সেকুলার ও সেকুলাঙ্গার : গজওয়ায়ে হিন্দ
---------------------------------------------------
ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানের একটি বিশেষ গুণ হল অকপটে সত্য ভাষণ । এই ভারতের মুসলমানের কথাই ধরা যাক, পাঠক । পরিচয় জানতে চাইলে একজন হিন্দু বা বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান ১০০ র মধ্যে ৯০ বারই প্রথমে বলবে সে বাঙালী বা মারাঠী অথবা পাঞ্জাবি ইত্যাদি, তারপর বলবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বা ভারতীয় কিন্তু একজন মুসলমান ভারতের যেখানেরই বাসিন্দা হোক না কেন,১০০র মধ্যে ৯০ জন, প্রথমত, দ্বিতীয়ত এবং শেষোক্ত নির্দ্বিধায় নিজেকে 'মুসলমান’ বলে পরিচয় দেবে ! শুধু ভারত না, সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের ধর্মান্তরিত মুসলমানের ধর্মীয় ও জাতিগত পরিচয় : তারা 'মুসলমান' ।
পাঠক, কখনো ভেবেছেন উপমহাদেশের মুসলমানের এই অভিব্যক্তির পেছনে কোন মতবাদ কাজ করে ? মুসলমান বিশ্বাস করে : আল্লাহ এই বিশ্ব জাহানের মালিক (Sovereignty of Allah over the entire world), মুসলমান আল্লার সেবক, অতএব সারা পৃথিবীই মুসলমানের ! সেই লক্ষ্যপূরণ করতেই তো অবিভক্ত ভারতের মুসলমান 'হাত মে বিড়ি, মু মে পান, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান' স্লোগান তুলে রাস্তায় নেমেছিল অগুনতি মানুষের রক্ত ঝরিয়ে, নারীর ইজ্জতহরণ করে 'পাকিস্তান' কায়েম করতে । অবিভক্ত ভারতের কবি ইকবাল, যাকে আমজনতা প্রগতিশীল উদার ও জাতীয়তাবাদী ভারতীয় বলে চিনতো, আদতে ছিল ইসলামের নবজাগরণে বিশ্বাসী এই কবি ইকবালই বিংশ শতাব্দীতে মুসলমানের স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের দাবির মুখ্য তাত্ত্বিক প্রবক্তা । তার মত ছিল : সভ্যতা-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য অনুযায়ী নিজেদের স্বাধীন পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য ভারতে বসবাসকারী মুসলমানের সম্পূর্ণ সঙ্গত অধিকার আছে ভারতের মধ্যেই একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রের । (The Indian Muslims is entitled to full and free development on the lines of his own culture and tradition in his own homeland.) ।
'Now or Never' এর লেখক লণ্ডন প্রবাসী কেমব্রিজ শিক্ষিত তরুণ রহমত আলি ইকবাল, উপমহাদেশীয় ধর্মান্তরিত মুসলমানের এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ । তার বইতে সে ব্যক্ত করেছে যে, 'হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সংঘাত হল দুটি জাতির মধ্যে সংঘর্ষ, হিন্দু ও মুসলমান মূলত দুটি স্বতন্ত্র জাতি। আমাদের ধর্ম, সংস্কৃতি, ইতিহাস, পরম্পরা, সাহিত্য, অর্থব্যবস্থা বিবাহ ও উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিধিসমূহ হিন্দুদের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। এই পার্থক্য কতগুলি মৌলিক নীতির মধ্যেই সীমিত নয়। দৈনন্দিন জীবনের সর্বক্ষেত্রে তা প্রতিফলিত।' পাঠক, উপমহাদেশের শতকরা ৮০ ভাগ এই মানসিকতার ধর্মান্তরিত মুসলমানের কাছ থেকে আপনারা কোন সেকুলারিসম আশা করেন ? পাঠক, দ্বিজাতিতত্ত্ব নামক ভাওঁতার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ধূর্ত জিন্নাহ বলেছিল : “সুতরাং আমাদের জাতির ভাগ্যকে এক ভারতীয় জাতিত্বের* (ভারতীয় জাতীয়তাবাদ) স্বার্থের সঙ্গে যুক্ত করার অর্থ হবে আমাদের বংশধর ও ইতিহাসের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা ও মানবতার বিরুদ্ধে এক অমার্জনীয় অপরাধ।"(Therefore for us to seal our national doom in the interest of one Indian nationhood would be a treachery against our posterity a betrayal of our history and a crime against humanity) | আজ পর্যন্ত বিশ্ব ইতিহাসে পৃথিবীর কোথাও মুসলমান, মূল জাতিস্রোতের (National mainstream) সঙ্গে মিশে যায়নি, বজায় রেখেছে আপন ইসলামি স্বাতন্ত্র ! অবিভক্ত ভারত থেকে আজকের খণ্ডিত ভারতে মুসলমান ৮০%, ভুলেও নিজেকে ভারতীয়ের জায়গায় মুসলমান বলে প্রথমে পরিচয় দেয়, তবু গান্ধী-নেহেরুর চ্যালারা এবং সেকুলাঙ্গার তথাকথিত বামেরা “হিন্দু-মুসলমান নিয়ে এক ভারতীয় জাতি”, এই ইউটোপিক প্রচার চালায় । প্রতিটি মুসলিম রাষ্ট্রের মুসলমান এক একটি বিশিষ্ট সম্প্রদায়, তাহলে কিসের ভিত্তিতে OIC (Organisation of Islamic Countries) গঠন ? কেন 'Islamic Summit', মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানদের শীর্ষ সম্মেলন ? বাস্তব সত্য হলো, ইসলাম বিশ্বের সকল মুসলমানকে এক জাতি হিসেবে দেখে, মুসলিম জাতি । ১৯৪৭ সালে, হিন্দু ও মুসলমান দুটি স্বতন্ত্র জাতি, এই ভাওঁতার উস্কানিতেই ভেঙেছিল ভারত ।
এক দেশে থাকবো আর সেই দেশে থেকে স্বতন্ত্র জাতিসত্ত্বার পরিচয় দেব, মুসলমানের এই কল্পবিলাস অনেকটা 'গাছেরও খাবো, তলারও কুড়াবো' টাইপ । এর বিরোধ যদি করেন, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে আপনার 'সাম্প্রদায়িক' ট্যাগ লেগে যাবে । অবিভক্ত ভারতের জনসংখ্যার ২৩% ছিল ইসলামে বিশ্বাসী মুসলমান, অথচ ভারত ভাগ করে মুসলমানের পবিত্র দেশ 'পাকিস্তান' পেয়েছিলো অবিভক্ত ভারতের ৩০% জমি । পাঠক, এটা ঠিক কোন সেকুলারিজমের নমুনা ?
রেফ : R.C. Majumder-History of the Freedom Movement in India
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................