আমার দোকানের সামনে দিয়ে মসজিদে নামাজ পড়তে যাওয়া-আসার সময়, এক লম্বা দাড়িওয়ালা লোক, রোজ পান খায়, বিস্কুট নেয়। টাকা চাইলেই বলে, "লেইখ্যা রাখ। কাইলগো দিমু"।
পরদিন বলে, "পরশু"।
এরপর বলে, "দুই সপ্তাহ পর"।
শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে, সেই লম্বা দাড়িওয়ালা লোক তার দুই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে এসে, আমার দোকান থেকে একটার পর একটা লজেন্স, বিস্কুট ও চানাচুরের প্যাকেট - সে তার ছেলেদের হাতে তুলে দিতে লাগলো। সেই লোক দাম না দিয়ে চলে যাচ্ছে দেখে, আমি সাহস করে বলি, "হুজুর এইসব ছাতা নাতা বেইচ্চা মুই প্যাট চালাই। এইগুলাইন মোর গাছের ফল না, কিইন্না আনোন লাগে। মোরে এই বিলে ঠগাইলে, মোর না খাইয়া মরণ লাগবে।"
দাড়িওয়ালা লোকটা বিষধর সাপের মতো ফোঁস করে উঠে বললো, "মাল আ উনের বাচ্চা, তোর এত বড় আস্পর্ধা! তুই মোর ...(প্রধান ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব)-কে গাইল দিলি।"
"হুজুর, মুই তো ...(প্রধান ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব)-এর
নাম মুহেই আনি নাই। মুই খালি মোর দোহানের মালের দাম চাইছি।"
...(প্রধান ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব)-কে অবমাননা করার অভিযোগ শুনে, মসজিদ ফেরত লোকদের ভিড় জমে গেল। দাড়িওয়ালা লোকটা এবার আমার বিরুদ্ধে, তাদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ অবমাননার- কাল্পনিক অভিযোগ উত্থাপন করলো। আমি নাকি তাদের প্রধান ধর্মগ্রন্থের পৃষ্ঠা ছিড়ে ঠোঙা বানিয়েছি।
আমি কাতর কন্ঠে বললাম, "আপনাগো...(প্রধান ধর্মগ্রন্থ) তো আমি জীবনে চোক্ষেই দেহি নাই।"
সমবেত নামাজিরা অকস্মাৎ প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে উঠলো। আমার দোকানটা চোখের নিমিষে লুট হয়ে গেল। আমার শরীরে বৃষ্টির মতো লাথি ঘুষি পড়তে লাগলো। অবস্থা বেগতিক দেখে আমি দেহের সর্বশক্তি দিয়ে দৌড় দিলাম। নামাজিরা আমাকে ধাওয়া করলো। একটু আড়াল পেয়ে নর্দমার মধ্যে ঝাঁপ দিলাম। মল-মূত্র ও বন্দরের যাবতীয় আবর্জনায় পরিপূর্ণ প্রশস্ত কাঁচা নর্দমার মধ্যে সমস্ত শরীর ডুবিয়ে দিয়ে, নাকটা কেবল বাইরে রেখে শ্বাস-প্রশ্বাস করি। পোকায় কামড়ায়, শরীর চুলকায়। তবু একটুও নড়াচড়া করিনা।
পড়ন্ত বিকেলে বুঝতে পারলাম যে, বিপদ সাময়িকভাবে কেটে গেছে। নর্দমা থেকে উঠে নদীতে গিয়ে দীর্ঘক্ষন ধরে স্নান করতে লাগলাম। কিছুতেই শরীর থেকে নর্দমার দুর্গন্ধ দূর হচ্ছে না। মল-মূত্র-আবর্জনার দুর্গন্ধের থেকেও প্রকট - অসহায়ত্বের দুর্গন্ধ।
এই অসহায়ত্ব সমগ্ৰ হিন্দু জাতির, যারা আরব সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে কোনো যুগোপযোগী মতাদর্শ সৃষ্টি করতে পারেনি। আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব নামক টাউট ধর্মব্যবসায়ীরা, মরু দস্যুদের দখলদারিত্ব চিরস্থায়ী করতে 'কামিনী কাঞ্চন ত্যাগ'- এর নামে, হিন্দু জাতিকে বিষয়-সম্পদ ও যৌনতা বিমুখ করে ফেলেছে; কল্পিত-পরজন্মমুখী করে ফেলেছে। সনাতনীদের বলবর্ধক খাবার গ্রহণে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। উৎসাহিত করা হয়েছে গোমূত্র পান করতে। মাত্রাতিরিক্ত গোমূত্র পান করার ফলে রোগ-জীবাণু সংক্রমণ ঘটায়- সনাতনীদের শরীর দুর্বল হয়ে গেছে। তারা কিভাবে গোমাংস ভক্ষণকারী শক্তিমানদের বিরুদ্ধে লড়াই করে পৃথিবীতে টিকে থাকবে!
নদী থেকে উঠে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে দেখি, আমার দোকানটা ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি ভাঙ্গা দোকানের সামনে বসে পড়ে, মাথায় হাত দিয়ে কাঁদতে লাগলাম। আমার যা কিছু আর্থিক অর্জন ও সঞ্চয়, সবকিছুই দোকানের মধ্যে ছিল। সব হারিয়ে আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি! কোন একটা লোক আমার প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করল না, আশার বাণী শোনালো না। পাশের এক দোকানদার বলল, "তোরে চিন্তাহরণ বাবু দ্যাহা হরতে কইছে।"
বিশিষ্ট ব্যবসায়ী চিন্তাহরণ সাহা, হৃদয়খালী বন্দরের হিন্দু সমাজের সভাপতি। মনে ক্ষীণ আশা, যদি সাহায্য-সহযোগিতা করে। দুর্গন্ধময় ভেজা গায়ে হিন্দু সমাজের সভা কক্ষে ঢুকে দেখি, বন্দরের এলিট হিন্দু ব্যক্তিত্বরা সান্ধ্যকালীন আড্ডা দিতে উপস্থিত হয়েছে।
বন্দর এলাকার বিশিষ্ট হিন্দু ব্যক্তিরা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলল ― আমি কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসে - হৃদয়খালী বন্দরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্য বিনষ্ট করে ফেলেছি। আমি তাদের প্রাণপণ বুঝানোর চেষ্টা করি যে, আমি প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের কোন ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব কিংবা ধর্মগ্রন্থের নাম- ভুলেও মুখেও আনি নি; অবমাননা করার কল্পনাও আমার মাথায় আসে নি।
বিশিষ্ট হিন্দু ব্যক্তিত্বরা আমার কথা কানে তুললো না। যে যার মতো করে বলে যায়, "এই ফাজিল ছেলে কি বলে! এই মূর্খ ছেলে কি বলে! এই অশিক্ষিত ছেলে কি বলে! হারামজাদা, তুই মহাত্মাজীর নাম শুনেছিস! তুই কোথা থেকে শিখবি উদারতা, সহিষ্ণুতা, ধর্মনিরপেক্ষতা। ছোট-লোকের বাচ্চা, ঘরে শিক্ষিত কেউ থাকলে না তোকে শেখাবে!... "
"... পার্টিশনের আগে নোয়াখালীতে মিঞারা বিরাট দাঙ্গা করলো, কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর দিন হিন্দুদের পাইকারি হারে কেটেছে, হিন্দু মেয়েদের রাতভর রেপ করেছে, হিন্দুদের জোর করে ধর্মান্তরিত করেছে। তখন ব্রিটিশ আমল। কড়া আইন। পুলিশ এসে দাঙ্গাবাজ মিঞাদের গ্রেফতার করল। মহাত্মা গান্ধী দাবি তুললেন, মুসলমানদের ছেড়ে দিতে হবে। তিনি নিজে নোয়াখালী গেলেন। মিঞারা মহাত্মাজীর শরীরে গু ছুড়ে মারলো। তাতে মহাত্মাজীর একটুও ধৈর্যচ্যুতি ঘটে নি। বিহারের হিন্দুরা পাল্টা দাঙ্গা করলো, এবার মহাত্মাজী ব্রিটিশদের বললেন, দাঙ্গাবাজ হিন্দুদের গ্রেফতার করো, কঠিন শাস্তি দাও। মহাত্মাজী, যে অপরাধে মুসলমানদের মুক্তি দাবি করলেন, সেই একই অপরাধে হিন্দুদের গ্রেফতার ও শাস্তির দাবি করলেন। একেই বলে উদারতা, একেই বলে সহিষ্ণুতা...তাহলে বুঝতে পেরেছিস, ধর্মনিরপেক্ষতা কি জিনিস..."
আমি নিজের উপর যেন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে বলে উঠলাম, "ধর্মনিরপেক্ষতার গুষ্টি..(ধর্ষণ করি)।"
হিন্দু সমাজের সভাপতি চিন্তাহরণ সাহা চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে আমার গালে চপেটাঘাত করে বলল, "এতক্ষণ ধরে সবাই মিল্লা তরে কি বুঝাইলো। তুই ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে এতবড় কথা বললি! ইন্দিরাজীর ধর্মনিরপেক্ষতাকে অবমাননা করলি! ইন্দিরা গান্ধী কে তুই জানিস! ইন্দিরা গান্ধী হইলো সাক্ষাত দেবী দুর্গা। তুই পণ্ডিত জহরলাল নেহেরুজীর নাম শুনেছিস? যিনি আমাদের(সনাতনীদের) জবাই করে, অসাম্প্রদায়িকতার অগ্নিপরীক্ষায় পাশ করেছেন... তুই সাম্প্রদায়িক মাইন্ডেড জঘন্য কালপ্রিট..."
কালু মুহুরী নামক এক বৃদ্ধ লোক আমার দোকানে রোজ পান খেত। সে আমার হাত ধরে হ্যাচকা টান দিয়ে বলল, "ছ্যাড়া বাইরে ল। মহাত্মাজী, পণ্ডিতজী, ইন্দিরা গান্ধী এইসব তোর মাথায় ঢোকপে না।"
কালু মহুরী বলে, "ছ্যাড়া তুই ধরতে জানোনা সাপ, দ্যাহাইতে গ্যাছো সাপ খেলা! এই হৃদয়খালী বন্দরে কোন হিন্দু দোকানদারডা আছে- যার টাহা শ্যাকে মারইয়া খায় নায়! হেয়ার পরও দেখপি পহেলা বৈশাখ, বার দশোরার দিন, হিন্দু দোকানদাররা শ্যাকেগো কত আদর-যত্ন করইয়া লাড়ু-মিষ্টি-পায়াস খাওয়াইয়া খাওয়াইয়া লোনোপোনো(নাদুসনুদুস) বানাইয়া দেতে আছে! কির ফান্নে খাওয়ায় ক' দেহি? হিন্দুরা জানে, এই দ্যাশে ব্যবসা করতে হইলে বড় মেঞাগো...(পুরুষাঙ্গে) ত্যাল মাইজ্জা, পাও চাইট্টা টাহা কামাই করতে হইবে! বড় মেঞাগো মাইর হজম করার লইগ্যা আগে পিঠ শক্ত কর, হেইয়ার পর দোকানদারির চিন্তা!"
কালু মহুরীর কাছে শুনলাম, হৃদয়খালী বন্দরের বিশিষ্ট হিন্দু ব্যক্তিত্বরা যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্য নিয়ে গর্ব করলো - সেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ছিল মূলত ১৯৫০, ১৯৬৪ ও ১৯৭১ সালে তিন দফায় আরব সংস্কৃতির ধর্মান্ধ উন্মত্ত জনতা কর্তৃক- ঠাণ্ডা মাথায় হৃদয়খালী বন্দরে সনাতনীদের গণহত্যা, শিশু-বৃদ্ধা নির্বিশেষে সনাতন ধর্মাবলম্বী নারীদের গণধর্ষণ, হিন্দুদের দোকানপাট বাড়িঘর লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা, ধর্মান্তরিত করা ও ভারতে তাড়িয়ে দেওয়া।
কালু মহুরী পানের পিক ফেলে ফোকলা দাঁতে হেসে বললো,"...(অশ্লীল গালি) অপদার্থ জাতি, কোন আত্মমর্যাদাবোধ নাই! ধর্মনিরপেক্ষতা ...(কর্তৃক ধর্ষিত হচ্ছে)। একটা গারো বা চাকমার গায় কেউ হাত তুইল্লা দ্যাখুক, ক্যামনে দল বাইন্দা প্রিত্তিবাদ করে, রুইখ্যা দাঁড়ায়। হ্যরা সংখ্যায় কয়জন! হইলে কি হইবে, হ্যাগো আত্মমর্যাদাবোধ আছে। আরে মরতে তো একদিন হইবেই, হেলে ছেকুলার হওনের লইগ্গা এই জাতি, ঘরের ঝি-বউগো ...(ধর্ষিত হওয়ার জন্য) বড় মেঞাগো ঘরে পাডায় ক্যা! হেয়ার চাইক্কা লড়াই করইয়া সম্মান লইয়া মরা কী বুদ্ধিমানের কাম না .."
(চলবে)
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................