মুসলমানদের রোষাণলে পড়ার ভয়ে তারা 'গুড হিন্দু' সেজে থেকেছেন।

বাংলাদেশের দুইজন সিনেমা পরিচালক নারায়ণ ঘোষ মিতা, সুভাষ দত্ত মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সিনেমা বানিয়েছিলেন। রোমান পোলানস্কি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইহুদি নিধন নিয়ে যে রকম সিনেমা তৈরি করেছিলেন সেরকম আলাদা ফোকাস দিয়ে একাত্তরের 'হিন্দু ম্যাসাকার' নিয়ে তারা কেউ সিনেমা তৈরি করেননি। সুভাষ দত্ত ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষীর’ মিতা বানালেন ‘আলোর মিছিল’।
কোথাও ‘হিন্দু’ শব্দটি পর্যন্ত নেই। আজকে যখন মুক্তিযুদ্ধের গবেষকরা ‘হিন্দু ম্যাসাকার’ শুনলেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেন তার কারণ এগুলো নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পর কেউ কথা বলেনি। রোমান পোলানস্কি ইহুদী ছিলেন। তাই তাকেই বলতে হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদীদের যন্ত্রণার কথা। ইহুদী ছাড়া সেই গল্প তো অন্য কেউ বলতে পারবে না। একাত্তরে হিন্দুর কি যন্ত্রণা, কেন সে মুসলমানের চেয়ে বেশি বিপদগ্রস্ত ছিলো সেটা হিন্দুকেই বলতে হবে। কিন্তু মুসলমানদের রোষাণলে পড়ার ভয়ে তারা 'গুড হিন্দু' সেজে থেকেছেন।

আজকে যখন আমি একাত্তরে পাকিস্তানী সোলজাররা আলাদা করে হিন্দু জেনোসাইড করেছে বলি তখন এইসব ‘মুক্তিযুদ্ধের গবেষকরা’ আমাকে বিজেপির এজেন্ট,  হিন্দুত্ববাদী বলে। হিন্দুরা এখনো মুখে কসটেপ মেরে বসে আছে। তারা গিয়ে চেতনার গবেষকদের প্রশ্ন করতে পারে না, যুদ্ধাপরাধী ট্রাইব্রুনাল আরপি সাহা মামলার রায়ে যখন বলেছিলো, “কেবল ব্যক্তি বা পরিবার নয়, ওই হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য ছিল পুরো হিন্দু সম্প্রদায়কে ধ্বংস করা” তখন কি সেই রায় হিন্দুত্ববাদীরা লিখে দিয়েছিলো?

না হিন্দুরা সেই কথা বলে বিরাগভাজন হতে চায় না। যদি তাদের সাম্প্রদায়িক হিন্দু বলে তাহলে তো আর জাতে উঠা যাবে না! যে সব হিন্দুরা বাস্তবে আমাকে চেনে আমার ধর্মহীন জীবনযাপনের পরও তাদের কাছে আমি ‘মুসলমানই’! এই অনলাইনে এদেশে হিন্দুদের উপর ঘটা সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে লিখে নাম লিখিয়েছি ‘হিন্দুত্ববাদী’। হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে লিখলে হিন্দুরা এসে তাদের আসল চেহারা আমাকে দেখিয়ে যায়। কোনটাই গায়ে মাখি না। আমি নিজের ভেতরে যে অন্যায়ের প্রতি সোচ্চার হওয়ার প্রেরণা সেসব থেকেই আমি লিখি। কিন্তু আপনি তো কথা বলবেন আপনার পরিবার, স্বজনের উপর ঘটে যাওয়া সেই ইতিহাস যা কেবল ‘বাঙলী জাতি’ ঘোরাটোপে আড়াল করা হচ্ছে। আপনি যত বড় দেশপ্রমিক বাংলাদেশী ভাবেন না কেন আপনার নাম আপনাকে ঐসব গবেষকদের কাছে আপনি 'হিন্দুই'। কেন না উনারা বুক ঠুকে নিজেদের ‘বাঙালী মুসলমান’ বলেন।

আগেও একবার বলেছি, আবারো বলছি লেখার প্রাসঙ্গিক বলেই, মুক্তিযুদ্ধে শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়ার সংখ্যাটা মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থী শিবির ঘুরে গিয়ে দ্য টেস্টিমনি অব সিক্সটি’তে লেখেন, শরণার্থীদের অধিকাংশই ছিলো হিন্দু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আশফাক হোসেন বলেন, ‘শরণার্থীদের বড় অংশ আশ্রয় নিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে; বাকিরা ত্রিপুরা ও আসামে। অবস্থা এতটাই নাজুক হয়ে পড়ে যে, ১৯৭১ সালে শরণার্থীদের সংখ্যা ত্রিপুরার মোট জনসংখ্যার সমান হয়ে যায়। ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত শরণার্থীর সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পেয়ে ৯৮ লাখ ৯৯ হাজার ৩০৫ জনে এসে দাঁড়ায়। শরণার্থীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিল হিন্দু। আগস্ট ১৯৭১ পর্যন্ত হিন্দুদের সংখ্যা ছিল ৬৯ লাখ ৭১ হাজার এবং মুসলিম ও অন্য ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা ছিল প্রায় ছয় লাখ।’

আহমদ ছফার উপন্যাস ‘অলাতচক্র’ পড়ে দেখুন, সেখানেও ছফা লিখেছেন, মুসলমান ছেলেরা ভারতে এসেছিলো একা, তাদের পরিবার ছিলো বাংলাদেশে। কিন্তু হিন্দুরা পুরো পরিবার নিয়ে এসেছিলো। কেন? কারণটা অ্যান্টনি মাসকারেনহাস তার ‘রেইপ অব বাংলাদেশে, তুলে ধরেছেন। কুমিল্লায় ১৪ নং ডিভিশনের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে তিনি তথ্য সংগ্রহ করেন পাকিস্তানীরা গণহত্যার জন্য কয়েকটি ক্যাটাগরিতে জনসাধারণ বেছে নিয়েছে। যথাক্রমে-
১। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈনিক পূর্ব পাকিস্তান রাইফেল বাহিনীর লোক, পুলিশ এবং আধা সামারিক আনসার ও মুজাহিদ বাহিনীর লোক।
২। হিন্দু সম্প্রদায়
৩। আওয়ামী লীগের লোক- নিম্নতম পদ থেকে নেতৃত্বস্থানীয় পদ পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরের লোক, বিশেষ করে এই দলের কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য ও স্বেচ্ছসেবকগণ।

মুসলমান কলেমা পড়ে রক্ষা পেলেও হিন্দুর কোন সুযোগ নেই। এটাই ছিলো পাকিস্তানীদের সিদ্ধান্ত। মুক্তিযুদ্ধ তো ধর্মের ভিত্তিতে হয় নাই। কিন্তু পাকিস্তানীদের কাছে এটা ছিলো ইসলাম ও মুসলিম জাতিকে রক্ষার যুদ্ধ। তারা এর জন্য আওয়ামী নেতৃত্ব ও হিন্দু সম্প্রদায়কে দায়ী করেছিলো। দৈনিক সংগ্রাম এ জন্য মুক্তি বাহিনীর কেউ ধরা পড়লে শিরোনাম করত ‘ভারতীয় চর আটক’! স্বাধীনতা যুদ্ধে হিন্দু সম্প্রদায়ের আলাদা করে যে আত্মত্যাগ সেটাকে ইতিহাসের স্বীকৃতি দিলে 'আওয়ামী মুক্তিযুদ্ধের গবেষকদের' এত অনিহা কেন? আর হিন্দুদের কথা কি বলব! ভারতবর্ষে তৈমুর লং মানুষের মাথা দিয়ে পিরামিড বানিয়ে উল্লাস করেছিলো। অথচ ভারতীয় মুসলমানদের অহরহ নাম তৈমুর রাখা হয়। বিশ্বে কোথাও কিন্তু হিটলার নামটি আর রাখা হয় না। কারণ বিশ্ব হিটলারকে ঘৃণা করেছে। তার ইহুদী ঘৃণা নিয়ে মানুষ চর্চা করেছে। ভারতের মুসলমানরাও তাদের সন্তানদের নাম তৈমুর রাখত না। একজন খুনির নামে কেউ সন্তানের নাম রাখবে না। কিন্তু ভারতবর্ষে সুলতান মাহমুদ, তৈমুর লং জাস্ট ইতিহাস হিসেবে পঠিত হয়েছে। হিটলারের মত নৃশংসভাবে নয়। বাংলাদেশে হিন্দু ম্যাসাকার বললেই একদল গবেষক হিন্দুত্ববাদী বলে যেভাবে চেঁচায় আর হিন্দুরা ‘পাশে আছি ভাই, মোল্লা আর হিন্দুত্ববাদী দুইটাই খারাপ- বলে যেভাবে সহমদ হিন্দু সাজছে তাতে এই ইতিহাস চিরকালের মত বিস্মৃত হয়ে যাবে। আমার কি!

#সুষুপ্ত_পাঠক

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted