"তোমরা অভিশপ্ত হিন্দু। বাংলাদেশ একটি ইসলামি রাষ্ট্র। এই মুসলিম দেশে তোমরা ধর্মচর্চা করতে পারবে না। তোমরা ভারতে চলে যাও। না হলে তোমাদের কুপিয়ে হত্যা করা হবে।"
সর্বধর্ম সমন্বয়বাদ প্রচারক রামকৃষ্ণ মিশন-এর মহারাজের নিকট এই চিঠিটি পাঠিয়েছিল - জনৈক আবু বক্কর সিদ্দিক। ঠিকানা লেখা হয়েছে ‘ইসলামিক স্টেট অব বাংলাদেশ, চান্দনা চৌরাস্তা ঈদগাঁও মার্কেট, গাজীপুর মহানগর’। এই সমস্ত গুরুবাদী সংগঠনগুলোর কবে কাণ্ডজ্ঞান যে, অন্য ধর্মের লোকেরা সর্বধর্ম সমন্বয়বাদ ঘৃণা করে।
অবিভক্ত বাংলার অন্যতম হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলা ছিল খুলনা। এখন হিন্দুশূন্য হওয়ার পথে। ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের যোগাযোগ মন্ত্রী ছিল খুলনার আব্দুর সবুর খান। ক্ষমতায় এসেই আইয়ুব খান যেভাবে ভারতের সঙ্গে শত্রুতা সৃষ্টি করে, তেমনি তার যোগাযোগ মন্ত্রী আব্দুর সবুর খানও - খুলনার হিন্দু হত্যার জল্লাদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
আব্দুর সবুর খান আইন করেছিলো,খুলনা শহর ও আশপাশ অঞ্চলের হিন্দুরা পায়ে জুতা পরে চলতে পারবে না, মাথায় ছাতা ধরতে পারবেনা। কারন কি...? কারণ হচ্ছে, কোরআন-এর ৯৮ নম্বর সুরার ৬ নম্বার আয়াত - যেখানে বলা হয়েছে, "যারা অমুসলিম তারা নিকৃষ্টতম প্রাণী, মুসলমানেরা শ্রেষ্ঠতম প্রাণী।"
কোরআন-এর ৯ নম্বর সুরার ২৮ এবং ২৯ নম্বর আয়াত-
"অমুসলিমদেরকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে মুসলমানদের বশ্যতা"।
১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে রূপচাঁদ নামে জনৈক হিন্দুর জমি জোর করে দখল করে একটি ৫ তলা বাড়ি নির্মাণ করেছিল এই জল্লাদ আব্দুর সবুর খান। রূপচাঁদ আদালতে মামলা দায়ের করেন এবং জিতেও যান। এই ঘটনায় হিন্দুদের ওপর বেজায় চটে যায় সবুর খান। হিন্দুদের জব্দ করার জন্য সে নানান ধরনের ফন্দিফিকির করতে থাকে।
১৯৬৩ সালের ২৭ শে ডিসেম্বর কাশ্মীরের হজরতবাল মসজিদ থেকে হজরতের চুল চুরি গেছে বলে- গুজব রটিয়ে দিয়ে হিন্দুদের উপর ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক আক্রমণ চালানো হয়। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বিবৃতি দিয়ে হিন্দুদের হুঁশিয়ারি দেয়, "হিন্দুদের ওপর এর পরিণাম কি হবে, আমি জানি না। আমি কোনোরকম দায়-দায়িত্ব নিতে পারবো না।"
ওই বছরের ২ রা জানুয়ারি নবীর চুলটি খুঁজে পাওয়া যায়। মসজিদের ইমাম জানায়, সে হযরতের চুলটি সরিয়ে রেখেছিল; তবে কোথায় রেখেছিল-তা সে ভুলে গিয়েছিল। ততদিনে গণহত্যায় হিন্দুশূন্য হয়ে গেছে উভয় পাকিস্তানের বহু জনপদ।
হযরতের চুল ফিরে পাওয়া গেলে কি হবে, সবুর খানের সাম্প্রদায়িক আক্রোশ থামলো না। জানুয়ারি মাসের ৩ তারিখ থেকে ৭ তারিখের মধ্যে হিন্দুদের খুলনা ছেড়ে চলে যাবার হুমকি দিয়ে এলাকায় প্রচারপত্র বিলি করা হয় এবং মাইকিং করা হয়।
ওই বছরের ১৪ জানুয়ারি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা ও সিরাজগঞ্জগামী ট্রেনগুলো টঙ্গি ও তেজগাঁও স্টেশনে থামলে, সমস্ত হিন্দুদের ট্রেন থেকে নামিয়ে এক এক করে খুন করা হয়।
আদমজী জুট মিলের মুসলমান ম্যানেজার গুজব রটিয়ে দেয় যে, তার ভাইকে খুন করা হয়েছে কলকাতায়। অথচ তার ভাইকে পাহারা দিয়ে নিরাপদে রেখেছিল কলকাতার সেক্যুলার হিন্দুরা। কিন্তু সেই রটনা শুনে আদমজী জুট মিলের ২০ হাজার মুসলমান শ্রমিক আক্রমণ চালায়, পাশের হিন্দু মালিকানাধীন কটন মিলে। নিমিষেই সেখানকার ৭০০ জন হিন্দুকে খুন করে ফেলা হয় এবং মেয়েদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর ঢাকার জাফরাবাদ, চালনা ও মংলা বন্দরের আশেপাশের হিন্দু গ্রামগুলিতে সাম্প্রদায়িক হামলা চালিয়ে খুন-ধর্ষণ-লুন্ঠন শেষে হিন্দুদের বাড়িঘর দোকানপাট জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
ঢাকায় প্রতিদিন ৫/৬ হাজার হিন্দু ভারতীয় হাই কমিশনের সামনে আশ্রয় নেন। এছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ কলেজে আশ্রয় নেন ১০ থেকে ২০ হাজার হিন্দু।
১৯৬৪-তে পাকিস্তান সরকার আইনজারি করে, হিন্দুরা কোনো জমি বিক্রি করতে পারবে না। এর ফলে বাধ্য হয়ে হিন্দুরা জমি-বাড়ি ফেলে ভারতে চলে আসেন।
হিন্দু অত্যাচারের খবর ছাপে "পাকিস্তান অবজারভার" ও " ইত্তেফাক।" এজন্য ওই পত্রিকা দু'টিকে ৫ দিনের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এতকিছুর মাস্টার মাইণ্ড রাজাকার আব্দুর সবুর খানের নামে খুলনায় রয়ে গেছে ব্যস্ততম রাস্তা 'খান-এ-সবুর রোড'।
১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে ২৭ লক্ষ হিন্দু হত্যা করা হয়েছে; হিন্দু নারী ও বিষয়সম্পত্তি - মাল এ গনিমত হিসাবে জোরপূর্বক ভোগদখল করা হয়েছে।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশের হিন্দুদের উপর মধ্যযুগীয় কায়দায় সাম্প্রদায়িক নির্যাতন চলিয়েছে। যা কিনা একাত্তরের বর্বরতাকেও হার মানিয়ে দিয়েছে। এতকিছুর পরেও হিন্দুরা মজে আছে সর্বধর্ম সমন্বয় ও ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার পাগলামিতে।
সনাতন সদানন্দ দাশ
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................