‘নিজস্ব আইডেন্টি’ কম ভয়ংকর নয়।

গরু কুর বাণী যে বাঙালী মুস লমানের আত্মপরিচয়, হিন্দুত্ববাদের উপর নিজেদের স্বকীয়তা প্রতিষ্ঠা সেরকম পোস্টে ফেইসবুক ছয়লাব না হলেও বেশ কয়েক বছর ধরে এরকম পোস্ট দেখা যাচ্ছে। মূলত যারা লেখাপড়া করেন, চিন্তা ভাবনা করেন, এবং সেগুলোর পরিপেক্ষিতে লেখালেখি করেন সেরকম তরুণদের গরু কুর বাণীর প্রতি শক্ত অবস্থান এই দেশের ভবিষ্যত প্রায় ঝরঝরে বলতে গেলে। 



শরতচন্দ্র যখন তার কিশোর চরিত্র ‘লালুকে’ দিয়ে বলি প্রথার বিরুদ্ধে লিখে ভরিয়ে ফেলেছিলেন, হিন্দু প্রথাগুলোর উপর চাবুক চালিয়ে ছিলেন তখন, কবি নজরুল ইসলামের তরুণ বয়েসে মিজানুর রহমান নামের একজন লেখক মাসিক পত্রিকায় কুর বাণীতে পশু জবাইয়ের উপর একটি প্রবন্ধ লিখেন যেখানে তিনি এই প্রথাকে সমালোচনা করেন। সেই সমালোচনা স্বাভাবিকভাবেই কোলকাতার মুস লিম সমাজে ভালো লাগেনি। কিন্তু মিজানুর রহমান যেখানে শরতচন্দ্রের মত তার সমাজের কুপ্রথা নিয়ে প্রতিবাদ করে কবি নজরুলদের মত মানুষদের সমর্থন পাবেন উল্টো দেখা গেলো নজরুল ধমক দিয়ে লিখছেন- ‘ওরে   হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্‌বোধন।/দুর্বল! ভীরু! চুপ রহো, ওহো খাম্‌খা ক্ষুব্ধ মন!’ 

এভাবেই চুপ করিয়ে দেয়া হয়েছিলো মিজানুর রহমানদের মত তরুণদের। তাই মুস লিম সমাজে কোন শরতচন্দ্রের আর জন্মই হয়নি। যে কারণে মুসলিম পশ্চাতপদতাকে ঐতহ্য, আত্মপরিচয় ইত্যাদি নানা এঙ্গেলে আঁকড়ে ধরা তরুণদের দেখতি পাচ্ছি। এখন দেখছি কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন যে দেশভাগের আগে নাকি এইদেশে হিন্দুদের জন্য মুস লমানরা গরু কুরবানী দিতে পারত না! তাই এখন পথেঘাটে একটা গরুকে দশ-পনরো জন মিলে যখন চিত্কার করে ‘আ ল্লাহ আক বর’ বলে গগনবিদারী গর্জন তোলা হয়, ফিনকি দিয়ে যখন হুজুরের আরবীয় জোব্বায় রক্ত ছুটে তখন নাকি এখানে বাঙালী মুস লমানদের নিজস্ব স্বকীতায় প্রতিষ্ঠা হয়। এটা নাকি নিছক উত্সব নয়, নিছক মাংস খাওয়া নয়, নিছক ইস লামের হুমুমত পালন নয়, ছাগল ভেড়া দিয়ে কুর বানী দিলেও চলে কিন্তু গরু কুরবানী দেয়াটা হিন্দুদের উপর মুস লমানদের একটা বিজয়! মিথ্যা ছাড়া বাঙালী মুস লমানের স্বকীয়তা প্রতিষ্ঠার বিশেষ কোন উপায় নেই কেননা ইতিহাস এখানে উল্টো কথা বলছে। যারা বলছেন ৭০-৮০ বছর আগেও নাকি বাংলাদেশে গরু কোর বানী দেয়া যেত না হিন্দুদের ভয়ে, অথচ দেখুন ১৮ ৮৯ খ্রিস্টাব্দে মীর মশাররফ হোসেন তাঁর “গো-জীবন” (১৮৮৯) বইয়ে মুস লিমদের গরু কোর বানী না দিতে লিখেছিলেন, “আমাদের মধ্যে ‘হালাল’ এবং ‘হারাম’ দুইটি কথা আছে। হালাল গ্রহণীয়, হারাম পরিত্যাজ্য। একথাও স্বীকার্য যে গোমাংস হালাল, খাইতে বাধা নেই।খাদ্য সম্বন্ধে বিধি আছে যে খাওয়া যাইতে পারে-খাইতেই হইবে, গো-মাংস না খাইলে মোসলমান থাকিবে না, মহাপাপী হইয়া নরকযন্ত্রণা ভোগ করিতে হইছে একথা কোথাও লিখা নাই।…এই বঙ্গরাজ্যে হিন্দু-মোসলমান উভয় জাতিই প্রধান। পরস্পর এমন ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ যে, ধর্ম ভিন্ন, কিন্তু মর্মে ও কর্মে এক-সংসার কার্যে, ভাই না বলিয়া আর থাকিতে পারি না। আপদে, বিপদে, সুখে দুঃখে, সম্পদে পরস্পরের সাহায্য ভিন্ন উদ্ধার নাই। সুখ নাই, শেষ নাই, রক্ষার উপায় নাই।..এমন ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ যাহাদের সঙ্গে, এমন চিরসঙ্গী যাহারা, তাহাদের মনে ব্যথা দিয়া লাভ কী?..আরবে কেহই গরু কোরবানি করে না। ধর্মের গতি বড় চমৎকার। পাহাড় পর্বত, মরুভূমি সমুদ্র, নদ-নদী ছাড়াইয়া মোসলমান ধর্ম ভারতে আসিয়াছে, সঙ্গে সঙ্গে কোরবানি আসিয়াছে। এদেশে দোম্বা নাই-দোম্বার পরিবর্তে ছাগ, উঠের পরিবর্তে গো, এই হইল শাস্ত্রকারদিগের ব্যবস্থা।…গরু কোরবানি না হইয়া ছাগলও কোরবানি হইতে পারে। তাহাতেও ধর্ম রক্ষা হয়।”

