হিন্দুদের যদি এই ক্ষয় রোধ করা না যায়, তাহলে এই জাতির ভবিষ্যৎ কী?

হিন্দুরা সাধারণত গুরুমুখী। এই গুরুভক্তি পুঁজি করে বিভিন্ন গুরুবাদী সংগঠন, ধর্ম-ব্যবসাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে, চুটিয়ে মুনাফা লুটছে। সহজ-সরল ধর্মপ্রাণ হিন্দুরা, যে যার গুরুসংঘকে মনে করে, জাগতিক সমস্ত জ্ঞানের ভিত্তি।
কিন্তু বাস্তবতা অত্যন্ত করুণ। এই হিন্দু ধর্মগুরু বা আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বরাই, হিন্দু জাতির সর্বনাশের মূল কারণ। এই ধর্মগুরু বা আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বরা, নিজেদের ব‍্যবসায়িক স্বার্থে হিন্দু জাতিকে জ্ঞান-বিমুখ করে ফেলেছে। এরা হিন্দুদের বর্ণ বিভাজন বা জাতপাত উস্কে দিয়েছে; পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণে নিরুৎসাহিত করেছে; এরা হিন্দু জাতির মগজ পচিয়ে দিতে প্রচার করেছে বিষয়-বৈরাগ্যবাদ ও নারীবিদ্বেষ। ফলে, হিন্দুরা অগনিত জাতপাতে বিভক্ত ও দুর্বল হয়ে যায় এবং বিষয়-বিমুখ হয়ে পড়ে। হিন্দুরা বিধবা নারীদের জীবন্ত অবস্থায় চিতায় পুড়িয়ে হত্যা করতে থাকে; বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধ করে- যার দরুন হিন্দু শিশুর জন্মহার কমে যায়; দেশে দেশে হিন্দুর সংখ্যা হ্রাস পায়। ধর্মগুরু ও আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বরা, হিন্দু জাতিকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে পঙ্গু করে ফেলায়- হিন্দুজাতিকে দাসত্ব-শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে ফেলে, ভিন্নধর্মের লোকেরা।

হিন্দুদের আধ্যাত্মিক দর্শনকে সর্বপ্রথম কার্যকরভাবে চ্যালেঞ্জ করে, বৌদ্ধ দর্শন। বৌদ্ধরা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রায় সবগুলো রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ- হিন্দুদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়। ভারতবর্ষের মূল ভূভাগে যখন আরব সম্প্রসারণবাদীরা হামলা চালায়, তখন স্থানীয় প্রভাবশালী বৌদ্ধরা বহিরাগত আরব আক্রমণকারীদের সহায়তা করেছিল। কার্যসিদ্ধির পর, সম্প্রসারণবাদী দখলদাররা সহযোগিতাকারী বৌদ্ধদের সামনে দুটি অপশন রাখে ― হয় ধর্মান্তর নতুবা প্রাণত্যাগ। 

বৌদ্ধরা ধর্মান্তরিত হয়ে প্রাণে রক্ষা পেলেও,হিন্দুজাতি নিক্ষিপ্ত হয়েছিল বিদেশীয় শাসনের ঘোর-নরকে। আরব সম্প্রসারণবাদীরা, হিন্দু জাতির উপর বর্বরোচিত গণহত্যা চালিয়েছে, নারী ধর্ষণ করেছে, হিন্দুদের দেবালয় ধ্বংস ও রূপান্তরিত করেছে, হিন্দু পুরুষদের পুরুষাঙ্গ কর্তন করে ক্রীতদাস এবং হিন্দু নারীদের যৌনদাসী হিসেবে বিদেশে রপ্তানি করেছে।
আরব সম্প্রসারণবাদীদের ধর্মীয় মতাদর্শের মোকাবিলায়, হিন্দু ধর্মগুরু ও আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বরা কোন উৎকৃষ্ট মতবাদ উদ্ভাবন করতে পারেনি। সো কলড আধ‍্যাত্মিক মহামানবরা, বিদেশীয় দখলদারদের নিকট নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করেছে এই বলে যে- কলিযুগে সবাই দাস, সঞ্চয় করো না। সঞ্চয় না করার ফলে, যখন উপার্জন কমে যেত- তখন হিন্দুরা অভাবের তাড়নায় তুর্কি-আরব-ইরানি বণিকদের নিকট সন্তান বিক্রি করে দিতো। হিন্দুরা যখন বিদেশি দখলদারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, তখন ঐ আধ‍্যাত্মিক মহামানবরা প্রচার করেছিল যে, প্রভুরা তোমাদের যতই আঘাত করুক না কেন, ততোধিক প্রেমভক্তি দিয়ে তোমরা প্রভুদের সেবা করবে- পরবর্তীতে যার বিবর্তন ধর্মনিরপেক্ষতা।

আরব সম্প্রসারণবাদীদের সীমাহীন শোষণ, লুন্ঠন ও নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে, হিন্দুরা ধর্মান্তরিত হতে চাইলো। কিন্তু বিদেশীয় দখলদাররা অল্প কিছু হিন্দুকে তাদের ধর্মে প্রবেশ করতে দেওয়ার পর, প্রবেশ দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। দখলদারদের যুক্তি ছিল, "অভিশপ্ত হিন্দুরা যদি আমাদের ধর্মে আসে, তাহলে তাদের বেশ কিছু মানবিক অধিকার দিতে হবে‌। ধর্মান্তরিত হলে হিন্দু পুরুষদের আর ক্রীতদাস হিসাবে বিদেশে রপ্তানি করা যাবে না, হিন্দু নারীদের বানানো যাবেনা যৌনদাসী; সর্বোপরি ধর্মান্তরিত হিন্দুদের দিয়ে আর গরু ছাগলের মতো খাটানো যাবে না।"

আরব সম্প্রসারণবাদীরা ভুলেও তখন কল্পণা করতে পারেনি যে, অল্প কয়েকজন ব্রিটিশ এসে, তাদের লাথি মেরে ক্ষমতা থেকে অপসারিত করবে। যে যত কথাই বলুক, ব্রিটিশ যদি ভারতবর্ষে না আসতো, তাহলে এতদিনে ভারতের হিন্দুদের পরিণতি হতো, আফগানিস্তান কিংবা ইন্দোনেশিয়ার হিন্দুদের মতো। ব্রিটিশ যে কেবল হিন্দু জাতিকে রক্ষা করেছে তা-ই নয়, হিন্দুদের শিখিয়েছে কিভাবে প্রশাসন ও বিচারবিভাগ চালাতে হয়; কিভাবে যোগাযোগ, চিকিৎসা ও শিক্ষা ব্যবস্থা ইত্যাদি গড়ে তুলতে হয়। আমাদের রাষ্ট্রীয় ও দৈনন্দিন জীবনের যাবতীয় কিছু পরিচালিত হচ্ছে ব্রিটিশ প্রবর্তিত নিয়মরীতি-প্রথা পদ্ধতিতে। অবস্থাটা এমন, একজন হিন্দু যদি ব্রিটিশ-বাহিত পাশ্চাত্যের আধুনিক উপকরণ সমূহ ত‍্যাগ করে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে সে পশুস্তরে অধঃপতিত হবে।

ব্রিটিশ প্রবর্তিত আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হিন্দু ধর্মগুরু ও আধ্যাত্মিক ব‍্যক্তিত্বরা ভালো করেই জানত, আরব কিংবা ব্রিটিশদের ধর্মের সাথে টক্কর দেওয়া সম্ভব নয়। তখন তারা নিয়ে আসে নতুন মতাদর্শ, 'সর্বধর্ম সমন্বয়' ও 'যত মত তত পথ'। এটাও লজ্জাজনক আত্মসমর্পণ। কেননা, ইসলাম ও খ্রিস্টধর্মালম্বীরা কখনও হিন্দুদের সনাতন ধর্মের সাথে সমন্বয় করতে ইচ্ছুক নয়। লোকবল, বাহুবল, অর্থবল, রাষ্ট্রসংখ্যা - সবদিক দিয়েই  খ্রিস্টান ও মুসলমানরা হিন্দুদের থেকে অনেক অনেক এগিয়ে।

তবে সমস্ত আধ্যাত্মিক চিন্তানায়কই খারাপ - তা কিন্তু নয়। অল্প কয়েকজন প্রকৃত মহামানব বা যুগনায়কও ছিলেন। যেমন রাজা রামমোহন রায় ও হরি-গুরুচাঁদ ঠাকুর। ভারতীয় রেনেসাঁর জনক রাজা রামমোহন রায় হিন্দুজাতিকে কুসংস্কারমুক্ত ও জ্ঞানমুখী করতে চেয়েছিলেন। হরিচাঁদ ঠাকুর- তদীয় পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর দু'জনই, অস্পৃশ‍্য-অবহেলিত মানুষদের হিন্দুসমাজে ধরে রাখার প্রচেষ্টা চালানোর পাশাপাশি, জাতপাতহীন সমাজ গঠন করে, প্রাপ্তবয়স্কদের সংসারমুখী এবং শিশুদের স্কুলমুখী করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, হিন্দুজাতি যুগে যুগে হীরা ফেলে কাঁচ তুলে নিতে পারঙ্গম।

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ গুলিতে ভয়ঙ্কর অশান্তি; পক্ষান্তরে খ্রিস্টান অধ্যুষিত দেশগুলো পৃথিবীতে সবচেয়ে ধনী, উন্নত ও শক্তিশালী। পৃথিবীর সিংহভাগ চাষযোগ্য জমি, প্রাকৃতিক সম্পদ, প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক কল-কারখানা,বানিজ্য প্রভৃতির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ খ্রিস্টানদের হাতে। একজন শিক্ষিত সচেতন হিন্দুর ধ্যানজ্ঞান বা জীবনের লক্ষ্যই থাকে, খ্রিস্টান অধ্যুষিত আমেরিকা বা পশ্চিম ইউরোপে অভিবাসন গ্রহণ করা, অথবা অন্তত সন্তানদের স্থানান্তরিত করা। একদিকে সাধারণ হিন্দুরা ধর্মান্তরিত হচ্ছে, ধর্মগুরুদের প্রভাবে কন্যাশিশুর ভ্রুণ হত্যা করছে- ফলশ্রুতিতে যেমন হিন্দুর সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে; এর পাশাপাশি শিক্ষিত ও উপযুক্ত হিন্দুরা- যাদের যোগ্যতা আছে সমাজ-রাষ্ট্র বদলানোর, তারা সানন্দে দেশান্তরী হচ্ছে। হিন্দুদের যদি এই ক্ষয় রোধ করা না যায়, তাহলে এই জাতির ভবিষ্যৎ কী?

কৃত্তিবাস ওঝা
২৩/১০/২০২০খ্রিঃ

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted