‘ইসলামী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’ বাংলাদেশের একটি রাষ্ট্রীয় ইসলাম প্রচার সংস্থা। বাংলাদেশের সকল সরকারী প্রতিষ্ঠানের নামের আগে ‘বাংলাদেশ’ কথাটা আগে থাকলেও এই ইসলাম চর্চা প্রতিষ্ঠানের শেষে বাংলাদেশ বসেছে। কেন? ‘জামাত ইসলাম বাংলাদেশ’ নামটি তাদের বাংলাদেশের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে মত দিয়েছিলো দেশের স্বাধীনতার পক্ষের যে বুদ্ধিজীবীরা তারা কখনোই কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানটির শেষে কেন বাংলাদেশ থাকবে সে প্রশ্ন তুলেননি। রাষ্ট্রীয় ইসলাম প্রচার সংস্থার বিষয়ে কেন প্রশ্ন আসবে না? ইসলামের আগে কি ‘বাংলাদেশ’ বসানো যাবে না?
কিন্তু এই লঘু অভিযোগ নিয়ে আলোচনা করতে নিশ্চিয় বসিনি। বসেছি, বাংলাদেশ সরকারের টাকায় ইসলামী ফাউন্ডেশন আসলে কি আদর্শ দেশে ছড়াচ্ছে সেটি জানা দরকার। ইসলামী ফাউন্ডেশন তাদের ওয়েবসাইটে এই সংস্থা সম্পর্কে লিখে রেখেছে- “ইসলামের প্রচার-প্রসারের লক্ষ্যে বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ১৯৭৫ সালের ২২ মার্চ এক অধ্যাদেশবলে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। ২৮ মার্চ ১৯৭৫ সালে ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন’ এ্যাক্ট প্রণীত হয়। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান। সুপ্রাচীনকাল থেকে এ দেশে ইসলামী আর্দশ ও মূল্যবোধের লালন ও চর্চা হয়ে আসছে। ইসলামের এই সমুন্নত আর্দশ ও মূল্যবোধের প্রচার ও প্রসার কার্যক্রমকে বেগবান করার লক্ষ্যে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এ্যাক্ট অনুযায়ী এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিম্নরুপঃ”...
এবার ইসলামী ফাউন্ডেশন প্রকাশিত হাদিস কুরআন তথা ইসলামী বই থেকে কিছু উদাহরণ দেখাই যেখানে জনগণের টাকায় ঠিক কি শিক্ষা তারা দিচ্ছে বুঝা যাবে। দেশের জেনারেল শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে ইসলামী ফাউন্ডেশনের বই পড়লে একজন মানুষের মনে কি ধরণের বিষাক্ত মনোভাব তৈরি হবে সেটি দেখুন। আলীয়া মাদ্রাসার ইতিহাস সম্পর্কিত একটি বইয়ে খোদ আলীয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মোহাম্মদ ইয়াকুব শরীফের একটি বক্তব্য এভাবে তুলে ধরা হয়, ‘মুসলমানরা ছিল বীরের জাতি, ইংরেজ বেনিয়ারা ছলে-বলে-কৌশলে তাদের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে তাদের প্রচলিত ধর্ম, শিক্ষা, ও মর্যাদা হরণ করার জন্য পদে পদে যেসব ষড়যন্ত্র আরোপ করেছিল, আলিয়া মাদ্রাসা তারই একটি ফসল’ (আলীয়া মাদ্রাসার ইতিহাস, আবদুস সাত্তার, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত)।
অর্থাত ইংরেজি বিজ্ঞানসহ জেনারেল শিক্ষা ছিলো ইংরেজদের একটি ষড়যন্ত্র! এই বক্তব্য প্রকাশ করে ইসলামী ফাউন্ডেশন দেশের শিক্ষাক্রম হিসেবে কওমি মাদ্রাসাকেই তুলে ধরছে। বুঝানো হচ্ছে, মুসলমানদের ঈমানের উপর ধর্মের উপর থাকতে হলে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার উপর নয়, কওমি মাদ্রাসায় পড়ে মাওলানা মুফতি পাশ করলেই চলবে। চিন্তা করলে অবাক হতেই পারেন যে একটি সরকার ব্যবস্থা কি করে দ্বিচারি প্রচার ব্যবস্থা জারি রাখেন? ইসলামী ফাউন্ডেশন তো দেশের মূলধারার শিক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই বই প্রকাশ করছে!
এবার এমন কিছু হাদিসের বইয়ের কথা বলব যেসব হাদিস থেকেই মূলত জঙ্গিবাদের সূচনা হচ্ছে। এমন কি ‘জঙ্গিবাদের বই’ নিয়ে গ্রেফতার হওয়া বইগুলো কিন্তু এইসব মূল হাদিস বই থেকেই বিশ্লেষণ করে রেফারেন্স দিয়ে লেখা হয়ে থাকে। ইসলামী ফাউন্ডেশন তাদের প্রকাশিত বই দিয়ে এদেশের জনগণকে কি রকম উগ্র মুসলিম তৈরি করছে এবার দেখুন-
হাদিস বইয়ের নাম: সূনান নাসাঈ (ইফা:)
হাদিস নম্বরঃ (৩৯৭৯)
অধ্যায়: ৩৮/ হত্যা অবৈধ হওয়া
“প্রকাশনী: ইসলামিক ফাউন্ডেশন”
পরিচ্ছদ: এক. মুসলিমকে হত্যা করার অবৈধতা
৩৯৭৯. ইসহাক ইবন ইবরাহীম (রহঃ) … আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ না বলা পর্যন্ত আমি লোকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আদিষ্ট হয়েছি। যদি তারা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ বলে, তবে আমার পক্ষ হতে তাদের জানমাল রক্ষা করে নেবে কিন্তু এর হক ব্যতীত। আর তাদের হিসাব আল্লাহর যিম্মায়।
তাহক্বীকঃ সহীহ।
এই হাদিস যখন বাংলাদেশের সরকারী প্রতিষ্ঠা থেকে বের হয় তখন জনগণ এই শিক্ষাই পায় যে কোন অমুসলিমের অপরাধই হচ্ছে কেন সে মুসলমান নয়! কারণ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ অর্থাত আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয় স্বীকার করে না নিলে সেই কাফেরের জান মালের কোন নিরাপত্তা মুসলমানদের থেকে সে পাবে না! অথচ বাংলাদেশের সংবিধান জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের জান মালের নিরাপত্তার কথা বলা হয়েছে। তাহলে সরকারী একটি প্রতিষ্ঠান কি করে এই হাদিসটি প্রকাশ করল? এটি তো সাংঘর্ষিক! সরকার দেশের মুসলমানদের সরকারী পয়সায় যদি উগ্রবাদী করে তুলতে বই ছাপে তাহলে আলাদা করে অমুক তমুক হুজুর মাওলানাদের দোষ দিয়ে কি লাভ?
“রাতের আঁধারে অতর্কিত হামলায় নারী শিশু হত্যার বিষয়ে”
হাদিস বইয়ের নাম: সহীহ মুসলিম
“প্রকাশকী: ইসলামী ফাউন্ডেশন”
হাদিস নম্বরঃ (৪৩৯৯)
অধ্যায়: ৩৩/ জিহাদ ও এর নীতিমালা
পরিচ্ছদঃ ৯. রাতের অতর্কিত আক্রমনে অনিচ্ছাকৃতভাবে নারী ও শিশু হত্যায় দোষ নেই
৪৩৯৯। ইয়াহইয়া ইবনু ইয়াহইয়া, সাঈদ ইবনু মনসুর ও আমর আন নাকিদ (রহঃ) … সা’ব ইবনু জাছছামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে মুশরিকদের নারী ও শিশু সন্তান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলো, যখন রাতের আধারে অতর্কিত আক্রমণ করা হয়, তখন তাদের নারী ও শিশুরাও আক্রান্ত হয়। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তারাও তাদের (মুশরিকদের) অন্তর্ভুক্ত।
হাদিসের মানঃ সহি
নারী শিশু হত্যাকে জেনেভা কনভেনশন যুদ্ধাপরাধ হিসেবে ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশ সরকারও সেই ঘোষণায় সই করেছে। আর এখানে বলা হচ্ছে নিরপরাধ নারী শিশু হত্যায় কোন দোষ নেই! এই বই পড়ে একটি তরুণ কি শিক্ষা্ পাবে? অমুসলিম হলেই তার মানবাধিকার পাবার কোন অধিকার নেই? সেই শিক্ষা বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে চলবে যা বাংলাদেশের মূল চেতনার সঙ্গে সাংর্ষিক! কেউ বাংলাদেশের ৫০ বছরে এই প্রতিষ্ঠানের এইসব কার্যক্রম নিয়ে একটি প্রশ্ন করলেন না? জঙ্গিবাদের জন্য আমেরিকা ইজরাইল র এদের দোষ দিতে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা সব সময় তত্পর কিন্তু ইসলামী ফাউন্ডেশন কি ধরণের বই বের করে সে বিষয়ে তারা চুপ কেন?
“ইসলামের দাওয়াত দেয়ার পর কোন রকম ঘোষণা ছাড়াই আক্রমণ করা যাবে”
হাদিস বইয়ের নাম: সহীহ মুসলিম
হাদিস নম্বর: (৪৩৭০)
অধ্যায়: ৩৩/ জিহাদ ও এর নীতিমালা
“প্রকাশনী: ইসলামিক ফাউন্ডেশন”
পরিচ্ছদ: ১. যে সকল বিধর্মীর কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছেছে, পূর্ব ঘোষণা ব্যতীত তাদের বিরুদ্ধে আক্রমন পরিচালনা বৈধ
৪৩৭০। ইয়াহইয়া ইবনু ইয়াহইয়া তামীমী (রহঃ) … ইবনু আউন (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বললেন, আমি নাফি’ (রহঃ) কে এই কথা জানতে চেয়ে পত্র লিখলাম যে, যুদ্ধের পূর্বে বিধর্মীদের প্রতি দ্বীনের দাওয়াত দেওয়া প্রয়োজন কি না? তিনি বলেন, তখন তিনি আমাকে লিখলেন যে, এ (নিয়ম) ইসলামের প্রারম্ভিক যুগে ছিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনূ মুসতালিকের উপর আক্রমণ করলেন এমতাবস্থায় যে, তারা অপ্রস্তুত ছিল (তা জানতে পারেনি।) তাদের পশুদের পানি পান করানো হচ্ছিল। তখন তিনি তাদের যোদ্ধাদের (পূর্ণ বয়স্ক পুরুষ) হত্যা করলেন এবং অবশিষ্টদের (নারী শিশুদের) বন্দী করলেন। আর সেই দিনেই তাঁর হস্তগত হয়েছিল। (ইয়াহইয়া বলেন যে, আমার ধারণা হল, তিনি বলেছেন) জুওয়ায়রিয়া অথবা তিনি নিশ্চিতরূপে ইবনাতুল হারিছ (হারিছ কন্যা) বলেছিলেন। বর্ণনাকারী বলেন, এই হাদীস আমাকে আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রাঃ) বর্ণনা করেছেন। তিনি সেই সেনাদলে ছিলেন।
কী দারুণ শিক্ষা এই বই থেকে! অর্তিকত আক্রমন করে নারী শিশুদের বন্দি করা হলো। এগুলো হচ্ছে গণিমতের মাল! এই বই পড়ে যখন একজন তরুণ এগুলোকে মহান শিক্ষা হিসেবে নিবে তখন সে যখন বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে শুনবে যে এদেশের নারীদের ইসলামপন্থিরা ‘গণিমতের মাল’ ঘোষণা করেছিলো তখন সেই তরুণ কাদের পক্ষ নিবে? গণিমতের মাল যে একটি বর্বর যুদ্ধ আইন সেটি তো তার মনে হবে না। তাহলে সে কেমন মুসলমান হিসেবে তৈরি হবে? এই রকম মুসলমানই তৈরি হোক সেটিই কি বাংলাদেশ সরকার চায়?
“কাফেররা যদি আজান দিয়ে আত্মসমর্পন করে তাহলে হামলা নয়”
হাদিস বইয়ের নাম: সহীহ মুসলিম (ইসলামী ফাউন্ডেশন)
হাদিস নম্বর: (৭৩৩)
অধ্যায়: ৪/ কিতাবুস স্বলাত
প্রকাশনী: ইসলামিক ফাউন্ডেশন
পরিচ্ছদঃ ৬. দারুল কুফর বা অমুসলিম দেশে কোন গোত্রে আযানের ধ্বনি শোনা গেলে সেই গোত্রের উপর হামলা করা থেকে বিরত থাকা
৭৩৩। যুহায়র ইবনু হারব (রহঃ) … আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভোরে শক্রর বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করতেন। আযান শোনার অপেক্ষা করতেন। আযান শুনতে পেলে আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকতেন। আযান শুনতে না পেলে আক্রমণ করতেন। একবার তিনি কোন এক ব্যাক্তিকে اللَّهُ أَكْبَرُ اللَّهُ أَكْبَرُ বলতে শুলেন। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি ফিতরাত (দ্বীন ইসলাম) এর উপর রয়েছ। এর পর সে ব্যাক্তি أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ বলল। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি জাহান্নাম থেকে বেরিয়ে এলে। সাহাবায়ে কিরাম লোকটির প্রতি লক্ষ্য করে দেখতে পেলেন যে, সে ছিল একজন ভেড়ার রাখাল।
এই বইয়ের হাদিস পড়লে যে কেউ একই দেশে তার প্রতিবেশি অমুসলিমকে কি চোখে দেখবে একবার চিন্তা করুন। বাঙালী জাতীয়তাবাদ বলুন কিংবা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ- এরকম হাদিস বই একজন মানুষকে স্রেফ মুসলমান ছাড়া আর কোন জাতীয়তাবাদী করে তুলবে কি? চিন্তা করে দেখুন বাংলাদেশের সরকারী প্রতিষ্ঠান “ইসলামী ফাউন্ডেশন” থেকেই জঙ্গিবাদ উশকে দেয়ার মত বই প্রকাশিত করা হচ্ছে! কেউ এটি নিয়ে কোন কথাই বলছে না!
-সুষুপ্ত পাঠক
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................