আমার পূর্ব পুরুষের উত্তরসূরীদের রক্তের দাগ এই বাংলাতেও

আমার পূর্ব পুরুষের উত্তরসূরীদের রক্তের দাগ এই বাংলাতেও 
-----------------------------------------------------------------------------
এক ভূখণ্ডে উদ্বাস্তু হয়ে যাওয়াটা বোধহয় একটা অভিশাপ। সেই অভিশাপ বহন করেছিল আমার পূর্ব পুরুষরা, অবিভক্ত ভারতের পূর্ব বাংলায়। এখানেই শেষ নয়, আমার পূর্ব পুরুষদের উত্তরসূরীরাও এই অভিশাপের মূল্য চুকিয়েছিল তাদের রক্তের বিনিময়ে, বিভক্ত ভারতের পশ্চিম বাংলায়। কাদামাটি আর সমুদ্রের নোনা জলের গন্ধ-মেশা হোগলা বনের দ্বীপ, মরিচঝাঁপি ।
আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর বছর আগে মরিচঝাঁপির অলস শান্ত দ্বীপে গোলাগুলি চলেছিল। মনে পরছে ? নাকি আত্মবিস্মৃত বাঙালি ভুলে গেছে ? পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুরা, পিঁপড়ের সারির মতো, শুধু বেঁচে থাকার আর্তি সম্বল করে পশ্চিমবঙ্গে ঢুকেছিল। গড়ে উঠেছিল অসংখ্য উদ্বাস্তু কলোনি। শুধু কলকাতা বা শহরতলির আশেপাশেই না, বিভিন্ন জায়গাতে। বহু পরিবারকে সরকার পাঠিয়েছিল দন্ডকারণ্যে – পশ্চিম ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশের একাংশ (এখন যা ছত্তিশগড়) এবং অন্ধ্রের পাহাড়ি মালভূমি মিলিয়ে এই অঞ্চল। কেন্দ্রীয় সরকার দন্ডকারণ্য উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের হাতে দায় সঁপে দিয়েছিলেন এইসব বাঙাল উদ্বাস্তুদের। দন্ডকারণ্যের পাথুরে জমি, শুকনো বাঁজা মাটি, আর অসহ্য খরায় তপ্ত বনভূমি বাসের যোগ্য ছিল না। ১৯৬৪ সালের পর থেকেই বেশ কিছু পরিবার দন্ডকারণ্যে ত্যাগ করে। তাঁদের হিসাব পাওয়া যায়নি। সম্ভবত তাঁদেরই একটা অংশ কুমিরমারি পেরিয়ে মরিচঝাঁপিতে প্রথম পা রেখেছিল ।

১৬ই মে ১৯৭৯, আসলে কী ঘটেছিল ? কেউ মনে করতে পারছেন ? মরিচঝাঁপি অপারেশন। অপারেশনের দায়িত্ব বামফ্রন্টের বড় শরিক সি পি এমের । মরিচঝাঁপি দ্বীপ তখন ঘিরে ফেলেছিল পুলিশের লঞ্চ এবং অসংখ্য নৌকো। অপারেশনের পুরো দায়িত্ব জ্যোতি বসুর উত্তর দক্ষিণের দুই ম্যান ফ্রাইডের। পেছনে পুলিশ কর্তা আর কলকাতায় বসে সরাষ্ট্র সচিব। অনাহারি, তৃষ্ণার্ত, তবু বাঁচবার স্বপ্নে মশগুল মানুষগুলো হোগলার ছাউনি-ঘেরা ঘরে। সারাদিনের পরিশ্রমে জোগাড় করা চাল কাঠের আগুনে ফুটছে, ঠিক তখনই দলীয় মস্তানরা নিঃশব্দে ঘরে ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলো ! মরিচঝাঁপির আকাশ রাঙা হয়ে আগুনলাগা ঘরের চালগুলো শিশু, বৃদ্ধ মানুষগুলোকে গ্রাস করেছিল।

কেমন ছিল সেই ১৯৭০ দশকের শেষ প্রান্তে মরিচঝাঁপি ? প্রায় ১২০ বর্গমাইল ব্যাপ্ত মরিচঝাঁপি সুন্দরবনের সুন্দরী গড়ানের বনভূমি। মরিচঝাঁপির উদ্বাস্তু আগন্তুকরা অল্পদিনের মধ্যেই জায়গাটা পরিষ্কার করে বাসযোগ্য করে তুলেছিল। বেশ কিছু নলকূপ বসিয়েছিল। তবে নোনা জলের জন্য সেই অতি অগভীর যন্ত্রগুলো কার্যকর হয়ে ওঠেনি। দরকার ছিল সরকারি সাহায্যের। কিন্তু খেটে খাওয়া মানুষের বামফ্রন্ট সরকার হাত উঠিয়ে নিয়েছিল। তাই রায়মঙ্গল এবং আরও দু’টি নদী পেরিয়ে ওঁদের পানীয় জল এবং খাদ্য আনতে হতো। জীবিকার প্রয়োজনে কিছু গাছ কেটে ওরা ডিঙ্গি নৌকো বানিয়েছিল। মাটির রাস্তা ঘাট প্রস্তুত করেছিল। ছাউনি দিয়ে স্কুলবাড়িও তৈরি হয়েছিল। গোলমালটা লাগল ঠিক এমন সময়েই। শুরু হলো মিথ্যাপ্রচার। বড় বড় পুলিশ কর্তার আগমন ঘটল। ফিসফিস শুরু হলো – বিদেশী কোনও বড় শক্তি এইসব খেতে-না-পাওয়া পূর্ব পাকিস্তান থেকে খেঁদানো মানুষগুলোকে অর্থ, অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে। বড় বড় পিচের রাস্তা তৈরী করে সমুদ্র পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে । বাংলাদেশের সাহায্যে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ সুন্দরবন-সংলগ্ন মরিচঝাঁপিতে হাত ফেলেছে। অতএব অশনি সঙ্কেত- উদ্বাস্তুদের মরিচঝাঁপির মেয়াদ শেষ ! পশ্চিমবঙ্গ সরকার তার পুলিশ বাহিনী দিয়ে প্রায় ঘিরে ফেললো দ্বীপটিকে। নেতৃত্ব দিয়েছিলো অমিয় সামন্তদের মতো পুলিশের বড় কর্তারা। খাদ্য, পানীয় জল নিয়ে যাওয়া বন্ধ করে দেওয়া হলো । তার আগেই জনতা দলের নেতারা, যেমন কাশীকান্ত মৈত্র এবং আরও কয়েকজন, গোপনে মরিচঝাঁপি ঘুরে গেছিল । তাদেরকে ও ফাটকে পুরছিল জ্যোতিবাবুর পুলিশ। আনন্দবাজার-এর সাংবাদিক সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত কাছ থেকে এই সব দেখছিলেন । বিএসএফ-এর কর্তাদের আনুকূল্যে জেল-এ যাওয়ার হাত থেকে বেঁচে এসে দিনের পর দিন রিপোর্ট লিখেছিলেন । ওইগুলিই এখন রেকর্ডেড ইতিহাস যা থেকে এই করুন সত্য তুলে ধরা হচ্ছে।

ভাবতে অবাক লাগে, বাঙালির প্রখ্যাত কমরেড জ্যোতিবসু পূর্ব পাকিস্তান থেকে খেঁদানি খেয়ে এপার বাংলায় পালিয়ে এসেছিলো........

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted