নোয়াখালী : মারের নাম বাবাজি।

নোয়াখালী : মারের নাম বাবাজি
---------------------------------------------------
৭২ বছর আগে অবিভক্ত ভারতের, অবিচ্ছিন্ন বাংলার নোয়াখালীতে ঘটে যাওয়া একতরফা সংখ্যালঘু বাঙালি হিন্দু নিধনযজ্ঞের খুঁটিনাটি তথ্যগুলো জানতে জানতে, অনেকে হয়তো হতবাক হয়েছেন নৃশংসতার তীব্রতা জেনে, কেউ বা ব্যাথিত, আবার কারুর কারুর কাছে শুনেছি লেখা থামাতে, তারা এই নৃশংসতা আর নিতে পারছেনা । পাঠক, আপনারা চাইলে, আমি এই লেখা এক্ষুনি বন্ধ করে দিতে পারি, কিন্তু অতীতের মত, আজও যদি সত্য ইতিহাস এড়িয়ে, কিছু না জানার, না শোনার ভান করে সমাজে প্রগ্রতিশীলের স্ট্যাম্প লাগিয়ে ঘোরেন, তাহলে আগামী প্রজন্মের জন্য কোন ইতিহাস রেখে যাবেন ?
যে ইতিহাস বানোয়াট, নড়বড়ে মিথ্যের উপর যার ভিত্তি, সেই ইতিহাস ? ভবিষ্যতে আবারও কখনও নোয়াখালীর মত ঐতিহাসিক জিঘাংসার ঘটনা ঘটলে, আগামী প্রজন্ম তার মোকাবিলা কোন ঐতিহাসিক বুনিয়াদের উপর দাঁড়িয়ে করবে ? তাদের পরিণতিও কি তাহলে সেদিনের হতভাগ্য নোয়াখালীর সংখ্যালঘু বাঙালি হিন্দুর মত হবে ? তাদেরও কি অকাতরে ধর্মীয় জিঘাংসার বলি হতে হবে ? তাদের চোখের সামনেও কি তাদের মা, বোন, বৌ ধর্ষিত হবে, গনিমতের মাল হবে ? পৃথিবীর ইতিহাসে ১৪০০ বছর আগে থেকেই তো এই একই জিঘাংসার জায়গায়, জায়গায় পুনরাবৃত্তি ঘটেছে । এর শেষ কোই ? এর শেষ দেখতে হলে, অতীতের সত্য ইতিহাসের বুনিয়াদের উপর বর্তমান ও ভবিষ্যতের পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হবে । চলুন তাই সত্য ইতিহাস, জেনে নি, তা সে যতই কদর্য হোক না কেন :

ঘটনা ১ ➤ ২৪শে অক্টবর, ১৯৪৬, দিল্লীর হরিজন কলোনিতে নোয়াখালীর নিপীড়িত সংখ্যালঘু বাঙালি হিন্দুর জন্য প্রার্থনা সভার আয়োজন করা হয়েছে, সভায় এসে উপস্থিত হল গান্ধী বুড়ো । সভায় উপস্থিত জনতা গান্ধীকে নোয়াখালীর সংখ্যালঘু বাঙালি হিন্দুর প্রাণ রক্ষার্থে, নারীদের সম্ভ্রম রক্ষার্থে, সাম্প্রদায়িক সুরাবর্দী মন্ত্রিসভা বাতিল করার জন্য আবেদন করলো । মেরুদন্ডহীন গান্ধী, তার পুরোনো অবস্থানে অনড় থেকে নোয়াখালীর সংখ্যালঘু হিন্দু বাঙালিকে তরবারির সামনে আত্মসমর্পণ করতে পরামর্শ দিলো । তার মতে, সেদিনের ধর্মীয় জিঘাংসায় উন্মত্ত নোয়াখালীর কুলাঙ্গার বাঙালি মুসলমানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার অর্থই হলো 'অযথা' রক্তপাত ! পাঠক, একবার ভাবুন, একদিকে মানুষকে অকাতরে খুন করা হচ্ছে, নারীদের ধর্ষণ, অপহরণ করা হচ্ছে আর গান্ধীর মতে, তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করা মানে অযথা রক্তপাত !! এ হেন মহাত্মা আরেকবার সেই সভায় মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল "to get killed, but not to kill." (Amrita Bazar Patrika 25-10-46) |
ঘটনা ২ ➤ ২৯-১০-৪৬ কাগজে কাগজে দুটো বিপরীতধর্মী খবর ছড়িয়ে পরলো । এক, 'নোয়াখালী যাত্রার উদ্দেশ্যে গান্ধী কলকাতায় এসে পৌঁচেছে' ; দুই, 'বিহারের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ভয়াবহ দাঙ্গা শুরু হয়েছে ।' প্রথম খবরে পাবলিক চমকায়নি , কিন্তু দ্বিতীয় খবরে পাবলিক চমকে ছিল, কারণটা আপনাদের খুলে বলছি । ততদিনে একটা ব্যাপার পাবলিকের কাছে খোলসা হয়ে গেছে । সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় হিংসার পরিপ্রেক্ষিতে অবিভক্ত ভারতে সেদিন নোয়াখালীতে মুসলমান বিজয়ী ও হিন্দু বিজিত । বহিঃবিশ্ব ব্যাপারটা খুব একটা ভালো চোখে নেয়নি । খোদ আমেরিকার মানুষ কলকাতা ও নোয়াখালীর এই হিংসাত্মক ক্রিয়াকলাপ একেবারেই সুদৃষ্টিতে গ্রহণ করেনি । পাকিস্তান গঠন হলে, সেখানে হিন্দুদের পরিণতি নিয়ে বিরাট প্রশ্ন উঠেছিল মার্কিন মুলুকে । সেই প্রশ্ন যাতে ফুলে ফেঁপে আন্তর্জাতিক কোয়েশ্চেন মার্কে না পরিণত হয়, তাই লীগের প্রতিনিধি, পাঞ্জাব আইনসভার সদস্যা বেগম শা নওয়াজ ও মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য এইচ.ইস্পাহানি ছুটে গেছিলো আমেরিকাতে পাকিস্তানের যৌক্তিকতা বোঝাতে মার্কিনিদের । কিন্তু আমেরিকাতে ২৯-১০-৪৬ এ তাদের ভাষণে ফের হুমকির টান ধরা পরলো । সাধে কি আর বলে কুকুরের লেজ যতই টানুন, সোজা হওয়ার নয় ! তাদের বক্তব্য ছিল : "India is heading for a great civil war unless the question of Pakistan is settled.We are sitting on a bomb in India.That is what very few people abroad realised.The sooner the question is solved, the better it will be for everyone.We Muslims are prepared to sacrifice everything in our fight for our ideal ".(Amrita Bazar Patrika 30-10-46). আসলে কলকাতা-নোয়াখালী ছিল বৃহত্তর পাকিস্তান পরিকল্পনার মহড়া মাত্র আর সেই মত বিহারে ধর্মীয় জিঘাংসার আক্রমণ নামিয়ে আনতেও মুসলিম লীগ প্ল্যান করেছিল । (That the event in East Bengal were but part of all-India battle for Pakistan.-V.P.Menon-Transfer Of Power.) | পাঠক, এইবারে মুসলিম লীগের হিসেবে একটু গন্ডগোল হয়ে গেল ! আসলে বিহারের বাসিন্দাদের মূল চরিত্র বাঙালির থেকে আলাদা, খাদ্যাভ্যাসও একটু ভিন্ন । সামাজিকভাবে তারা কাঠখোট্টা খেঁটে খাওয়া মানুষ , তাই মুসলিম লীগের হিংসার পরিকল্পনা এখানে এসে হোঁচট খেল । বিহারে এমন মার খেল মুসলিম হামলাকারী জনগণ, যে ত্রাহি ত্রাহি রব ! মুসলিম লীগ নেতৃত্ব তখন চোখে সর্ষেফুল দেখছে । বিহারে মুসলমানকে কচুকাটা হতে দেখে মেরুদন্ডহীন গান্ধী তার নোয়াখালী যাত্রা ক্যান্সেল করে বিহারমুখী হলো, যোগ দিলো লম্পট নেহেরু ।
তিনমাস যাবৎ বাংলায় যখন বাঙালি হিন্দু একতরফা নিপীড়িত হচ্ছিল তখন এই তথাকথিত বিখ্যাত বেক্তিদের পা পরেনি বাংলায়, অথচ বিহারে দাঙ্গাকারী, হামলাবাজ মুসলমান জনগণ যখন গুরুতর আক্রান্ত হলো, এই সকল বিখ্যাত বেক্তিত্ব ছুটে গেল বিহারে । সেই অর্থে বিহার, বাংলার থেকে ভাগ্যবান বলতে হবে, ধর্মীয় জিঘাংসার দ্রোহকালে অন্তত বিখ্যাত রাজনৈতিক বেক্তিরা বিহারে ছুটে গেছিল । (On hearing of the Bihar trouble Gandhiji wanted to change his programme and proceed there immediately.-J.B.Kriplani-Gandhi : His Life and Thought) |

পাঠক, মানে কি দাঁড়ালো : সহানুভূতি, সাহায্য কেবল বিশেষ একটি ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর পাওনা, বাকিরা ফাউ, না কি মারের নাম বাবাজি ?

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted