গৌড়ীয় বৈষ্ণব-সম্প্রদায় ও সন্ন্যাস!! -ড.রাধাগোবিন্দ নাথজী

!! গৌড়ীয় বৈষ্ণব-সম্প্রদায় ও সন্ন্যাস!!
-ড.রাধাগোবিন্দ নাথজী
……………………………………………………………………

শ্রীমন্মহাপ্রভুর প্রবর্তিত গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ে সন্ন্যাস এর রীতি প্রচলিত ছিল বলিয়া জানা যায়না I শ্রীমন্মহাপ্রভুর চরণাশ্রিত শ্রী রূপ-সনাতনাদি গৌড়ীয় বৈষ্ণব আচার্যগণের কেহই সন্ন্যাস গ্রহণ করেন নাই I গৃহ ত্যাগের পূর্বে তাহাদের মধ্যে যাঁহার যে নাম ছিল, গৃহ ত্যাগের পরেও তাহার সেই নামই ছিল এবং অদ্যাপিও সেই নামেই তিনি পরিচিত I


যিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করেন সন্ন্যাস কালে কিন্তু তাহার আশ্রমোচিত নতুন নাম দেওয়া হয়, শ্রীমন মহাপ্রভুর চরণ- দর্শনার্থী  শ্রী সনাতন গৃহ ত্যাগ করিয়া যখন বারাণসীতে গিয়ে উপনীত হইলেন , তখন মহাপ্রভুও  সেই স্থানে ছিলেন I  শ্রীপাদ সনাতন একবস্ত্রেই  গিয়েছিলেন,  স্নানান্তে আর্দ্র বসন পরিধান করিয়া আছেন দেখিয়া শ্রীল তপন মিশ্র তাহাকে একখানা নতুন বস্ত্র দিলেন ; সনাতন তাহা অঙ্গীকার করিলেন না I  মিশ্রের ব্যবহৃত একখানা পুরাতন বস্ত্র চাহিয়া লইয়া তাহা চিরিয়া দুইখণ্ড করিলেন এবং একখন্ড কৌপীনের আকারে এবং অপরখন্ড  বহির্বাসের আকারে ধারণ করিলেন I  তপন মিশ্র ছিলেন গৃহস্থ I তাঁহার ব্যবহৃত বস্ত্র সন্ন্যাসীর বস্ত্রের ন্যায় রঞ্জিত ছিলনা I  শ্রী সনাতন শ্রীকৃষ্ণমাত্রৈক- সর্বস্ব অকিঞ্চন বা  নিষ্কিঞ্চনের বেশই  ধারণ  করিয়াছিলেন I গৌর চরণানুগত  অন্যান্য বৈষ্ণবাচার্যগণও  এইরূপ  অকিঞ্চনই , কেহ   সন্ন্যাসী ছিলেন না I 
শ্রীমন্মহাপ্রভুও  কাহাকেও সন্ন্যাস গ্রহণের উপদেশ দেন নাই I তপন মিশরের পুত্র রঘুনাথ ভট্র গোস্বামীকেও তিনি বিবাহ করতে নিষেধ করিয়াছিলেন এবং শ্রী বৃন্দাবনে যাইয়া শ্রীল  রূপ- সনাতনের আশ্রয়ে   থাকিতে আদেশ দিয়েছিলেন কিন্তু তাকে তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করিতে বলেন নাই I চৌষট্রি অঙ্গ  সাধন ভক্তির উপদেশ প্রসঙ্গে প্রভু সন্ন্যাস এর উপদেশ দেন নাই,  তিনি বরং বলিয়াছেন " জ্ঞান বৈরাগ্য ভক্তির কভু নহে অঙ্গI " - শ্রীচৈ, চ ২/২২/৮২ I  শ্রীমন মহাপ্রভুর  শিক্ষা এবং আদেশের অনুসরণ করিয়া বৈষ্ণবাচার্য গোস্বামিগণ ভক্তিরসামৃতসিন্ধু আদি ভজন পথপ্রদর্শক গ্রন্থাদি প্রকাশ করিয়াছেন I  তাহাদের গ্রন্থেও কোনও  স্থলেই সন্ন্যাস এর উপদেশ দৃষ্ট হয় না I  প্রশ্ন হইতে পারে - শ্রী মহাপ্রভু সন্ন্যাস এর উপদেশ দেন নাই বটে কিন্তু প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সন্ন্যাস গ্রহণ নিষেধ করিয়াছেন কিনা?

বারাণসীতে শ্রীপাদ সনাতন গোস্বামীর  নিকটে অভিধেয়তত্ত্ব বর্ণন প্রসঙ্গে বৈষ্ণবাচার সম্বন্ধে মহাপ্রভু বলিয়াছেন- "  অসৎ সঙ্গ ত্যাগ এই বৈষ্ণবাচার I স্ত্রী-সঙ্গী এক অসাধু , কৃষ্ণাভক্ত আর II এ সব ছাড়িয়া আর  বর্ণাশ্রম ধর্ম I অকিঞ্চন হইয়া লও কৃষ্ণৈক-শরণ II " শ্রীচৈ,চ ২/২২/৪৫-৫০ I মহাপ্রভুর এই উপদেশে বৈষ্ণবের পক্ষে  বর্ণাশ্রম ধর্ম ত্যাগের কথা পাওয়া যায় I বর্ণাশ্রম- ধর্ম বলিতে  বর্ণধর্ম এবং আশ্রম ধর্ম বুঝায় I শাস্ত্রে চারিটি  বিধান দৃষ্ট হয় - ব্রহ্মচর্য ,  গার্হস্থ্য,  বাণপ্রস্থ ও  সন্ন্যাস I
সন্ন্যাস হইতেছে চতুর্থ আশ্রম ধর্ম I শ্রীমদ্ভাভাগবতের একাদশ স্কন্দের অষ্টাদশ অধ্যায়েও সন্ন্যাসকে আশ্রম ধর্মের অন্তর্ভুক্ত করিয়া বর্ণনা করা হইয়াছে ঈ এই অধ্যায়ের টিকার প্রারম্ভে শ্রীপাদ বিশ্বনাথ চক্রবর্তী লিখিয়াছেন- " অষ্টাদশেহব্রবীদ্ধধর্মং   বনস্থ-ন্যাসিনোঃ ক্রমাৎ I ভক্তস্যানাশ্রমিত্বঞ্চ ধর্মং সাধারণং তথা II অষ্টাদশ অধ্যায় ক্রমে বানপ্রস্থ এবং সন্ন্যাসের ধর্মের কথা বলা হইয়াছে I ভক্তের সাধারণ ধর্ম যে অনাশ্রমিত্ব, তাহাঁও  বলা হইয়াছে I " উল্লিখিত বাক্যে শ্রীমন মহাপ্রভু বর্ণাশ্রম ধর্ম ত্যাগের কথা বলিয়াছেন , তাহাতেই চতুর্থ আশ্রমের সন্ন্যাস বর্জনের কথা জানা যায় ; শ্রীপাদ বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর টীকাতেও "ভক্তস্যানাশ্রমিত্বঞ্চ" বাক্যে তাহাঁই বলা হইয়াছে I

এই প্রসঙ্গে শ্রীপাদ সনাতন গোস্বামীর একটি উক্তিও উল্লেখযোগ্য I মহাপ্রভুর পার্ষদ এবং অন্তরঙ্গ ভক্ত শ্রীপাদ জগদানন্দ পন্ডিত যখন বৃন্দাবনে গিয়েছিলেন , তখন একদিন তিনি শ্রীপাদ সনাতনকে আহারের জন্য নিমন্ত্রণ করিয়াছিলেন I মুকুন্দ সরস্বতী নামক কোন এক সন্ন্যাসী শ্রীপাদ সনাতনকে একখানা বহির্বাস দিয়েছিলেন , অবশ্য সনাতন ব্যবহার করতেন না , কিন্তু তিনি সেই বহির্বাস খানা মাথায় বাঁধিয়া জগদানন্দের নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে আসিলেন I তখন, " রাতুল বস্ত্র  দেখি পন্ডিত প্রেমাবিষ্ট হইলা I মহাপ্রভুর প্রসাদ জানি তাঁহাকে পুছিলা II  কাহা পাইলে এই তুমি রাতুল বসন ?   মুকুন্দ সরস্বতী দিল কহে সনাতন I পন্ডিতের মনে দুঃখ উপজিল I ভাতের হাণ্ডি  লইয়া তারে মারিতে আসিল II  শ্রীচৈ,চ ৩/১৩/৫১-৫৩ I  সনাতন লজ্জিত হইলেন I তাহা দেখিয়া জগদানন্দ পন্ডিত ভাতের হাড়ি "চুলোতে ধরিয়া " সনাতনকে বলিলেন - " তুমি মহাপ্রভুর হও  পার্ষদ-প্রধান I তোমাসম মহাপ্রভুর  প্রিয় নাহি আন II  অন্য সন্ন্যাসীর বস্ত্র তুমি ধর  শিরে I কোন ঐছে হয় ইহা পারে সহিবারে II তখন সনাতন বলিলেন - সাধু,পণ্ডিত মহাশয় I  চৈতন্যের তোমাসহ প্রিয় কেহ নয় II  ঐছে চৈতন্যনিষ্ঠা যোগ্য তোমাতে I  তুমি না দেখাইলেই ইহা শিখিব কেমনে II যাহা দেখিবারে বস্ত্র মস্তকে বান্ধিলো I  সেই অপূর্ব প্রেম প্রত্যক্ষ দেখিল II রক্ত বস্ত্র বৈষ্ণবের পরিতে না যুয়ায় I কোন পরদেশীকে  দিব কি কাজ ইহায় II " -শ্রীচৈ,চ ৩/১৩/৫৫-৬০ I   এ স্থলে শ্রীপাদ সনাতন বলিলেন " রক্তবস্ত্র বৈষ্ণবের পড়িতে না যুয়ায় I"  মহাপ্রভু যে বর্ণের বহির্বাস ব্যবহার করেছেন , ইহা সেই বর্ণের  বস্ত্র I কেননা ইহাকেই জগদানন্দ পন্ডিত মহাপ্রভুর প্রসাদ বলিয়া মনে করিয়াছিলেন I ইহা ছিল মুকুন্দ  সরস্বতী নামক সন্ন্যাসীর বহির্বাস I  সন্ন্যাসীরা যে বর্ণের বস্ত্র ব্যবহার করিতেন ইহাও  ছিল সেই বর্ণের বস্ত্র I রক্ত অর্থ রঞ্জিত বা রং-করা I শ্রীপাদ সনাতনের উক্তি হইতে  জানা গেল সন্ন্যাস গ্রহণ তো দূরে,  সন্ন্যাসীরা যেরকম রঞ্জিত বস্ত্র পরিধান করেন তদ্রুপ বস্ত্র পরিধানও  বৈষ্ণব এর পক্ষে কর্তব্য নহে  I শ্রীপাদ সনাতনের উক্তি এবং আচরণ হইতে জানা গেল , যাহারা নিষ্কিঞ্চন  বেশ ধারণ করেন , তাহাদের পক্ষেও রঞ্জিত বস্ত্রের  ব্যবহার সঙ্গত নয় I  উল্লেখিত আলোচনা হতে জানা গেল-  শ্রীমন মহাপ্রভু সন্ন্যাস গ্রহণ নিষেধই  করিয়াছিলেন , শ্রীপাদ সনাতনের অভিপ্রায়ও তদ্রুপই I  শ্রীল বৃন্দাবন দাস ঠাকুরের  শ্রী চৈতন্যভাগবত ( অন্ত্য I তৃতীয় অধ্যায়)  হইতে জানা যায় , শ্রী মহাপ্রভু নিজেকে উপলক্ষ্য করাইয়া শ্রীপাদ সার্বভৌম  ভট্টাচার্যের মুখে সন্ন্যাসের ভক্তি ধর্ম বিরোধিতার কথা প্রকাশ করাইয়াছেন I

প্রভুর মায়ায় মুগ্ধ হইয়া সার্বভৌম প্রভুকে বলিয়াছেন -" বড়ই কৃষ্ণের কৃপা হইয়াছে তোমারে I  সবে একখানি করিয়াছ অব্যভারে II পরাম সুবুদ্ধি তুমি হইয়া আপনে I তবে তুমি সন্ন্যাস করিলা কি কারণে II  বুঝ  দেখি বিচারিয়া কি আছে সন্ন্যাসে I  প্রথমে বদ্ধ হয়ে অহংকার পাশে II দন্ড ধরি মহাজ্ঞানী হয় আপনারে I  কাহারেও বোল হস্ত জোড় নাহি করে II যার পদধুলি লইতে  বেদের বিহিত I হেন জন নমস্করে,তবু নহে ভীত II সন্ন্যাসী ধর্ম বা বলিব সেহও নহে I  বুঝ এই ভাগবত যেন মত কহে II  প্রণমেদ্দণ্ডবদ্ভূমাবাশ্বচাণ্ডালগোখরম I ঈশ্বরো জীবকলয়া প্রবিষ্টো ভগবানিতি II  ব্রাহ্মণাদি কুকুর চণ্ডাল অন্ত করি I  দণ্ডবৎ করিবেক বহু মান্য করি  II এই সে বৈষ্ণব ধর্ম সভারে প্রণতি I সেই ধর্মধ্বজী , যার ইথে নাহি রতি II শিখাসূত্র ঘুচাইয়া সবে এই লাভ I নমস্কার করে আসি মহামহাভাগ II " 
শ্রীমন মহাপ্রভু বলিয়াছেন তৃণাদপি সুনীচেন তরোরিব  সহিষ্ণুনা I অমানিনা মানদেন  কীর্তনীয়ঃ  সদা হরি II কিন্তু চতুর্থ আশ্রম সন্ন্যাস এই উপদেশ পালনের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় এবং " নাহং বর্ণী না চ নরপতিঃ ("অশ্বমেধং গবালম্ভং সন্ন্যাসং পলপৈতৃকম। দেবরেণ সুতোৎপত্তিং কলৌ পঞ্চ বিবর্জয়েৎ।। " শ্রীচৈ,চ ১/১৭ এ  ধৃত পুরান বচন ! " নাহং বিপ্রো ন চ নরপতির্নাপি বৈশ্যো ন শূদ্রো, নাহং বর্ণী ন চ গৃহপতির্নো বনস্থো যতির্বা ।কিন্তু প্রোদ্যন্নিখিলপরমানন্দপূর্ণামৃতাব্ধে-,র্গোপীভর্ত্তুঃ পদকমলয়োর্দাস-দাসানুদাসঃ ॥" পদ্যাবলীতে উক্ত শ্রীচৈতন্য মুখোদ্গীর্ণ II) "  ইত্যাদি প্রভু কথিত সাধকের পরিচায়ক পূর্বোদ্ধৃত শ্লোকেরও  বিরোধী হইয়া দাঁড়ায় I
 প্রশ্ন হইতে পারে - " রামানুজ সম্প্রদায় এবং মধ্বাচার্য সম্প্রদায়ও তো  বৈষ্ণব সম্প্রদায় I সন্ন্যাস যদি বৈষ্ণব ধর্মের প্রতিকূলই  হইবে , তাহা হইলে এই দুই সম্প্রদায়ে  সন্ন্যাসের রীতি দেখা যায় কেন? 
উত্তরে বক্তব্য এই I উল্লিখিত সম্প্রদায়দ্বয়  বৈষ্ণব হইলেও তাহাদের লক্ষ্য এবং সাধন গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের লক্ষ্য এবং সাধন হইতে  ভিন্ন I তাহাদের লক্ষ্য হইতেছে মুক্তি কিন্তু গৌড়ীয় সম্প্রদায়ের লক্ষ্য - ব্রজে  শ্রীকৃষ্ণের প্রেমসেবা; গৌড়ীয়  সম্প্রদায় মুক্তি কামনা করেন না,  মুক্তি কামনা হইতেছে এই সম্প্রদায়ের ভজন বিরোধী I সন্ন্যাস হইতেছে  বর্ণাশ্রম ধর্মের অন্তর্ভুক্ত, নিষ্কামভাবে বর্ণাশ্রম ধর্মের অনুষ্ঠানে মুক্তিলাভ হইতে পারে, এজন্য তদ্রূপ সাধন -  সুতরাং সন্ন্যাসও - উল্লিখিত সম্প্রদায়দ্বয়ের  সাধনের এবং লক্ষ্যের  বিরোধী নহে I কিন্তু তাহা গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের সাধনের বিরোধী , এজন্যই শ্রীমন মহাপ্রভু বর্ণাশ্রম ধর্ম ত্যাগের উপদেশ দিয়াছেন এবং ভক্তিরসামৃতসিন্ধুও  বলিয়াছেন- " অন্যাভিলাসিতাশূন্যং জ্ঞান- কর্মাদ্যনাবৃতম I আনুকূল্যেন কৃষ্ণানুশীলনং ভক্তিরুত্তমা II " এই শ্লোকে "জ্ঞান- কর্মাদ্যনাবৃতম" শব্দেই বর্ণাশ্রম ধর্ম এবং তদন্তঃপাতী  সন্ন্যাস এর সংস্রব-ত্যাগের  উপদেশ রহিয়াছে I আবার প্রশ্ন হইতে পারে - শ্রীপাদ  মাধবেন্দ্র পুরী এবং তাহার শিষ্য শ্রীপাদ ঈশ্বরপুরী ( লৌকিকী লীলায় মহাপ্রভুর দীক্ষাগুরু)  শ্রীপাদ পরমানন্দপুরী  প্রভৃতি তো ব্রজভাবের উপাসকই ছিলেন, মুক্তিকামী ছিলেন না I তাহারা সন্ন্যাস গ্রহণ করিলেন কেন?

উত্তর I শ্রীপাদ মাধবেন্দ্রাদির " পুরী "  উপাধি হইতেই জানা যায় , তাহারা শ্রীপাদ শঙ্করের দশনামী  সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত "পুরী" সম্প্রদায়ে  সন্ন্যাস গ্রহণ করিয়াছিলেন I ইহাতে বোঝা যায় , পূর্বে তাহারা শংকর সম্প্রদায়ে  ছিলেন,  পরে ভক্তি মার্গে প্রবেশ করিয়াছেন কিন্তু ভক্তি মার্গে প্রবেশ করিয়াও "পরাত্ম-নিষ্ঠামাত্র বেশধারণ I মুকুন্দ সেবায় হয় সংসার তারণ II " শ্রীচৈ,চ ২/৩/৬ I ইহা ভাবিয়া অথবা " মর্যাদা রক্ষণ হয় সাধুর ভূষণ " এই নীতির  অনুসরণে পূর্বাচার্যদের  প্রতি মর্যাদা প্রদর্শনের জন্য অথবা এতাদৃশ  অন্য কোনোও  কারণে  তাহারা পূর্ব সন্ন্যাস আশ্রমের নাম- আদি পরিত্যাগ করেন নাই I " ভক্তি মার্গে প্রবেশ করার পরে যে তাহারা ভক্তি বিরোধী মায়াবাদী সম্প্রদায়ে সন্ন্যাস গ্রহণ করিতে গিয়াছেন"-  এইরূপ অনুমান সংগত হয়না I এইরূপে দেখা যায় ভক্তি মার্গে সাধনের অনুকূল মনে করিয়া তাহারা সন্ন্যাস গ্রহণ করেন নাই , ভক্তি মার্গে প্রবেশ করার পরেও সন্ন্যাস গ্রহণ করেন নাই I 
আবার প্রশ্ন হইতে পারে মহাপ্রভুর অত্যন্ত অন্তরঙ্গ পার্ষদ শ্রী পুরুষোত্তম আচার্যও সন্ন্যাস গ্রহণ করিয়া " স্বরূপ দামোদর"  নামে পরিচিত হইয়াছিলেন I  তিনি পূর্ব হইতেই ভক্তিমার্গাবলম্বী এবং নবদ্বীপে অবস্থানকালেও প্রভুর  অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন I  ভক্তিমার্গাবলম্বী হইয়া তিনি কেন সন্ন্যাস গ্রহণ করিলেন ?

