Courtesy Joydeep Bhattacharya
"কাশেম মিঞা আছো নাকি?"
দাওয়া ঝাঁট দিচ্ছিল আমিনা।হাত থেকে তাড়াতাড়ি ঝাঁটা ফেলে হিজাবটা একটু আঁট করে নিয়ে শশব্যস্ত হয়ে সামনে এসে দাঁড়াল।
"আরে, হুজুর সাব আইসেন যে! আসেন আসেন। বয়েন এহানে।"
"আমি বইতে আই নাই। মিঞারে ডাকো। কথা আসে।"
"ওনার লগে কি কাম আসে?"
"মিঞারেই কমু, তোমায় কইয়া কি অইব?"
আমিনা ডাকতে গেল কাশেম কে।
হুজুর সাব বাসার চারধারে দেখছিলেন। না, কাশেমটা বড্ড গরীবই রয়ে গেল। কোনমতে একটা বাড়ি তুলেছে। এতগুলো ছেলেমেয়ে নিয়ে খুব কষ্ট করে থাকে। মনে হয় ঠিকমতো খাওয়াও জোটে না।
কাশেম এসে কিছুটা জড়সড় হয়ে দাঁড়াল।
হুজুর বলতে লাগলেন, "কাশেম কি শুনত্যাসি, তোমার সেজ পোলাটা সতীশের মাইয়া টার লগে ঘুরঘুর করত্যাছে।"
"হ হুজুর সাব। ঠিকই শুনত্যাসেন।"
"একটা কাফের, মালাউন মাইয়ার লগে ঘুরঘুর করা ঠিক কাম না। কইয়া দিতে পারবা না তোমার পোলারে?"
"কয়েছিলাম সাব। আনোয়ার কইল অরে নিকা করবে।"
"কও কি? মাইয়া রাজী আসে নাকি?"
"আনোয়ার কইতে পারবে। আনোয়ার কোথা গিয়েছস? হুজুর সাবের সামনে আইয়া ক।"
"কি রে আনোয়ার, মাহফিল শুনতে যাস না যে বড়? নামাজ পড়াও ছাইড়া দিছিস নাকি?"
"না হুজুর সাব। আপনি যে কন বেশি বেশি কইরা কাফেরগো এসলামের দাওয়াত দিতে অইব।"
"ঠিকই তো কইছি। সোয়াব হবে।"
"আমি সতীশের মাইয়া টুসিরে নিকা করুম। টুসি রাজী আসে। কলমা পইড়্যা নিবে কইছে।"
মুখে হাসি খেলে গেল হুজুর সাবের।
"তোমার পোলা কামের আসে, বুঝলা কাশেম।হ ভালো কথা। সতীশের বিঘা চারেক জমি আসে না? বাজারে একখান দোকানও তো আসে?"
"হ, আসে সাব।"
"পুরা পরিবারটারে এসলামে আসার দাওয়াত দিতে পারবা না।"
"চ্যাষ্টা কইরা দেখুম। না অইলে আপনি হুজুর সাব তো আছেনই।"
এই ঘটনার কিছুদিন পর একটি প্রথম সারির দৈনিকে নাম পদবী পরিবর্তনের কলামে একটি বিজ্ঞাপন বেরোল: " আমি অতসী প্রামাণিক, পিতা সতীশ চন্দ্র প্রামাণিক, নিবাস টুঙ্গি ইউনিয়ন, এতদ্দ্বারা ঘোষণা করিতেছি যে আমি কোনপ্রকার ভীতি এবং পারিপার্শ্বিক চাপ ব্যতীত সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করিয়া ইসলাম গ্রহণ করিতেছি এবং আজ হইতে আমি সর্বত্র পারভীন খাতুন বলিয়া পরিচিত হইব।"
সতীশ তার মেয়ের এই সিদ্ধান্তে অত্যন্ত মুষড়ে পড়েছিল। অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছিল তার মেয়েকে। কিন্তু মেয়ে জিদ ধরে বসেছিল আনোয়ারকেই বিয়ে করবে। শেষমেশ সতীশ আর ওর স্ত্রী স্নেহলতা ঠিক করল মেয়ের আর মুখ দেখবে না। বরাবরের জন্য মেয়ের আসা বন্ধ ওদের বাড়িতে। সতীশের ছেলে দিব্যেন্দু বন্ধু মহলে অস্বস্তি এড়াবার জন্য কিছুদিন বাইরে বেরোনো বন্ধ রাখল। পাড়া প্রতিবেশিরাও সতীশদের এড়িয়ে চলছিল। এভাবেই কিছুদিন কাটল।
" না না আমি কিছুতেই পারুম না। আমারে বলেন না হুজুর সাব। আমি নওমুসলিম অইবনা "। সতীশের বাড়ির দাওয়ায় দাঁড়িয়ে আছেন পীরগঞ্জের হুজুর, সঙ্গে অনেক সাঙ্গপাঙ্গ।
" মাইয়াডা তো তোরে ছাইড়া চইল্যা গ্যাসে। অহন তোর পোলা আর ইস্ত্রি ছাইড়া গ্যালে ভালো অইব কি, ক? তার উপর তোর জমি জিরেত, দোকান এহকল সামলাইয়া রাখবি ক্যামনে?"
সতীশ হাতজোড় করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, " ছাড়ান দ্যান, আমি পোলা আর অর মা'রে লইয়া ইন্ডিয়া চলি যামু"
ধমকে উঠলেন হুজুর সায়েব " যামু কইলেই কি যাওন যায়। আমি যদি থানায় গিয়া কয়া দিই সতীশ আমার বাসায় চুরি কইরা ইন্ডিয়া পলাইত্যাছে। ভাবছস কি অইব? হ্যারা সব সাক্ষী দিবে। তার চে ভালো কইতেছি পরিবারে লইয়া হুই মসজিদে চল। ঘন্টা কয়েকের কাম। নামও ভাইবা রাখসি, সতীশ হতি শওকত। পোলাডা আর বিবির নামখান তুই ঠিক কইরা ফ্যাল। আর কথা বাড়াস না, এসলাম কবুল করলি তোরে এনায়েতপুর বড় মসজিদের মৌলভী বানায়া দিমু। হেফাজতের নেতার লগে কথা অয়েছে। "
সতীশ বুঝল এদের হাত থেকে কোন নিস্তার নেই। সব রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে এরা। চোখের জল মুছে উঠোনের এককোনে তুলসীমঞ্চের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সতীশ, তারপর ছেলে বৌকে ডেকে হুজুরের পেছন পেছন চলল মসজিদের দিকে।
[ ওপার বাংলায় সতীশদের শওকত, অসীমদের ওসমান, শ্রাবণীদের শবনম হয়ে যাওয়ার গল্প। এভাবেই 32% কমতে কমতে আজ 8%. ধর্ম ত্যাগ মানে শুধু নাম পদবী পরিবর্তন বা ধর্মীয় রীতিনীতি ত্যাগ নয়। নিজের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ,পরম্পরা সবকিছুকে বিসর্জন দেওয়া। এককথায় নিজের শিকড় কেটে ফেলা। হাজার হাজার সতীশ, অসীম এভাবেই নিজের শিকড় কেটে ফেলতে বাধ্য হয়েছে বা শিকড় কেটে ফেলার ভয়ে সবকিছু ছেড়ে এপারে চলে এসেছে। তবুও বলা হয় "একটা ব্যাপার হয়েছিল, ভূমি সংস্কার হয়েছিল, ইত্যাদি ইত্যাদি" ( নোবেল সেন উবাচ)। এর চেয়ে বড় পরিহাস সম্ভবত আর নেই। ]
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................