন। ঘর ভর্তি সব নারী পুরুষ যেন মগধের বাজার।
অনুশাসনের বড় অভাব। এরা উন্নতি কিভাবে করবে নাকি এই জন্য উন্নতি করতে পারেনি, বড় চিন্তিত হলেন। সেখানে এক জন " সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন চলবে না" এই সহ জোরালো আলোচনা, বক্তব্য। অবাক কাণ্ড! ভারতের প্রথম সাম্রাজ্যবাদী সম্রাটের সামনে এত বড় সাহস। এত বড় ইতিহাসের অসম্মান। জানতে পারলেন ভারতবর্ষ এখন গণতান্ত্রিক দেশ। তবে সাম্রাজ্যবাদ কি? বুঝলেন এরা বিরোধী পক্ষ। আর সাম্রাজ্যবাদী বলতে আমেরিকাকে বোঝানো হয় আর ভারত সরকার এখানে প্রতীকী সাম্রাজ্যবাদ। কেমন যেন গুলিয়ে গেল সব। কিছুতেই পরিষ্কার হচ্ছে না।
অবশেষে এক নিরীহ ধরনের ছাত্রকে ধরলেন। জানতে হবে তো সব। জিজ্ঞাসা করলেন, " এরা তো খুব আমেরিকাকে ঘৃণা করে। " ছাত্রটি মাথা নাড়লো। তারপর সেই নেতা গোছের ছাত্রটির সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করলো। যে সম্রাট প্রথম ভারতবর্ষ গঠন করেছিলেন তাঁর কৌতূহল স্বাভাবিক। ডেকে আলাপ করলেন। " এরপর কি করবে তুমি? " উত্তর পেলেন " ভিসা রেডি। আমেরিকা যাচ্ছি। খুব বড় অফার আছে।" হেঁচকি উঠলো চন্দ্রগুপ্তের। ভাবলেন হয় মিথ্যা বলছে নয় ভুল শুনলেন। খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরি করতে করতে বুঝতে পারলেন.... এরা মুখে বলে এক। আর কাজে করে সম্পূর্ণ বিপরীত। নামকরা কলেজের মেধাবী ছাত্র, সরকারী টাকায় পড়াশুনা করে মাতৃভূমিতে থাকতে রাজি নয়। মনে পড়লো মাত্র কিছুদিন পাটলিপুত্র ছেড়ে থাকতে হলে তাঁর কি পরিমাণ কষ্ট হতো। ভাবলেন ভাগ্যিস চাণক্য আসেননি।
একজনকে জিজ্ঞাসা করলেন, " তোমরা সেই আমেরিকা যাবেই যখন তখন তার বিরুদ্ধে কথা বলছো কেনো? "
" আরে ওটা তো আমাদের চিন্তাধারা, দর্শন, ওটা একটা 'বাদ' "। " ভারতীয় দর্শন নয় কেনো" প্রশ্ন চন্দ্রগুপ্তের। " ওটা তো ঋষিদের লেখা। ঋষি মানে হিন্দু। তাই ওটা সাম্প্রদায়িক।" চন্দ্রগুপ্ত দেখলেন কেউ ভারতীয় ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য জানে না, শ্রদ্ধা নেই। সবাই বিদেশীদের ভাল ভাবে। উন্নত মনে করে। তাদের আদর্শে, ভাবধারায় দীক্ষিত। হিন্দু ধর্ম যেন এক অসুখ। ছুঁলেই ভারতবর্ষ ধ্বংস হবে।
তিনি সব থেকে বড় গ্রন্থাগারে চলে গেলেন। ইতিহাসটা একটু পড়ে নিতে হবে। দেখলেন তাঁর পড়া স্বর্গের ইতিহাস আর কলকাতার লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত ইতিহাসে বিস্তর পার্থক্য। যত অত্যাচার, শোষণ, যুদ্ধ সব হিন্দু রাজাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। জাতিভেদের সংজ্ঞা বদলে গেছে। খুব কষ্ট হলো। মূর্তিতে একটু চির ধরলো। আড়াই হাজার বছরের পুরানো তো।
এবার তিনি ক্ষমতার পীঠস্থানে যেতে চান। বর্তমান শাসক আর বিরোধী পক্ষ কেমন না জানলে দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক অবস্থা জানা যায় না। উন্নতি বা দুর্গতির মূল কারণ তো শাসক আর তাদের নীতি। দেখলেন ঠাণ্ডাঘরে বসে সর্বহারাদের কল্যাণের আলোচনা চলছে। বুঝতে অসুবিধা হলো না কিছু। অন্য এক নেতা বিদেশী ভাষায় বলছেন যে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা না হলে আপামর জনগনের কাছে পৌঁছাবে না। আসলে তিনি নিজেই সকলের কাছে পৌঁছাতে পারলেন না। বড় গোলমেলে সব। রাস্তা ঘাট, দোকান বাজার, কোথাও কোনো পরিকল্পনা নেই। জঞ্জালের স্তূপ, ভিড়ে ভরা বাস, যত্র তত্র গাড়ি দাঁড়িয়ে। কোনো নিয়মের ধার কেউ ধারে না। প্রকাশ্য রাস্তায় পানের দাগ, প্রকাণ্ড রাজপথে কোনো শৌচাগার নেই, বিশ্রামরের ব্যবস্থা নেই। এবার মাথা ঘুরতে লাগলো। কিছু খেতে হবে।
সামনেই বিশাল হোটেল। তাঁর চেহারা দেখে তো সবাই অবাক। তিনি নিজের পরিচয় দিলেন। খাবারের কথা জানতে চাইতেই ম্যানেজার বললেন, "স্যার, আপনার নামে দিল্লীতে সব থেকে ভাল হোটেল আছে। ওখানে চলে যান। দিল্লী দর্শনও হয়ে যাবে সঙ্গে ভাল খাওয়াও। " চন্দ্রগুপ্ত ভাবলেন সেটাই ভাল। দেশের রাজধানী না দেখলে দেশভ্রমণ বৃথা। বিকালে যাবেন সেখানে। আগে একবার গ্রাম বাংলা দেখে নিতে চান। বারবার তো আর আসার সুযোগ পাওয়া যাবে না।
কিন্তু যাবার আগে মহানগরের দুরবস্থা দেখে চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল। মাত্র দু ফোঁটা জল। পরের দিন খবরের শিরোনাম.... মাত্র আধা ঘণ্টার ভারী বৃষ্টিতে কলকাতা আবার জলের তলায়।
ক্রমশ.........
http://banglarjanala.blogspot.com/2020/05/blog-post_41.html
✍️ দেবযানী হালদার
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................