উত্তর I ভক্তি সাধনের আনুকূল্য বিধায়ক মনে করিয়া তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করেন নাই , তিনি ছিলেন গৌরগত- প্রাণ I তিনি যখন শুনিলেন,  প্রভু সন্ন্যাস গ্রহণ করিয়াছেন,  তখন ভাবিলেন -" আমার প্রাণকোটিপ্রিয় প্রভু সন্ন্যাসাশ্রমের দুঃখ ভোগ করিবেন আর আমি গৃহসুখ ভোগ করিব ! ইহা কিছুতেই হইতে পারে না আমিও সংসার সুখে জলাঞ্জলি দিব , সন্ন্যাস গ্রহণ করিব I " - এইরূপ ভাবিয়া প্রভুর সন্ন্যাসাশ্রমোচিত কঠোরতর চিন্তায় অধীর হইয়া, উন্মত্তের ন্যায় ছুটিয়া গিয়া কাশিতে সন্ন্যাস গ্রহণ করিলেন, তাহাও  পুরোপুরি সন্ন্যাস নহে , তিনি যোগপট্র নেন নাই, দণ্ড-কমণ্ডলুও গ্রহণ করেন নাই I এইরূপে তিনি কেবল সংসার সুখের পথ রুদ্ধ করিলেন মাত্র কিন্তু সন্ন্যাসোচিত আচরণ করেন নাই I বেদান্ত ( মায়াবাদ ভাষ্য সমন্বিত)  পড়িয়া অপরকে পড়ার জন্য তাহার সন্ন্যাস এর গুরু তাহাকে আদেশ করিয়াছিলেন,  তিনি সেসব কিছুই করেন নাই;  শুনিয়াছিলেন প্রভু নীলাচল হইতে  দক্ষিণ দেশ ভ্রমণে গিয়াছেন I  কখন প্রভু নীলাচলে  ফিরিয়া  আসিবেন - এই অপেক্ষাতেই তিনি কাশিতে বসিয়া দিন যাপন করিতেছিলেন I যখনই শুনিলেন প্রভু নীলাচলে ফিরিয়া আসিয়াছেন তখনই তিনি ছুটিয়া আসিয়া প্রভুর চরণে উপনীত হইলেন আর প্রভু কে ছাড়িয়া  যায়েন  নাই , কখনও  যোগপট্র বা দণ্ডকমণ্ডলু ও গ্রহণ করেন নাই I  তাহার প্রাণ অপেক্ষাও প্রিয় প্রভুর সন্ন্যাসাশ্রমোচিত কঠোরতর অংশ গ্রহণের জন্য তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করিয়াছেন I  বিশেষতঃ শ্রীপাদ  স্বরুপদামোদর ছিলেন শুদ্ধ ভক্ত,  মহাপ্রভুর নিত্যপার্ষদ I  সিদ্ধভক্তদের সকল আচরণও অনুসরণীয় নহে ,  ভক্তের যে আচরণ ভক্তিশাস্ত্র অনুমোদিত তাহাই সাধকের পক্ষে অনুসরণীয় I 

আরো প্রশ্ন হইতে পারে I  শ্রীমন্মহাপ্রভু তো অবতীর্ণ হইয়াছেন -" আপনি আচরি ভক্তি জীবেরে"  শিক্ষাদান করার জন্য I  তাহার আচরণের অনুবর্তন করাই  হইবে সাধের জীবের কর্তব্য I প্রভু সন্ন্যাস গ্রহণ করিয়াছেন,  সাধকজীব তাঁহার অনুকরণে সন্ন্যাস গ্রহণ করিলে কি দোষ হতে পারে ? 

উত্তরে বক্তব্য এই I শ্রীমন মহাপ্রভু হইতেছেন স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ I তাহার উপদেশের  অনুসরণই  সাধক জীবের কর্তব্য;  তাহার যে আচরণ তাহার উপদেশের সহিত  সঙ্গতিযুক্ত সেই আচরণের অনুসরণই  করা যায় ; কিন্তু অন্য আচরণের অনুকরণ বা অনুসরণ করিলে যে বিশেষ অমঙ্গল হয়, "ঈশ্বরাণাম বচঃ সত্যম " ইত্যাদি শ্রীভা। ১০/৩৩/৩১ - শ্লোকে  শ্রী শুকদেব গোস্বামী তাহাঁ  বলিয়া গিয়েছেন I মহাপ্রভু কখনো যে সন্ন্যাস গ্রহণের উপদেশ দেন নাই , বরং সন্ন্যাস গ্রহণ যে তিনি নিষেধ করিয়াছেন তাহা পূর্বেই বলা হইয়াছে I সুতরাং তাহর নিজের সন্ন্যাস গ্রহণরূপ আচরণ  তাহার উপদেশের সহিত সঙ্গতি  যুক্ত নহে বলিয়া তাহা সাধকজীবের অনুকরণীয় বা অনুসরণীয় হইতে পারেন না I  তবে মহাপ্রভু সন্ন্যাস গ্রহণ করিলেন কেন? 
ভজনের আদর্শ স্থাপনের জন্য তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করেন নাই,  তাহার সন্ন্যাস গ্রহণের হেতু হইতেছে এই I গত দ্বাপর যুগে স্বয়ং ভগবান যখন ব্রহ্মান্ডে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন তখন তিনি ব্যাসদেবের নিকটে বলিয়াছেন যে-  কোন বিশেষ কলিতে  তিনি নিজেই সন্ন্যাস আশ্রম গ্রহণ করিয়া পাপহত লোকদিগকেও (  অর্থাৎ নির্বিচারে ) হরিভক্তি গ্রহণ করাইয়া থাকেন I 

" অহমেব ক্বচিদ ব্রহ্মণ্ সন্ন্যাসাশ্রমমাশ্রিত: I হরিভক্তি গ্রাহয়ামি কলৌ পাপহতান্ নরান্ "- শ্রীচৈ,চ ধৃত পুরাণ-বচন II মহাভারতেও অনুরূপ উক্তি পাওয়া যায় -  " সুবর্ণবর্ণো  হেমাঙ্গ বরাঙ্গশ্চন্দনাঙ্গদী I সন্ন্যাসকৃত শমঃ শান্তো নিষ্ঠা-শান্তি-পরায়ণঃ II বিষ্ণু-সহস্রনাম II এই সমস্ত শাস্ত্র বাক্য হইতে জানা যায়,  বিশেষ কলিতে ( অর্থাৎ যে শ্রীকৃষ্ণ অবতীর্ণ হয়েন, তাহার অবিবাহিত পরবর্তী কলিতে ) গৌর -কৃষ্ণরূপে যখন তিনি ব্রহ্মাণ্ডে অবতীর্ণ হয়েন, তখন তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করিয়া থাকেন I ইহা তাহার লীলা I কোন প্রয়োজন বুদ্ধিতে লীলার অনুষ্ঠান হয় না I স্বীয়  প্রয়োজন-বুদ্ধিতে লীলার অনুষ্ঠান না হইলেও আনুষঙ্গিক ভাবে যে ফলের উৎপত্তি হইতে দেখা যায় I  সন্ন্যাস লীলা সম্বন্ধে প্রভু  তাহা  নিজ মুখেই ব্যক্ত করিয়া গিয়াছেন - 
" যত অধ্যাপক আর তার শিষ্যগণ I ধর্মী কর্মী তপোনিষ্ঠ নিন্দুক  দুর্জন II  এইসব মোর নিন্দা অপরাধ হইতে I আমি না লওয়াইলে  ভক্তি না পারে লইতে II নিস্তারিতে আইলাম আমি  হইল বিপরীত I  এসব দুর্জনের কইছে হইবেক  হিত II " -শ্রীচৈ,চ ১/১৭/২৫-৫৫ I 
এইসব জীবের অবশ্য করিব উদ্ধার II  অতএব অবশ্য আমি সন্ন্যাস করিব I  সন্ন্যাসীর বুদ্ধে মোরে প্রণত হইব II প্রণতিte  হবে ইহার অপরাধ ক্ষয় I  নির্মল হৃদয়ে ভক্তি করিব উদয় II " -শ্রীচৈ,চ ১/১৭/২৫৭-৫৯ I এই সমস্ত উক্তি হইতে বোঝা যায় ভজনের আদর্শ স্থাপনের জন্য তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করেন নাই I  

আবার প্রশ্ন হইতে পারে শ্রীমন নিত্যানন্দ প্রভু সন্ন্যাস গ্রহণ করিলেন কেন ?  এই প্রশ্নের উত্তরে বক্তব্য এই শ্রীমন নিত্যানন্দ হইতেছেন ঈশ্বর-তত্ব , ব্রজলীলার বলদেব I ঈশ্বরের সকল আচরণ যে অনুসরণীয়  নহে  তাহা  পূর্বেই বলা হইয়াছে I শ্রী নিত্যানন্দের সন্ন্যাসও  হইতেছে তাহার লীলা I আবার , নবদ্বীপে আসার পরে তিনি নিজ হাতেই তাহার দন্ড-কমণ্ডলু ভাঙ্গিয়া ফেলিয়া দিয়েছিলেন এবং মহাপ্রভু সেই ভাঙ্গা দন্ড-কমণ্ডলু গঙ্গায় বিসর্জন দিয়াছিলেন I সন্ন্যাস এর পরে শ্রীমন নিত্যানন্দাদির সঙ্গে মহাপ্রভু যখন নীলাচলে যাইতেছিলেন তখন পথিমধ্যে একস্থানে শ্রী নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর দন্ড ভাঙ্গিয়াও  ৩ খন্ড করিয়া নদীতে ভাসাইয়া দিয়েছিলেন I তাহারা কেহই আর সন্ন্যাসাশ্রমের দণ্ড ব্যবহার করেন নাই I স্বরূপদামোদর  তো দণ্ড গ্রহণই  করেন নাই I এইরূপে দেখা যায় লীলানুরোধে শ্রীমন মহাপ্রভু বা তাহার পার্ষদ শ্রী নিত্যানন্দ , শ্রী স্বরূপ দামোদর সন্ন্যাস গ্রহণ করিয়া থাকিলেও তাহাদের কেহই দন্ড ব্যবহার করিতেন না I  শ্রীমন মহাপ্রভুর  চরণাশ্রিত বৈষ্ণবাচার্য গোস্বামীগণের আনুগত্যে যাঁহারা ভজন করিয়া গিয়াছেন , পূর্বোল্লেখিত কারণবশত তাহাঁদের কেহই সন্ন্যাস গ্রহণ করেন নাই Iবস্তুতঃ  গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ে  সন্ন্যাসের রীতি নাই,  ইহা বরং শ্রীমন্মহাপ্রভুর নিষিদ্ধ I  
শ্রীধাম বৃন্দাবনাদিতে যেসকল নিষ্কিঞ্চন  বৈষ্ণব দৃষ্ট হয়েন তাঁহারা  যে বেশ ধারণ করেন তাহা সন্ন্যাসীর বেশ নহে ;  তাহা হইতেছে শ্রীপাদ সনাতনাদির অনুসরণে নিষ্কিঞ্চনের বেশ I  সন্ন্যাসীর ন্যায় রঞ্জিত বস্ত্রও  তাঁহারা ব্যবহার করেন না I

জয়তু ড. রাধাগোবিন্দ নাথঃ!

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted