কি করে বিশ্বাস করি আপনাদের? বাম ও ‘নিরপেক্ষ’ ঐতিহাসিকদের। একশ বছর আগে আমরা কেউ ছিলাম না। কেরালাতে কি খিলাফত রাষ্ট্র কায়েম হচ্ছিল নাকি জাতীয়তাবাদী স্বাধীনতা আন্দোলন হচ্ছিল? কিন্তু ২০২১ সালে তো আমরা আছি। দেখলাম অবলীলাক্রমে বলে দিলেন, তালেবালরা হচ্ছে ‘স্বাধীনতাকামী সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ফিডম ফাইটার’। অথচ আমাদের চোখের দেখা দলটি ইসলামিক জিহাদী গ্রুপ যারা আফগানিস্থানে ইসলামিক খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চায়, শরীয়া আইন প্রয়োগ করতে চায়, আফগান নারীদের ঘরেবন্দি করতে চায়, সংগীত বাদ্য থেলাধুলা বন্ধ করতে চায়, গণতন্ত্রকে কুফরি মনে করে, ব্যক্তিস্বাধীনতাকে বেয়াল্লাপনা মনে করে...। সেই তাদের আদর্শকে বিবেচনা না করে তাদেরকে যারা স্বাধীনতাকামী বলে ইতিহাস রচনা করতে চায় তাদের এতদিনকার ইতিহাস যে ঠিক এইরকম মিথ্যা ভ্রান্তি অসত্য ছিলো সেটি পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে।
ভারতের ইতিহাস গবেষণা কাউন্সিল কেরালার মালাবার অঞ্চলে ১৯২১ সালে ‘মোপলা বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত ঘটনায় ৩০০ জন মুসলিমের নাম শহীদ তালিকা থেকে বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ঘটনাটা বাংলার শরীতুল্লাহ ও তিতুমীরের মতই ছিলো। কেরালার যিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তার নাম ছিলো ‘ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদ হাজি’। একই রকম কৃষক বিদ্রোহ ঘটেছিলো কেরালাতে। কুঞ্জাহামেদ হাজি দরিদ্র মুসলমান ও নিন্মবর্ণের হিন্দু কৃষকদের সংগঠিত করে বিশাল বাহিনী গঠন করেন এবং জমিদার ইংরেজদের হটিয়ে নিজে স্বাধীন রাজ্য ঘোষণা করেন। তিতুমীরের মতই কুঞ্জাহামেদ তার রাজ্যে শরীয়া অনুসারে চলার কথা বলেছিলেন তবে সময় পাননি। তার আগেই ইংরেজের হাতে গুলি খেয়ে মারা যান। তিনিও তিতুমীরের মত সৌদিতে হজ করতে গিয়ে কঠিন ওহাবী হয়ে ফিরে আসেন। তিনি মুসলমানদের উগ্র কট্টর মুসলমান হতেই শিক্ষা দেন। ধর্মান্তরিত করতে তিনি জোর করতেন এবং শরীয়া আইন জারি করার কথা বলেছিলেন সেরকম দলিল অবশ্য সকলেই স্বীকার করে নিয়েছে। কিন্তু শুধু ইংরেজদের বিরুদ্ধে ও জমিদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন বলেই তিনি বাম লিবারালদের কাছে ‘স্বাধীনতাকামী’। কেরালায় কুঞ্জহামেদকে নিয়ে সিনেমাও হয়েছে। যেমনটা তিতুমীরকে নিয়ে বাংলাদেশে। মহেশ্বেতা দেবী উপন্যাসও লিখেছেন। কবিরা তিতুমীর তিতুমীর বলে আবেগ ঢেলে দিয়েছেন। কিন্তু এখন তালেবাল আফগানিস্থানে ঠিক যেসব শরীয়ত প্রয়োগ করছেন তিতুমীর ঠিক সেরকমই তার সংক্ষিপ্ত ও ক্ষণস্থায়ী রাজ্যে আইন জারি করেছিলেন। কিন্তু এগুলোকে কিছুতে ইসলামিক খিলাফত হিসেবে দেখতে নারাজ ভারতের লিবারালরা। ইরানের খোমিনির ইসলামিক বিপ্লবকেও মিশেল ফুকো মৌলবাদ বা ইসলামিক শাসন হিসেবে দেখতে নারাজ ছিলেন। তিনি বলেছিলেন ইরানে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিপ্লব সফল হয়েছে। ইরান সেই থেকে ৫০ বছর ধরে নারীদের উপর শরীয়া প্রয়োগ করে নিপীড়িত করে আসছে। সেখানে ধর্ষণের প্রমাণ করতে দুইজন সাক্ষি আনতে হয়। মাথা খোলা রাখলে জেলে জরিমানা হয়। তাতে মিশেল ফুকোর মত বাম তাত্ত্বিকদের কি আসে যায়?
ভারতীয় ইতিহাস কাউন্সিল যখন ‘মোপলা বিদ্রোহ’কে স্বাধীনতা আন্দোলন বলতে নারাজ তখন দুই গ্রুপ ঐতিহাসিক এখন মুখোমুখি। লিবারালরা এগুলোকে হিন্দুত্ববাদীদের মুসলিম বিরোধী ইতিহাস রচনা হিসেবে দাবী করছেন। আমরা তো এটাও দেখেছি যে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন হিসেবে আমাদের পড়ানো হয়েছে ‘ওহাবী’ ‘খিলাফত’ আন্দোলন! একটা ছিলো মুসলমানদের তালেবাল করে গড়ে উঠার সামাজিক আন্দোলন, অপরটি তুরস্কের ইসলামিক খিলাফত ও খলিফাকে সমর্থন করে মুসলমানদের আন্দোলন। এই আন্দোলনগুলোর মধ্যে ভারতের স্বাধীনতা দাবীর ছিঁটে ফোটাও ছিলো না। আবুল মনসুর আহমদ তার ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ বইতে লিখেছেন, মুসলমানরা ভারতের স্বাধীনতা নিয়ে মোটেই আগ্রহী ছিলো না। গান্ধির সমর্থন প্রস্তাবে রাজি হয়ে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলো বটে কিন্তু খিলাফত যখন রক্ষা করা গেলো না তখন মুসলমানদের ভারতের স্বাধীনতা নিয়েও আগ্রহ বলতে আর কিছু রইল না। আসলে ইংরেজরা ভারতে মুসলিম শাসকদের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেয়ার কারণে মুসলিমরা মনে করত তাদের হতরাজ্য ফের উদ্ধার করে আবার মুসলিম শাসন কায়েম করতে হবে। সেই লক্ষেও ইংরেজ শাসনের প্রথম একশ বছরের মধ্যে মুসলিম কট্টরপন্থিদের থেকে মাঝে মাঝেই বিদ্রোহের ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। এই বিদ্রোহগুলি ছিলো ভারতের মুসলিম শাসন ও ইসলামী ভাবধারা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা। সেগুলোকেই ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন বলে ইতিহাসে ঠাঁই দেয়া হয়েছে। তালেবালকে যারা স্বাধীনতাকামী ফিডম ফাইটার বলতে পারে তারা তিতুমীর কুঞ্জহামেদকে স্বাধীনতাকামী শহীদ বলবে এতে অবাক হওয়ার কি আছে?
[বিজেপির আইটি সেল থেকে ধারে ভারতের ‘ইতিহাস কাউন্সিলের’ হয়ে ভাড়ায় খাটছি! ফুটবলে এরকম অহরহ হলেও অনলাইনে এই প্রথম ধারে আরেকজনের হয়ে খেলছি। হ্যাপি?]
-সুষুপ্ত পাঠক
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................