ইতিহাসের পাতা থেকে - দ্বিতীয় পর্ব
প্রথম পর্বের লিংক:
http://banglarjanala.blogspot.com/2020/05/blog-post_76.html
' চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য গ্রাম বাংলার পথে ঘাটে '
শহরের অভিজ্ঞতা একদম ভাল হলো না। ভাবতে ভাবতে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ভেসে চলেছেন। হঠাৎ এক জায়গায় বেশ কিছু মানুষের জটলা দেখে নামলেন। কি হয়েছে সেটা বোঝার চেষ্টা করতে লাগলেন। এক জন পুরুষ রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছে। তাকে জড়িয়ে ধরে এক মহিলা আকাশ কাঁপিয়ে কাঁদছে। আচ্ছা নিশ্চয় জীবনসঙ্গিনী। খোঁজ নিয়ে বুঝলেন স্থানীয় রাজনীতির শিকার। এত অবাক কখনো হননি। প্রজার মৃত্যুর জন্য রাজার নীতি দায়ি!? সে তো যুদ্ধ হতে পারে রাজার নীতি থেকে। কিন্তু সাধারণ মানুষের মৃত্যু!!!
অন্য গ্রামে চলে এলেন। অন্য জেলা একটু দক্ষিণে। সেখানে জল খেতে এক গৃহস্থ বাড়ির দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। তিনি যা দেখলেন, শুনলেন, প্রাণায়াম করে করে ভিতরের জোর খুব নাহলে অজ্ঞান হয়ে যেতেন। সেই বাড়িতে তিন ভাই। তিন জনে তিন প্রধান রাজনৈতিক দলের সমর্থক। বড় ভাই এতদিন লাল ঝাণ্ডার হয়ে কাজ করে এসেছেন। পঞ্চায়েতের সব ঠিকাদারি উনিই পেয়েছেন। এখন মেজো ভাই সবুজের সমর্থক। এখনো পঞ্চায়েতের ঠিকাদারি সব ওদের। ছোট ভাই গেরুয়াতে নাম লিখিয়েছেন সদ্য। আগামী দিনে যদি পালা বদল হয়, ঠিকাদারির ঠিকেটা পাকা করে রেখেছেন। বুঝলেন খুব দূরদর্শী পরিবার।
আবার চলতে মানে ভাসতে শুরু করলেন। এবার একটু উত্তরে গেলেন। জল খাওয়াও হয়নি এখনো। কষ্ট হচ্ছে খুব। দেখলেন বাঁশের পুল মূর্তির তো ওজন কম নয়। কিন্তু ওই পুলটাই যোগাযোগের এক মাত্র উপায়। বেশ খানিক এগোতেই চোখে পড়লো একটি বড় ব্যানার " দূর্গাপুজা নয়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখুন। অন্যের ধর্মে আস্থা রাখুন" ....দুটোর মধ্যে যোগসূত্র জানা খুব দরকার।
সামনের বটতলায় বাঁশের মাঁচায় কয়েক জন আগুন খাচ্ছে মানে মুখে আগুন। হাতে খবরের কাগজ আর সবাই বিশ্বজ্ঞানী। কি নিয়ে যেন মহা তর্কাতর্কি চলছে। বোধহয় এই গ্রাম খুব বর্ধিষ্ণু মানে সবার অঢেল টাকা পয়সা। কাজের সময় বসে আড্ডা তো তারি ইঙ্গিত দিচ্ছে। যাই হোক জিজ্ঞাসা করলেন ওদের বিষয়টা। জানতে পারলেন অভিনব তথ্য। পাশের এক গ্রামে হিন্দু বেশী হওয়া সত্ত্বেও দূর্গাপুজা বন্ধ করে দেয় প্রশাসন। যুক্তি ছিল অন্য ধর্মের কাছে বিষয়টা সাম্প্রদায়িক। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য বললেন " কেন সব ধর্মনিরপেক্ষতার দায় দায়িত্ব কি একা হিন্দুদের? আর তোমরা কেমন মানুষ? প্রতিবাদ করো না? " সবাই বললো " হ্যাঁ, বিষয়টা পুরানো। এই তো মহরমের জন্য বিসর্জন বন্ধ করেছিল সরকার। আদালতে সরকার হেরে গেছে। বিচারপতি ধিক্কার জানিয়ে হিন্দুদের পক্ষে রায় দিয়েছেন। " তাহলে ওই ব্যানার " বললেন চন্দ্রগুপ্ত। বললো " ওটা সরালে মুশকিল আছে। আমরা নিরীহ মানুষ। কোনো রঙে নেই। বেঁচে থাকার লোভ একটু বেশী। থাক না ওটা। ক্ষতি কি।" চন্দ্রগুপ্ত এদের নিস্পৃহতা দেখে খানিকক্ষণ বোবা হয়ে গেলেন। এরা প্রতিবাদ করতে ভুলে গেছে। অবশ্য প্রতিবাদ করার ফল তো আগেই দেখেছেন। প্রতিবাদ করা ভুলতে বাধ্য হয়েছে মানুষ।
এগিয়ে চলে গেলেন বেশ পূর্ব দিকে। সামনেই কাঁটা দিয়ে ঘেরা লম্বা দীর্ঘ প্রাচীর। খাকি রঙের পোশাক পড়া লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে। জানতে পারলেন এটা আন্তর্জাতিক সীমানা আর লোকগুলো সীমান্ত প্রহরী। কিন্তু যা দেখলেন তা আরো ভয়াবহ। কাতারে কাতারে মানুষ ওই বেড়া ডিঙিয়ে এপারে আসছে। এদিকে লোক বসে আছে ভুয়ো পরিচয়পত্র তৈরি করার জন্য। আশ্চর্য্য এত লোক আসছে অথচ পুলিশ প্রশাসন সবাই নিরুত্তাপ। তাহলে অন্য দেশ কেন। তিনি তো নিজেই অক্লান্ত পরিশ্রম করে ছোট ছোট রাজ্য জয় করে বিশাল অখণ্ড ভারতবর্ষের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আজ তার অর্ধেক বেঁচে আছে। পরিস্থিতি এক কথায় জটিল।
চন্দ্রগুপ্ত এবার এক শিক্ষকের সাথে কথা বলতে চান। গ্রাম বাংলার মানুষের অনেক অজানা তথ্য জানতে পারবেন। খুঁজে খুঁজে এক বছর চল্লিশের শিক্ষকের দেখা পেলেন। সাইকেল দাঁড় করিয়ে তেলেভাজা খাচ্ছেন। " এত তেলেভাজার দোকান কেন? " " এটাই তো বাংলার নতুন শিল্প। ভাল ভবিষ্যৎ আছে স্যার। " চন্দ্রগুপ্ত বেজায় রেগে বললেন " তোমাদের পেটের সমস্যা হয় না। " শিক্ষক মহাশয় উত্তর দিলেন " খুব আছে স্যার। গোলাপী ওষুধ ভরসা স্যার। ঘরে ঘরে পাবেন। আর একটু বয়স হলে তো চেন্নাই যেতেই হবে। " চন্দ্রগুপ্ত আবার অবাক " চেন্নাই কেন? সেটা কি শ্মশান নাকি? " " আরে কি যে বলেন স্যার। চেন্নাই হলো বাঙালির স্বাস্থ্য তীর্থ স্থান। " " দাঁড়াও দাঁড়াও। স্বাস্থ্য আমার বিষয় নয়। চরক আছেন। পাঠিয়ে দেবো একদিন। দেখে যাবেন। "
" স্যর.... " চন্দ্রগুপ্ত এবার বাধা দিলেন। " স্যার স্যার করছো কেন তখন থেকে? আমাকে চেনো না? " " স্যার তো সব চেয়ে ভদ্র, সভ্য, মার্জিত সম্বোধন স্যার"। মাথা চুলকে সরল স্বীকারোক্তি " না স্যার, চিনতে পারিনি। " চন্দ্রগুপ্ত জিজ্ঞাসা করলেন " কোন ধরনের শিক্ষক?" " আজ্ঞে প্যারা স্যার। " " বাহ্" বেশ খুশি হয়ে বললেন। কিন্তু পরক্ষণেই রেগে বললেন " ইতিহাস জানো না বুঝি? " "না স্যার, আমি তো ইতিহাসই পড়াই। " তারপর বলতে শুরু করলেন " আসলে সাধারণ স্নাতক। কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে পারদর্শী না।" চন্দ্রগুপ্ত ক্ষুন্ন হয়ে বললেন " তবুও মহান সম্রাট চন্দ্রগুপ্তকে চেনো না? " এবার ভদ্রলোক আমতা আমতা করে বললেন যে শ্রেণীতে পড়ান সেখানে মধ্যযুগ আর আধুনিক যুগ।
চন্দ্রগুপ্ত আবার বললেন " প্রাচীন ভারত পরীক্ষায় ছিল না। " " ছিল স্যার। তবে সাজেশনে ছিল না। অশোক ছিল। অশোক আপনার ছেলে না " চন্দ্রগুপ্তের চোখে আগুন " অশোক আমার নাতি। " " এই রে, বিন্দুসার বাদ যাচ্ছিল। " " তা সাজেশন পড়েছো, পুরো বই পড়োনি। " " না স্যার, চারটি মেয়ের সাথে এক সঙ্গে প্রেম করে আর হয়ে ওঠেনি। " চন্দ্রগুপ্ত জিজ্ঞাসা করলেন " তোমার চার জন সহধর্মিণী। " শিক্ষক জিভ কেটে বললেন " স্বাধীন ভারতে হিন্দুদের এক জন স্ত্রীই বৈধ। " উত্তর এল " আচ্ছা বাৎসায়নের বিষয়। তা ভাল ভাল। পরে শিখে নাওনি কেনো। " " গিন্নী রাগ করেন। সাত হাজার টাকার শিক্ষক স্যার অন্য কাজ না করলে সংসার চলবে না। " " কিন্তু শিক্ষকদের তো ভাল বেতন ।কথা হলো তো প্রশাসকের সাথে।" " হ্যাঁ স্যার তারা স্থায়ী। তারা পরীক্ষা দিয়েছে। আসলে কোষাগারে টাকা নেই। আগের সরকার ফাঁকা করে গেছে। এখন স্যার সবাই বাংলা ফাঁকা করে চাকরির সন্ধানে অন্য জায়গায় চলে যাচ্ছে। " সম্রাট জানতে চাইলেন " তুমি যাওনি কেনো? " " আমি অত দক্ষ না তো। আসলে বাপ দাদার ভিটে ছেড়ে যেতে পারিনি। " " বাহ জাতীয়তাবাদী। " শিক্ষক মাথা নাড়লেন " না স্যার, এখানে জাতীয়তাবাদী হওয়া মানা। এখানে সবাই বাংলাবাদী ধর্মনিরপেক্ষ।"
চন্দ্রগুপ্ত বড় উদাস হয়ে যান। আম্বেদকরের সাথে কথা বলতে হবে ফিরে গিয়ে। ধর্মনিরপেক্ষ সংজ্ঞাটা খুব গোলমেলে। নেহরুর সাথেও দেখা করবেন। তাঁরও দায়িত্ব আছে।
মাঠগুলো সব নিষ্প্রাণ। খালে বিলে পুকুরে জল নেই আর থাকলেও পানীয় নয়। খুব দূষিত। সবুজের সতেজতা নেই, মশায় পিনপিন করছে , রাস্তায় লোকজন নেই সব ঘরে টিভি দেখছে। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেলো। সবাই উঃ, আঃ করে বাইরে বেরিয়ে আসছে। চন্দ্রগুপ্ত একজনকে জিজ্ঞাসা করলেন " কি দেখছিলে? " চন্দ্রগুপ্তকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠান হয় ধারাবাহিক। " খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে আবার প্রশ্ন করলেন " আপনি তাঁর সম্বন্ধে কোনো বই যেমন অর্থশাস্ত্র বা মুদ্রারাক্ষস পড়েছেন? " " না না, বই পড়লে চোখ আর মন দুটোই খোলা রাখতে হয়। টিভি দেখলে কষ্ট কম। শুধু চোখের কাজ। মনের ছুটি। অত পরিশ্রম করতে পারি না। বাবা বিগত সরকারে রাজ্য সরকারী কর্মচারী ছিলেন। তার সঙ্গে শ্রমিক নেতা। দুই ঘণ্টার বেশি অফিস করেরনি কখনো। রক্তে মিশে গেছে সেটা। "
চন্দ্রগুপ্ত বুঝে গেলেন আর কিছু জানার নেই। আর কিছুই দেখার নেই। 'সোনার বাংলা ', ' রূপসী বাংলা ' সব কেতাবি কথা। আসলে ঘুণ ধরে গেছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। হাড় গিলগিলে অবস্থা। না কি যেন বলে, হাড় জরজরে অবস্থা। জল এখনো খাওয়া হলো না। খুব জোরে হাওয়ার সাথে পাড়ি জমালেন। দিল্লী দর্শন এবার। পরের দিন খবরের শিরোনাম...... " বাংলার বিস্তীর্ণ এলাকা অসময়ের কালবৈশাখী ঝড়ে বিপর্যস্ত। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক। তেলেভাজা শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত সব থেকে বেশি। সব নষ্ট হয়ে গেছে। আবহাওয়া দপ্তর এবারেও সময় মত আগাম সতর্ক বার্তা জানাতে অক্ষম। "
ক্রমশ..............
✍️ দেবযানী হালদার
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................