ইতিহাস কাঁদে

ইতিহাস কাঁদে :
---------------------
১৯৫০ এ, পূর্ব পাকিস্তানের একতরফা হিন্দু নিধনের ঘটনাবলী খ্যাতনামা জননেত্রী লীলা রায় সম্পাদিত 'জয়শ্রী' পত্রিকাতে, বিস্তারিত লেখেন জয়ন্ত দাশগুপ্ত। শিরোনাম ছিল ' পূর্ব বাংলার হত্যালীলার মর্মর্ন্তুদ কাহিনী',সেই লেখা থেকে সেদিনের বাঙালি মুসলমানের লুক্কায়িত গৌরবগাঁথার কিছু আপনাদের সামনে তুলে ধরছি:

তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে ভুক্তভোগী ও হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে। ট্রেনে. স্টিমারে বা নৌকায় নানাকাজে গন্তব্যস্থলের দিকে রওনা হওয়া নির্দোষ নর নারী শিশু বৃদ্ধ সেদিন আর বাড়ি ফিরে আসতে পারেনি। খন্ডিত হয়েছে এই ঘাতকের অস্ত্রে ! মুসলমান ঘাতকদের প্ল্যানটা ছিল চমৎকার ও প্রখর বুদ্ধি দীপ্ত। রাস্তাঘাটে খুন করলে কে বা কাকে চেনে, কেই বা রিপোর্ট করবে ?
বডি গুলো জলে ফেলে দিলে বা মাটিতে পুঁতে দিলে খেল খতম ! চলমান নারীর ইজ্জত হরণ করলে এই কালবেলায় কেইবা আটকাবে ? এই পদ্ধতিতে ১১ই ফেব্রুয়ারী ১৯৫০ থেকে টানা ৫-৬ দিন চলতে থাকে খুন-জখম, ধর্ষণ। কখনো ট্রেনের কামরায় ছুরি মেরে চলন্ত ট্রেনের জানালা থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছে, কখনো ট্রেন থামিয়ে কামরায় কামরায় মানুষকে হত্যা করে লাশ জলে ফেলা হয়েছে। সহযোগিতা করেছে ট্রেন চালক, গার্ড এবং আনসাররা। কুলিরা গর্ত খুঁড়ে বডিগুলোকে পুঁতে দিয়েছে। ১০ই ফেব্রুয়ারি, গোয়ালন্দ থেকে নারায়ণগঞ্জের স্টিমার ছাড়লো কিন্তু মুন্সীগঞ্জে মুসলমান দাঙ্গাকারীরা স্টিমারের সমস্ত যাত্রীদের নামিয়ে দিল। যাত্রীরা ভয়ে পালালো, আর নানা পথ ঘুরে ১২ তারিখ নারায়ণগঞ্জ পৌছলো। নারায়ণগঞ্জ থেকে যে যার গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য সকল হিন্দু যাত্রীরা ট্রেনের দুটো কামড়ায়ে উঠে পরলো সকাল ৮ টা তে। স্টেশনের অবস্থা সন্দেহজনক সকলেরই ভয়ে বুক দুরুদুরু করছে। রেল অফিসাররা সাহস দিয়ে বলল নরসিংদী, ভৈরব যেতে কোন ভয় নেই, নিরাপদে যেতে পারবেন। চারজন সশস্ত্র পুলিশ দুটো কামরায় দেওয়া হল। ট্রেন গেন্ডারিয়া স্টেশনে পৌঁছানোর পরে দেখা গেল হিন্দু-মুসলিম মিশ্রিত কামরাগুলো থেকে হিন্দুদেরকে ছুরি মেরে লাশগুলো জানালা থেকে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। দু কামরা ভর্তি হিন্দুর প্রাণ কেঁপে উঠল ! দয়াগঞ্জ পুল পেরোতেই ট্রেন হঠাৎ করে থেমে গেল 8 জন সশস্ত্র পুলিশ নেমে গেল। ট্রেনের দুপাশে অপেক্ষা করা মুসলমান দাঙ্গাবাজরা কামরাগুলোতে অস্ত্রসহ উঠে পরলো। শুরু হলো ছুরি ও লোহার ডান্ডা দিয়ে একতরফা হিন্দু খুন। ট্রেনের কামরা রক্তে ভেসে যেতে থাকলো। লোক মারে আর লাশগুলোকে কামড়ার বাইরে ফেলে ! ৮০ বছরের বৃদ্ধা ভুবনেশ্বরী দাসকে অজ্ঞান অবস্থায় ট্রেনের বাইরে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হল। ভুবনেশ্বরী কে কেউ একজন তুলে ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি করেছিল, তিনি সে যাত্রা বেঁচে গিয়েছিলেন। এরপরে এলো নাজিরবাজার পুল। সেখানেও ট্রেন থামিয়ে হিন্দুদের নির্বিচারে হত্যা করা হলো। দুটি কামরার মাত্র জন যাত্রী ভাগ্যক্রমে বেঁচেছিল। পরবর্তীতে আপনাদের বলব আরো অভিজ্ঞতার কথা।

দূরদর্শী ছিলেন বটে আমরা ঠাকুরমা ! এই ঘটনা যে আগামীতে ঘটতে চলেছে, তা আঁচ করে ১৯৫০ এ পরিবার নিয়ে জন্মভিটে ছেড়ে এপার বাংলায় পারি দিয়েছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলা, অধুনা বাংলাদেশ আপনি ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বাঙালি মুসলমানের বহু লেখা, বহু দলিল, দস্তুর খুঁজে পাবেন, কিন্তু বাঙালি মুসলমানের এই লুক্কায়িত গৌরবগাঁথার কথা আপনি কোথাও কোন বাঙালি মুসলমানের লেখাতে নথিবদ্ধ পাবেন না।

এর কারণ কি তাকিয়া না লজ্জা ?

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted