নচিকেতা কি জীবনে একবারও পূর্ববঙ্গের মুসলিম লীগকে বিজেপির মত করে ঐতিহাসিক সাম্প্রদায়িক শক্তি বলেছে?

আমার এক ফেইসবুক বন্ধু আজকে বললেন, সংগীত শিল্পি নচিকেতা যে বলল বাংলা গুজরাট হয়ে যায়নি সেটা তৃণমূল কংগ্রেসের বিজয়ে নিশ্চিত হয়েছে। আমার ফেইসবুক বন্ধুর প্রশ্ন, গুজরাট থেকে কি লোকজন পালিয়ে গেছে? 

আমাকে স্বীকার করতেই হলো যে সেরকম কিছু ঘটেনি। সত্যি কথা বলতে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতা আসার পর এতগুলি বছরে ভারত থেকে কোন মুসলিম শিখ জৈন ইহুদী খ্রিস্টান জনগোষ্ঠির দেশত্যাগের কোন ঘটনা ঘটেনি। অথচ মোদির সময়কালটুকু ধরে একই সময় বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে যে বিপুল পরিমাণ হিন্দু খিস্টান জনগোষ্ঠি দেশত্যাগ করেছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের কারণে, নিরাপত্তাহীনতার কারণে, রাষ্ট্রীয় নতুন আইনের কারণে, ইসলামিক পার্টিগুলোর উত্থানের ভয়ে- সেই তুলনায় নরেন্দ্র মোদি বা তার হিন্দুত্ববাদ এই উপমহাদেশে একক দৈত্য হিসেবে কি করে চিত্রিত হলো?

এই যখন ভাবছি তখন ভারতের দি হিন্দু পত্রিকার একটি রিপোর্ট আমার চোখে পড়ল। বলতে গেলে চোখ বড় বড় হয়ে গেলো! দি হিন্দু বলছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু জনগোষ্ঠির ৮১ শতাংশ মনে করে ভারত কেবল হিন্দুর দেশ নয়, ভারত সব ধর্ম জাতির দেশ। আর পুরো ভারতের ৭৪ শতাংশ হিন্দু জনগোষ্ঠি মনে করে ভারত কেবল হিন্দুর দেশ নয়, সব ধর্ম জাতির। ভারতে চালানো লোকনীতি-সিএসডিএস পরিচালিত একটি সমীক্ষায় লিখিত প্রশ্ন করে সারা দেশের জনগোষ্ঠির কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিলো নানা বিষয়। এই সমীক্ষায় বুঝা গেলো ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই সেক্যুলার! এমনকি যারা বিজেপিকে ভোট দেন তাদের ৫৮ শতাংশ মনে করেন সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের পছন্দ না হলেও সরকারকে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। তাহলে ভারতে হিন্দুত্ববাদের উত্থানের যে ভীতজনক কথা শুনি তার ভিত্তি কি? 

বাংলাদেশ কিংবা পাকিস্তানে ১০ শতাংশ মুসলিম কি পাওয়া যাবে যারা মনে করে এই দেশ দুটি কেবল মুসলিমদের নয় অন্য ধর্ম ও সম্প্রদায়েরও? আমরা খুব ভালো করেই জানি যে এই দুটি দেশের মুসলিম জনগোষ্ঠি এরকম মনে করেন না বলেই ওখানকার রাজনৈতিক নেতারা একেকজন বিশিষ্ট পরেজগার মুসলিম সেজে থাকেন। বাংলাদেশের জনগণ যখন মুসলিম লীগের 'মুসলিম জাতীয়তাবাদে' বেহঁশ ছিলো তখন নচিকেতাকে তার জন্মভূমি ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিতে হয়েছিলো দেশভাগ করে। কিন্তু গুজরাটে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগার পর কি সেখান থেকে মুসলিমরা শূন্য হয়ে গিয়েছিলো? এই এক অদ্ভূত ব্যাপার- নচিকেতা কি জীবনে একবারও পূর্ববঙ্গের মুসলিম লীগকে বিজেপির মত করে ঐতিহাসিক সাম্প্রদায়িক শক্তি বলেছে? কিংবা কখনো বলেছে পশ্চিমবঙ্গ প্রমাণ করেছে তারা বাংলাদেশ নয়? বলেনি। বাংলাদেশ এখন ‘মুসলিম কান্ট্রি’। কিন্তু গুজরাট কিংবা গোটা ভারত ‘হিন্দু কান্ট্রি’ নয়। দি হিন্দুতে প্রকাশিত সমীক্ষায় আশ্চর্যজনক জনমত উঠে এসেছে। যেখানে বিজেপিকে ভোট দেন এমন ভোটাররাও ধর্মনিরপেক্ষতা ও বহুত্ববাদের পক্ষে মত দিয়েছেন! 

ভারত বহু জাতি ধর্ম সম্প্রদায়ের দেশ। এখানে হিন্দুদের মধ্যেই জটিল সব জাতপাত, উঁচু নিচু কাস্ট গোত্রের সমাজ ব্যবস্থা কম বেশি বিভিন্ন জাতির মধ্যে এখনো টিকে আছে। কাজেই ভারতের মত বিশাল দেশে ধর্মীয় সমস্যা যে সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস্যু হবে সেটাই স্বাভাবিক। ভারতের গুজরাটের ‘দাঙ্গার’ জন্য অবশ্যই নরেন্দ্র মোদি দায়ী কারণ তার সরকার তখন সেখানে এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে হিন্দু দাঙ্গাবাজদের পক্ষালম্বণ করেছিলো। কিন্তু মনে রাখতে হবে সেখানে ‘দাঙ্গা’ হয়েছিলো। সেখানে হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায় খুনোখুনিতে লিপ্ত হয়েছিলো। অতিসম্প্রতি দিল্লিতেও একই ঘটনা ঘটে। কিন্তু পাকিস্তানে একজন নার্স একটি পুরাতন আলমারী সরাতে গিয়ে কলেমা লেখা স্টিকার ফেলে দিয়েছে এমন অভিযোগে হাজার হাজার মুসলমান খিস্টান পল্লীতে হামলা চালায়। সেখানে কিন্তু ‘দাঙ্গা’ হয়নি। আসিফা বিবি নামের খিস্টান নারীকে ইসলাম অবমাননার অভিযোগে ফাঁসির আদেশ থেকে যখন সুপ্রিমকোর্ট মুক্তি দেয় আন্তর্জাতিক চাপে তখন পুরো পাকিস্তান ক্ষোভে ফেটে পড়ে। পুরো পাকিস্তানের খিস্টান সমাজ ভীত সতস্ত্র হয়ে পড়ে। পাকিস্তানের হিন্দু নারীদের অপরহণ করে ধর্মান্তকরণ একটি সাধারণ ঘটনা যা মিডিয়াতে আসে না গুরুত্বহীন বলে। তবু পাকিস্তানে ভয়ংকর কোন মতবাদ উত্থান হয়েছে বলে বিশ্ববাসী মনে করে? হিন্দুত্ববাদের মত বাংলাদেশ-পাকিস্তানের সামাজিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি আলোচিত হয়? হয় না। কেন হয় না? এই প্রশ্নগুলোর মিমাংসা করতে হবে। আমার মনে হয় পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির ভোটার যারা “ধর্মনিরপেক্ষতা ও বহুত্ববাদের” পক্ষে তারা এই কারণেই বিজেপিকে ভোট দিয়েছে। তারা ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ বা ‘মনুর আইনে’ দেশ চালানোর জন্য ভোট দেয়নি। নচিকেতাদের মত সেক্যুলার প্রগতিশীলরা বিজেপির ভোট বাড়ার কারণ আজ পর্যন্ত ধরতে পারছেন না। পশ্চিমবঙ্গে এবারে বিজেপির আসন বৃদ্ধির অর্থ এই না বাঙালীরা রামরাজ্য চায়। বরং ভোটের শতাংশে বিজেপির ভোট কিছু কমেছে পশ্চিমবঙ্গে। সেই কমার কারণ পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুরা বিজেপির কাছে রামরাজ্য বা মুসলিম বিরোধীতা আশা করে না। তাহলে বিজেপির শক্তিশালী হয়ে উঠার কারণ অন্য কিছু। হিন্দুরা ‘ইসলামিক রাষ্ট্র’ ‘শরীয়া আইন’ প্রতিষ্ঠার মত করে বিজেপিকে বা নরেন্দ্র মোদিকে নির্বাচিত করেনি। এটি সম্ভবত নরেন্দ্র মোদি বা অমিত শাহও বুঝতে পারেনি। বিজেপিকে অচিরেই মুসলিম বিরোধীতা থেকে বের হতে হবে। সম্ভবত ভারতের অমুসলিমরা (শুধু হিন্দু নয়) বিজেপির কাছে কালচারাল নিরাপত্তা আশা করে। আবার বলছি "কালচারাল নিরাপত্তা" আশা করে। এই নিরাপত্তা তারা বাংলাদেশ পাকিস্তানে দেখে না। ভারত সেরকম কোন রাজনৈতিক পরিণতির দিকে যেতে পারে ভেবেই তারা বিজেপিতে ঝুঁকে পড়েছে। সাম্প্রদায়িকতা, সোজা কথা মুসিলম বিরোধীতার জন্য বিজেপির ভোট বাড়েনি। জনগণের মনে হয়েছে কংগ্রেস বা বামপন্থিরা সেটি করতে আর আস্থাভাজন নয়।

#সুষুপ্ত_পাঠক
Susupto Pathok

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted