অগস্ত্য যাত্রা............

Meghnath Bagchi

অগস্ত্য যাত্রা............. ‌🌄

পুরাণে বিন্ধ্য পর্বতের কাহিনী পড়েছেন নিশ্চয়ই। নারদ মুনির উস্কানিতে ব্যাটা এমন মাথা উঁচু করে দাঁড়ালো যে আমাদের সুয্যি মামুর ঘোরাঘুরির রাস্তা বন্ধ! মুস্কিল আসানে নামলেন এক ঋষি। সামনে হাজির হতেই পাহাড় বেচারা ভদ্রতা করে মাথা ঝোঁকালো।মুনি আশির্বাদ করে বললেন, যতদিন না ফিরে আসছি ততদিন এভাবেই মাথা নত করে থাকো। সেই যে গেলেন আর এলেন না। তাঁর নাম অনুসারে চালু হলো এই বাংলা বাগধারা........... অগস্ত্য যাত্রা বা চিরবিদায় !

এতো গেলো পুরাণের কথা, চোখ ফেরানো যাক এবারে পশ্চিমবঙ্গের দিকে। এখানেও শুরু হয়েছে একরকম মহানিষ্ক্রমণ, তবে একা ঐ ঋষির মতো নয়, দলে দলে। মারোয়াড়ি যে বণিক সমাজের পূর্ব পুরুষেরা প্রায় তিনশো বছর আগে বাংলায় এসে এই রাজ্যকে বানিয়েছিল দেশের অন্যতম এক শিল্প বানিজ্যের উৎকর্ষ কেন্দ্র, তারাও আজ পাততাড়ি গোটাচ্ছে । শুধু তারা কেন, বাংলার ভূমিপুত্র যারাই বিদেশে কিংবা ভিন রাজ্যে চাকরি পাচ্ছে তাদের শতকরা ৯৫ ভাগ আর ফিরছে না। বছরে একবার হয়তো দেখতে আসছে বুড়ো মা বাপকে, তাও হয়ে ওঠেনা সবসময়।

পতনের শুরুটা কিন্তু হয়েছিল সেই ১৯৬৩ সাল থেকেই, বিশদে বলতে গেলে ডাক্তার বিধান রায়ের মৃত্যুর পর। বিধান রায় মজবুত করেছিলেন এই রাজ্যের বুনিয়াদ.... শিল্প, বাণিজ্য, শিক্ষা সব ক্ষেত্রেই। দুর্গাপুর স্টিল কারখানা, চিত্তরঞ্জন লোকো, কল্যাণী উপনগরী, দীঘা সৈকত উন্নয়ন ছাড়াও কারিগরি, ডাক্তারি ও অন্যান্য শিক্ষার প্রসার সব তো তাঁর আমলেই। তারপরে....?

কলকাতা ও যাদবপুর, দেশের ঐতিহ্যবাহী দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও এ রাজ্যে রয়েছে IIT, ISI এবং IIM. রয়েছে দেশের প্রাচীনতম সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান........ বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, প্রেসিডেন্সি, স্কটিশ চার্চ ও সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ।

দেশের চার অগ্রণী বাণিজ্য সংস্থা বিড়লা, জেকে, বাঙ্গুর ও থাপার গোষ্ঠীর হেড অফিস ছিল কলকাতার বুকে। টাটাও চেয়েছিল জামশেদপুর কাছে থাকায় তাদের ব্যাবসার মূল কেন্দ্রটি এখানে সরিয়ে আনতে। সেই উদ্দেশ্যে তারা তৈরি করে টাটা সেন্টার। ভারতে ব্যাবসা করা বেশিরভাগ বিদেশি কোম্পানির হেড অফিস ছিল কলকাতায়। আর সেজন্যই একসময় এখানে ছিল নামকরা সব ক্লাব যারা ধরে রেখেছিল বৃটিশ ঐতিহ্যকে, এখানকার সদস্য হতে পারাটাও ছিল বিশেষ গর্বের। বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক উড়ান ছাড়তো দমদম থেকে। সেসব আজ অতীত....!

শিক্ষা সংস্কৃতির পীঠস্থান এই শহর ধাক্কা খেল ১৯৬৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে। রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামে অশোক কুমার নাইট অনুষ্ঠান থেকে আলো নিভিয়ে টেনে আনা হলো যুবতী মেয়েদের। পরবর্তী দুদিনে লেকের আশপাশে থেকে উদ্ধার হলো বেশ কয়েকজনের ধর্ষিত নগ্ন দেহ। প্রতিক্রিয়া জানাতে এক বামপন্থী নেতা ঘটনাকে জাস্টিফাই করে বিবৃতি দিলেন, "The rise of the proletariat against the bourgeoisie."
সেই সূচনা হলো কলকাতা ছেড়ে যাওয়ার.....!

ঘটনার রেশ মিলোতে না মিলোতেই বিড়লা গোষ্ঠীর কর্ণধার আদিত্য বিড়লাকে অফিস পাড়ায় ঠিক জিপিও'র সামনে টেনে নামানো হয় গাড়ি থেকে। জামা প্যান্ট ছিঁড়ে শুধু মাত্র জাঙ্গিয়া পড়িয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো তাদের ইন্ডিয়া এক্সচেঞ্জ প্লেসের অফিসে। উপস্থিত জনতার হাসি ও হাততালির মধ্যে দিয়ে তিনি বাড়ি ফিরে গেলেন। সেই রাতেই প্লেন ধরে মুম্বাই চলে যান, জীবনে আর কলকাতায় পা রাখেননি। ধীরে ধীরে কলকাতা সহ বাংলার সমস্ত অফিস সরিয়ে নিয়ে যান এখান থেকে। মাসখানেকের মধ্যে তাঁকে অনুসরণ করে জেকে এবং থাপার গোষ্ঠীর কর্ণধার। দুঃসাহস দেখাতে টাটা ও জিন্দাল গোষ্ঠী পরিকল্পনা করেছিল এরাজ্যে তাদের NANO এবং JSW BENGAL STEEL এর। মাঝপথে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলো। এসব ঘটনা চোখ খুলে দিল দেশের অন্য শিল্পোদ্যোগীদের, শত আমন্ত্রণেও আর কেউ বাংলায় আসতে রাজি নয়। এটাই কি চেয়েছিল বাংলার রাজনৈতিক দলগুলো ?

এলো ২০১১, শাসন ক্ষমতার ব্যাটন বামপন্থীদের হাত থেকে বেরিয়ে উঠলো দক্ষিণ পন্থীদের হাতে। কিন্তু মানসিকতার পরিবর্তন হলো কোথায় ? বছর চারেক আগে ইন্দোরের এক বাঙালি শিল্পপতি বন্ধ একটি কারখানা কিনে নিলেন বর্ধমান জেলায়। উৎপাদন বাড়াতে যেই উনি লাগোয়া জমি কিনে পাঁচিল তুলতে গেলেন, আসরে নামলো পাড়ার দাদারা। সমস্যা মেটানোর জন্য উনি দ্বারস্থ হলেন রাজ্যের শ্রমমন্ত্রীর, যিনি ঐ জেলারই বিধায়ক। তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করার পরেও মন্ত্রীর সময় হলোনা দেখা করার। দুত্তেরি বলে ভদ্রলোক ফিরে যান ইন্দোরে। ঐ কারখানা এখন ভূতের আড্ডা। অজস্র রয়েছে এরকম উদাহরণ। দাদাগিরি এবং তোলাবাজির দাপটে নাভিশ্বাস উঠেছে এ রাজ্যের ছোট ও মাঝারি উদ্যোগপতিদের। এটাই এখন এ রাজ্যের শিল্প সংস্কৃতি। মুখ বুজে সহ্য করতে পারলে থাকো নইলে ফোটো ! শাসকদলও এনিয়ে মুখ খোলেনা কেননা তারা জানে, 'The best manner to remain in power is not to permit empowerment.' এই একটি ব্যাপারে ডান বাম সবদল সমান!

এবার একটু বিদেশের দিকে নজর দিন। আজ অসংখ্য বাঙালি ইউরোপ ও আমেরিকার নামী প্রতিষ্ঠান গুলিতে শিক্ষক গবেষক বা বিজ্ঞানী হয়ে কাজ করছেন । কিন্তু তাঁরা কি কোনো দিনও রাজ্যে ফেরার কথা উচ্চারণও করেন ? করেন না।
আর আমরা মানে এই রাজ্যের বাসিন্দারা কি করছি.....?
চায়ের কাপে তুফান তুলে আলোচনা করছি, কাশ্মীরি পন্ডিতরা উপত্যকায় ফিরতে পারবে কিনা, অথবা রোহিঙ্গারা মায়ানমারে!

ষাটের দশক থেকে বুদ্ধিজীবী বাঙালির যে মহানিষ্ক্রমণ (Exodus) শুরু হয়েছিল, আজও তা অব্যাহত। আর রাজনীতির চোরাবালিতে দেশের একদা রাজধানী তলিয়ে যাচ্ছে রোজ একটু একটু করে....!
কলমে ✍🏻 স্বপন সেন 🌲
    তথ্য সহায়তা : Paramita Sengupta

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted