ষোড়শ শতকে মধ্যবর্ণ ডমিনেটেড বাঙালি হিন্দু সমাজ, রাজীবলোচন ভাদুড়ী নামক এক ব্রাহ্মণ যুবককে সমাজচ্যুত ও অপমান করে ইসলাম ধর্মে ঠেলে পাঠানোর ফলে, হিন্দুজাতিকে এমন পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে ― বাংলাভাষী হিন্দুরা স্থায়ীভাবে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়ে গেছে।
রাজীবলোচন এক মুসলিম মেয়ে বিয়ে করায়, বাঙালি হিন্দু সমাজ তাকে সমাজচ্যুত করে। রাজীব লোচন প্রায়শ্চিত্ত করে হিন্দু সমাজে ফিরে আসার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেও, সমাজপতিরা সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। হিন্দু সমাজে ফিরে আসার উদ্দেশ্যে, রাজীবলোচন উড়িষ্যার জগন্নাথ মন্দিরে প্রায়শ্চিত্ত করতে গিয়েছিল; কিন্তু সেই মন্দিরে তাকে ঢুকতেই দেওয়া হয়নি। অপমানিত রাজীবলোচন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। এই রাজীবলোচন 'কালাপাহাড়' নামে ইতিহাসে পরিচিত।
অপমানের প্রতিশোধ নিতে রাজীবলোচন সেই জগন্নাথ মন্দির সহ পূর্ব ভারতের অগণিত মন্দির ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়; দেবদেবী অবতারদের বিগ্রহ সমূহ চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলে। ধর্মান্তরিত রাজীবলোচন প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল ― হিন্দুদের কোন দেবদেবী অথবা অবতারের যদি সাহস থাকে, তাহলে তার তরবারির সামনে এসে যেন দাঁড়ায়। যে দেবদেবী অবতারদের হিন্দুরা সর্বশক্তিমান মনে করতো, কালাপাহাড়ের হাতে ভগবানদের সেই শোচনীয় পরিণতি দেখে, অনেকেরই ধর্ম বিশ্বাসে চিড় ধরে। হিন্দুরা দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে আরম্ভ করে। সেই ধর্মান্তর এখনো অব্যাহত আছে।
পূর্ব ভারত তথা বাংলায় ইসলামের আগমন ঘটেছে, উত্তর ও মধ্য ভারতে ইসলাম আসার পরে। কিন্তু পূর্ব ভারতে যত ধর্মান্তর ঘটেছে, তার দশভাগের একভাগ ধর্মান্তর, মধ্য কিংবা উত্তর ভারতে ঘটেনি। বাংলায় হিন্দুদের ধর্মান্তরের মূল কারণ এই রাজীবলোচন। অপরিণামদর্শী সমাজপতিরা যদি সেই প্রতিভাবান ব্রাহ্মণ যুবক রাজীবলোচনকে উপর্যুপরি অপমান করে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য না করতো, তাহলে বাংলাভাষীদের মধ্যে হিন্দুর সংখ্যা আজ মাত্র ৩০.৭% শতাংশে নেমে আসতো না; কমপক্ষে আশি ভাগ থাকতো এবং তাহলে অবশ্যই দেশভাগ হতো না। উল্লেখ্য, পূর্ব বাংলার মুসলমানদের ভোটে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছে।
পূর্ববঙ্গ থেকে হিন্দুদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার পরিকল্পনা প্রণয়নকারী পাকিস্তানি জেনারেলদের অন্যতম- রাও ফরমান আলীর পরিবারটিও ব্রাহ্মণ থেকে ধর্মান্তরিত। সমাজের অত্যাচারে রাও ফরমান আলীর পরিবারটি সনাতন ধর্ম ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল। যে কারণে রাও ফরমান আলী হয়ে উঠেছিল ভয়ঙ্কর হিন্দুবিদ্বেষী। রাও ফরমান আলীর লেখা বই পড়ে আমার মনে হয়েছে, এই লোকটি ছিল সাংঘাতিক জ্ঞানী।
রাও ফরমান আলী আর দশজন পাকিস্তানি সেনা অফিসারের মতো ছিল না। কথাবার্তায় রুক্ষতা, উগ্র মেজাজ, চলাফেরায় সামরিক কর্তৃত্বব্যঞ্জক হাম্বিতাম্বি - কোনটাই ছিলোনা তার মধ্যে। মুখে সদাপ্রসন্নময় মধুর হাসি, মিহিস্বরে কথাবার্তা, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা- সব মিলিয়ে তাকে অনেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের মতো মনে হতো। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে নিপাট ভদ্রলোকসদৃশ্য রাও ফরমান আলী ছিল প্রকৃতপক্ষে একজন ঠাণ্ডা মাথার খুনি- নৃশংস জেহাদি। বাংলাদেশের হিন্দু প্রভাবিত বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইণ্ড ছিল এই নব্য-কালাপাহাড় রাও ফরমান আলী।
একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে যে, হিন্দুদের কাণ্ডজ্ঞানের বড়ই অভাব। হিন্দুরা সমাজে লোক ধরে রাখতে জানে না। পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্থপতি কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর পরিবারটি বৈশ্য বর্ণ থেকে ধর্মান্তরিত। কাশ্মীরের অবিসংবাদিত নেতা শেখ আব্দুল্লাহর পিতামহ ব্রাহ্মণ থেকে ধর্মান্তরিত।
পূর্ববঙ্গের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে আমি বেড়ে উঠেছি। যেখানে সমাজের কর্তৃত্ব তখন মধ্যবর্ণের হাতে ছিল। সরকারি চাকরি থেকে সদ্য অবসর নেওয়া এক মধ্যবর্ণের পৌঢ় সমাজপতি,আমার প্রতিবেশী শীল পদবীর এক বাল্যবন্ধুর পরিবারটিকে গ্রামছাড়া করেছিল। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে, আমার সেই শিশু-বন্ধুটির পরিবার এত দরিদ্র ছিল, তাকে বিবস্ত্র অবস্থায় সারাদিন ঘুরে বেড়াতে হতো। শীতকালে সে একটি রিলিফের ছেড়া কম্বল গায়ে জড়িয়ে শীত নিবারণ করতো।
মধ্যবর্ণের সমাজপতি যখন সেই শীল পরিবারটির বিরুদ্ধে বিচারসভা বসায়, আমি তখন অবুঝ শিশু হলেও, গাছে উঠে সেই বিচারসভা প্রত্যক্ষ করেছি। আমার সেই বন্ধুর তিনটি দিদি ছিল, তাদের মধ্যে দুই দিদি তখন বিবাহযোগ্যা। কিন্তু তাদের উত্তমাঙ্গ আবৃত রাখার মতো পর্যাপ্ত বস্ত্র ছিল না। এজন্য সমাজপতি অভিযোগ তোলে - তাদের দেখে পাড়ার যুবকরা বিগড়ে যাবে...
গ্রামছাড়া সেই শীল পরিবারটি বরিশাল শহরে বসবাস করতে গিয়ে, ভিন্ন ধর্মের একাধিক লোকের নিকট ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সেই ঋণ শোধ করতে না পারার ফলে, পরবর্তী সময়ে ভিন্ন ধর্মের পাওনাদাররা একে একে ঐ পরিবারের তিনটি মেয়েকেই জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যায় এবং পতিতালয়ে বিক্রি করে দেয়।
হায়রে হিন্দু সমাজ!
সনাতন সদানন্দ দাশ
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................