মীর মোশাররফ হোসেনের এই লেখায় যেটা পরিস্কার হয় এদেশে গরু কোর বানী দেয়া অবাধেই চলেছিলো যখন পূর্ববঙ্গে হিন্দু মুস লমান অনুপাত প্রায় সমান। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতে পাওয়া যায় দেশভাগের আগে গোপালগঞ্জের ব্যবসায়ীদের ৯৮ ভাগই ছিলো হিন্দু। শিক্ষক উকিল সকলেই হিন্দু। সেরকম সামাজক অবস্থাতেও গোপালগঞ্জে মুস লমানরা গরু কুরবানী দিয়েছিলো। হিন্দুদের ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে গরু জবাই তাদের জন্য বিব্রতকর। এটা সুশিক্ষিত অসম্প্রদায়িক মুস লিমরা অনুধাবন করতেন। মীর মোশাররফ হোসেনের সময় গরু কোর বানীতে হিন্দুদের বিব্রত হওয়ার মত অবস্থা ছিলো যা দেখে মীর গরুর বদলে মুস লিমদের ছাগল ভেড়া মহিষ কুর বানী দিতে বলছেন। এই বই লেখার কারণে মীরকে জেলে যেতে হয়েছিলো। কতখানি শক্তি রাখত মুস লিমরা তবু বলা হচ্ছে গরু কুর বানী দিতে পারাটা নাকি হিন্দুদের উপর বাঙালী মুস লমানদের স্বকীয়তা প্রতিষ্ঠা! খুব কৌশলে কিন্তু এসব বলে দ্বিজাতিতত্ত্বকেও স্বীকার করে নেয়া হলো। শুধু তাই নয়, যদি গরু খাওয়া ও কুর বানী যদি মুস লমানদের বিজয় বুঝায় তাহলে স্কুলের বাচ্চাদের জোর করে গরুর মাংস খাওয়ানোর ঘটনা, রেস্টুরেন্টে না জানিয়ে গরুর মাংস খাওয়ানোটা প্রি-প্লানেড? ভারতে উত্তর প্রদেশে যোগীর রাজ্যে গরু খাওয়া নিয়ে হল্লা, হামলা ইত্যাদি গুলি যেমন ভারতের হিন্দুত্ব রাজনীতির বহির্প্রকাশ, তেমনি বুঝা গেলো রাস্তা আটকে, পরিবেশ দুষিত করে গরু কুর বানী ঠিক যোগীর মুস লিম ভার্সন প্লে ঘটে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে?

এইখানে জিন্নার দ্বিজাতিতত্ত্ব কিংবা গোলাম আযমের ‘ ইসলামী রাষ্ট্র’ থেকে প্রফেসর রাজ্জাক- আহমদ ছফাদের ‘বাঙালী মুস লমানের স্বকীয়তা’ বা ‘নিজস্ব আইডেন্টি’ কম ভয়ংকর নয়। আমরা এখন আওয়ামী ঘরোনা ও জামাত ও ইস লামী ঘরোনার বাইরে আরো একটি ঘরোনাকে দেখতে পাই যারা ইস লামী রাষ্ট্র চায় না, আবার উপমহাদেশীয় সেক্যুলারিজমও চায় না, তারা ‘বাঙালী মুস লিম জাতীয়দাবাদী’। তারা বাংলাদেশে ৯০ ভাগ মুস লিম বাঙালীর স্বকীয়তাকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তাদের প্রতিপক্ষ পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুরা এবং বাংলাদেশে থাকা অবশিষ্ঠ হিন্দু জনগোষ্ঠি যারা কিনা ‘সন্দেহজনকভাবে ভারতের র বিজেপির সমর্থক এবং ৪৭-এর পর বাংলাদেশের বাঙালী মুস লমানের হাতে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ক্ষমতা চলে যাবার পর থেকে ঈর্ষান্বিত’! এগুলো তাদের ভাষ্য। দেশভাগের পর হিন্দু জনগোষ্ঠির দেশত্যাগ ও আজ অব্দি তাদের দেশত্যাগের গ্রাফ সম্পর্কে এগুলোই হচ্ছে তাদের ব্যাখ্যা।

#সুষুপ্তপাঠক
#susuptopathok

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted