১৯৯৬ সালের ৩১ জানুয়ারি: নৃশংসতার আবর্তে জগন্নাথ হল

১৯৯৬ সালের ৩১ জানুয়ারি:
নৃশংসতার আবর্তে জগন্নাথ হল

জগন্নাথ হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যালঘু তথা হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান সম্প্রদায়সহ আদিবাসী ছাত্রদের জন্য সংরক্ষিত বিশেষ হল। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম যে তিনটি হল নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল জগন্নাথ হল তার মধ্যে অন্যতম । মানিকগঞ্জের বালিহাটির জমিদার কিশোরীলাল রায় চৌধুরীর পিতা জগন্নাথ রায় চৌধুরীর নামে এই হলের নামকরণ করা হয়। এই হলের প্রথম প্রভোস্ট ছিলেন অধ্যাপক নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে বিখ্যাত অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু, অধ্যাপক জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, রমেশচন্দ্র মজুমদার, ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা এই হলের প্রভোস্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব ও অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য্য, অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্য সহ অসংখ্য শিক্ষক এবং ছাত্রকে বর্বর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নৃশংস অমানবিক অত্যাচার করে হত্যা করে এই হলে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলই বারবার সাম্প্রদায়িক শক্তির হামলার শিকারে পরিণত। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে এই হলেই হামলা করে বহু ছাত্র-শিক্ষককে নৃশংসভাবে হত্যা করে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। এমনকি স্বৈরাচার এরশাদের আমলেও অসংখ্য ছাত্র নির্যাতনের শিকার হয় রাষ্ট্রযন্ত্রের  ছত্রছায়ায়। ১৯৯৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ১ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ১৯৫২ এর ভাষা শহীদদের স্মরণে নিবেদিত অনুষ্ঠানমালা এবং মাসব্যাপী একুশের বইমেলা উদ্বোধন করতে আসবেন। কিন্তু ১৯৯৬ এর জানুয়ারি মাস জুড়ে সরকার বিরোধী আন্দোলন-বিক্ষোভ-প্রতিরোধ তুঙ্গে উঠে যায়। বিরোধী দলের ছাত্রসংগঠনসমূহ প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বাংলা একাডেমীর অনুষ্ঠান উদ্বোধন প্রতিরোধ করার আহবান জানায়। প্রশাসন তখন সেই প্রতিবাদ প্রতিরোধকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে, বাংলা একাডেমিতে বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য হলগুলোতে পুলিশি অভিযান না চালিয়ে ; অভিযান চালায় সংখ্যালঘুদের জগন্নাথ হলে। তৎকালীন সরকার পুলিশি অভিযানের নামে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে অভূতপূর্ব বর্বর আক্রমণ শুরু করে জগন্নাথ হলে।

১৯৯৬ সালের ৩১ জানুয়ারি, প্রায় ৭০০ পুলিশ আর বিডিয়ার জওয়ান ( বর্তমানে বিজিবি) নৃশংসভাবে হামলা চালায় জগন্নাথ হলে। তারা ছাত্রদের উদ্দেশ্যে অশ্রাব্য এবং চরম সাম্প্রদায়িক কটূক্তি করে তাদের বেদম প্রহার করে, লুঠতরাজ করে হলের ছাত্রদের সামান্য সঞ্চয় এবং নষ্ট করে তাদের অমূল্য বইপত্র। আরাধ্য দেব-দেবীর ছবি, প্রতিমা অপবিত্র করে । হলের প্রত্যেকটা রুমে ঢুকে ঢুকে নৃশংস-অমানবিক অভিযান চালায় পুলিশ। শর্টগান দিয়ে গুলি করে, বুট দিয়ে ছাত্রদেরকে পিষ্ট করে, ডাইনিং রুম তছনছ করে অসভ্যতার ষোলকলা চূড়ান্ত করে তৎকালীন পুলিশ বাহিনী। এ রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িক হামলা চলে প্রায় ৩ ঘণ্টাব্যাপী। ৪০ টির বেশি রুম তছনছ করা হয়। হামলায় আহত হয় প্রায় তিনশত ছাত্র। পুলিশ গ্রেফতার করেছিল শতাধিক ছাত্রকে। তাদের মধ্যে কোর্টে চালান দিয়েছিলো ৫৪ জনকে।সেদিন জগন্নাথ হল থেকে পুলিশ কোন অস্ত্র উদ্ধার করতে পারেনি। যাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল তারা ছিল মেধাবী ছাত্র। অনেকে ছিল পরীক্ষার্থী, তাদের কারও বিরুদ্ধে অতীতে সন্ত্রাসের কোনো অভিযোগ ছিল না। আদালতেও তা প্রমাণ করা যায়নি। যার ফলে, 'ডিটেনশন'এর মামলায় জামিন না হলেও এ ক্ষেত্রে আদালত গ্রেফতারকৃত সব ছাত্রকে জামিন দিয়েছিল।

হামলা শুরু হয় বিকাল আনুমানিক দুপুর ১ টার দিকে। ৩৩৫ নাম্বার রুমে পুলিশ প্রথম আক্রমণ করে। অনুপ বসাক, শান্ত রেমাক, সেবাস্তিয়ান রেমা, কার্তিক চন্দ্র সেনা আর দীপঙ্কর সাংমা সেখানে গল্প করছিলেন। পুলিশ দরজা ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকে আর টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। পুলিশ অনুপের মুখে গামছা পেচিয়ে ধরে যাতে সে চীৎকার করতে না পারে এবং অন্য পুলিশ না তাকে পেটায়। বুকসেলফ আর বিছানা পত্র তছনছ করে ছাত্রদের টাকা আর দামি জিনিসপত্র   লুট করা হয়।

৩৩১ নম্বর রুমের ছেলেরা খাটের তলায় লুকায়। সেখান থেকে পুলিশ তাদের বের করে পিটায়। বিপু কুমার নামে এক অতিথি ঢাকায় এসেছিলেন অসুস্থ আত্মীয়কে হাসপাতালে দেখতে। তার কাকা ছিলেন জগন্নাথ হলের আবাসিক ছাত্র। তিনি তার কাকার সাথে দেখা করতে জগন্নাথ হলে যান। তাকেও পুলিশ মারতে মারতে অজ্ঞান করে ফেলে। 

৩২৯ নম্বর রুমের প্রকাশ বৈদ্য, পরিচয়পত্র দেখিয়েও  হায়েনার রূপ ধরা পুলিশের নির্মম আক্রমণের হাত থেকে বাঁচতে পারেনি।

৩৩২ নম্বর  রুমে  ৪ জন ছাত্রের ২ জন ছাত্র চারতলা থেকে লাফ দেয় জানালা দিয়ে। সেখানে সন্দ্বীপ এবং বিষ্ণু চক্রবর্তীর ঘড়ি লুট করে পুলিশ। ফিজিক্স এর ছাত্র ফোটন চন্দ্র সুত্রধরকে পুলিশ কাপড় দিয়ে মুখ চেপে ধরে তারপর কম্বল দিয়ে মুখ ঢেকে রাইফেলের বাঁট দিয়ে পিটায়। তাকে বলা হয়, তাকে মেরে ফেলা হবে এবং পুলিশের প্রচণ্ড প্রহারে সে অজ্ঞান হয়ে যান। অন্য একজন ছাত্র অজ্ঞান হয়ে গেলে, পুলিশ তাকে মৃত মনে করে হলের বাইরে নিয়ে যায়। 

পুলিশ বিমল কৃষ্ণ বালা এবং অরুণ বালা কে চারতলা থেকে ফেলে দেয়। প্রথমজনের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে যায় এবং দ্বিতীয় জনের পা ভেঙ্গে যায়। 

৩৬০ নম্বর রুমের মিলন গোলদারকে মারতে মারতে পুলিশ তাদের লাঠি ভেঙ্গে ফেলে।

৩৮৮, ৩৯২ নম্বর রুমেও একই কাহিনীর পুনরাবৃত্তি  হয়। 

ক্যান্টিনেও পুলিশ হামলা চালায়। ভোজনরত ছাত্রদের খাবার ফেলে দিয়ে তাদের পিটাতে থাকে। ক্যান্টিন বয় আর ম্যান্যাজারও পুলিশের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে পারেনি। 

এ নির্মম অসভ্যতার অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী বর্তমানে ব্রিটেন প্রবাসী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৯৪-৯৫ সেশনের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের প্রথমবর্ষের ছাত্র শ্রীকঙ্কন কান্তি ঘোষ। প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে সেদিনের ঘটনার ইতিহাসের একজন সাক্ষী হিসেবে তিনি তার বর্ণনায় যা বলেছেন তা সংক্ষেপে তার নিজের ভাষায় আমি তুলে ধরছি:

" খালেদা জিয়ার ১ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমীর বইমেলার অনুষ্ঠান উদ্বোধনের প্রতিরোধের ঘোষণা থেকেই ধারাবাহিকভাবে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করতে থাকে ক্যাম্পাসের  চারিদিকে, যা ৩০ তারিখ রাত্রি থেকেই তীব্র হয়। অসংখ্য সাদা পোশাকের ডিবি, এনএসআই ঘোরাফেরা করতে থাকে জগন্নাথ হলের আশেপাশে। আমি ক্লাশ করে দুপুর ১ টার দিকে হলে আসি, এবং হলে এসেই উপলব্ধি করি যে হলে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটতে চলছে। আমি থাকতাম সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য্য ভবনের চারতলায় ৩৮৪ নং রুমে। রুমটি ছিলো ছাত্রলীগের পলিটিক্যাল রুম।

দুপুরের পরে থেকেই দাঙ্গা পুলিশেরা কয়েক ঘন্টা হলের বাইরে থেকে রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপের একপর্যায়ে আড়াইটা থেকে তিনটার মধ্যে হলের বিভিন্ন গেট দিয়ে প্রবেশ শুরু করে। আমরা দশবারো জন একটা রুমে জড়ো হই । রুমটি ছিলো, ৩৮৪ নাম্বার হতে বাথরুমের দিকে যেতে মাঝামাঝি একটি রুম।অসম্ভব ভয়ের পরিবেশ বিরাজ করছিল চারিদিকে। আমাদের মধ্যেই  কেউ কেউ খাটের নিচেও  লুকিয়ে ছিলো।

কিছু সময় পরে পুলিশ হলের অন্যান্য রুমের মতো আমরা ৩৮৪ নাম্বার হতে বাথরুমের দিকে যেতে মাঝামাঝি যে  রুমে জড়ো হই ; সেই রুমের দরজা ভেঙে প্রবেশ করে এবং অনবরত আমাদের  লাঠিচার্জ করতে করতে সবাইকেই সিড়ি দিয়ে ফেলে দিতে  থাকে। এরপরে  তারা আমাদের সবাইকেই অক্টোবর ভবনের সামনেই নিয়ে এসে জড়ো করতে থাকে। সবাইকেই অক্টোবর ভবনের সামনে গরুছাগলের মতো জড়ো করে তারা যখন পুলিশের প্রিজন ভ্যানে তোলে তখন আমার মনে হচ্ছিলো আমি বোধহয় এখনিই মরে যাব। তিল ধারণের স্থান ছিলো না ভ্যানটিতে।

পুলিশ সদস্যরা অসম্ভব হিন্দুবিরোধী  সাম্প্রদায়িক কটূক্তি করতে থাকে। আমাদের সামনেই অক্টোবর ভবনের সামনে জগন্নাথ হলের তৎকালীন প্রভোস্ট জগদীশ শুক্লদাশ স্যারকে প্রচণ্ড অপমানিত করে।

১ ফেব্রুয়ারি আমাদের কোর্টে চালান করে আমাদের বিরুদ্ধে পুলিশের কাজে বাধাদান সহ রাষ্ট্রদ্রোহিতার মিথ্যা অভিযোগ আনা হয়। সেই অহেতুক মিথ্যা অভিযোগে আমি দশবারো দিন জেল খেটে আপাতত  মুক্তি পাই। তবে অনেকেই দুই-তিন মাস জেল খেটে মুক্তি পায় । অভিশপ্ত ৩১ জানুয়ারির ষড়যন্ত্রের দুঃসহ স্মৃতিটি মনে পরলে, আমার এ প্রবাসী জীবনে বসে আজও ভয়ে শিউরে উঠি। তাই আমি ঘটনার সাথে যুক্ত অভিযুক্ত প্রত্যেকটি ব্যক্তির  দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।"

হামলার যারা শিকার, যারা প্রত্যক্ষদর্শী সকলেরই অভিমত হচ্ছে, একাত্তরে জগন্নাথ হলে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যে হামলা চালিয়েছিল, গণহত্যার অংশটুকু বাদ দিলে ১৯৯৬-এর হামলা সেই বর্বরতা ও পৈশাচিকতার সঙ্গে তুলনীয়। সরকার ও মৌলবাদ সমর্থক ৬ টি পত্রিকা বাদ দিলে সর্বাধিক প্রচারিত ইত্তেফাক ও জনকণ্ঠসহ ১৬টি জাতীয় পত্রিকার ১ ফেব্রুয়ারি সংখ্যার শিরোনাম ছিল, জগন্নাথ হলে পুলিশী নির্যাতনের সংবাদ। ঘটনার বিবরণ প্রায় প্রত্যেকটি জাতীয় দৈনিকে ছিল একই রকম।

সেই সময় এদেশের বিশেষ করে ঢাকার প্রগতিশীল জাতীয় দৈনিকগুলি যে ভূমিকা পালন করেছিল তা উল্লেখ করার মতো। অনেকগুলো দৈনিক সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয় ও একাধিক কলাম লিখে তাদের ভূমিকাকে উজ্জ্বল করেছিল। দেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক, কলামিস্ট সেইসব উপ-সম্পাদকীয় ও কলাম লিখেছিলেন। তবে সবচেয়ে প্রশংসনীয় দায়িত্ব পালন করেছেন শাহরিয়ার কবির। তিনি সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন, সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয়, হামলা সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া, বিভিন্ন সংগঠনের বিবৃতি, হামলায় ক্ষয়-ক্ষতির বিবরণ, আহত ছাত্রদের তালিকা, প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাৎকার এবং সংবাদপত্রে প্রকাশিত আলোকচিত্র গ্রন্থিত করে প্রকাশ করেছিলেন একটি ''শ্বেতপত্র। খালেদা জিয়া সরকারের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের মুদ্রিত দলিল হয়ে শ্বেতপত্রটি ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে।

৩ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ভোরের কাগজে আবেদ খান "মন জয় করার বদলে যুদ্ধ জয় করলেন প্রধানমন্ত্রী" এই শিরোনামে লিখেছিলেন: "পুরনো কাগজ উল্টালে দেখা যাবে '৭৫ সালের আগস্টের পর থেকে এই একুশ বছরে জগন্নাথ হলের উপর পুলিশী এবং সরকারের পেটোয়া বাহিনীর হামলা হয়েছে কমপক্ষে ৫০ বার। কেবলমাত্র বর্তমান সরকারই নয়, জিয়াউর রহমানের আমলে এবং এরশাদের আমলেও এই ধরনের হামলা হয়েছে কয়েকবার। সব সরকারই যেন মনে করেছে জগন্নাথ হলের উপর একহাত নিয়েই বুঝি ভারতের উপর একহাত নেওয়া যায়। একি অদ্ভুত মানসিকতা! জগন্নাথ হলের মধ্যে কি প্রচুর পরিমাণে অস্ত্রশস্ত্র-গোলাবারুদ সবসময় থাকে বলে পুলিশ কিংবা প্রত্যেকটি সরকারের ধারণা? একটি ব্যাপার যে, যে স্থানটি বারংবার লক্ষ্যবস্তু হয়, সেই স্থানটিতে কেউ বেআইনি অস্ত্রশস্ত্র রাখবে না। তাহলে কেন করা হচ্ছে? কোন সুস্থ সরকার যদি হতো তাহলে তার প্রথম ও প্রধান দায়িত্বই হতো সংখ্যালঘুদের প্রতিটি অবস্থানের পরিপূর্ণ দায়িত্ব বিধান করা। তারা যে এই দেশেরই সম্মানিত নাগরিক-এ বোধটি তাদের মনের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করা। তাহলে অন্ততপক্ষে আমাদের যে গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধ সেটা যথার্থ মর্যাদায় অভিষিক্ত হতো। সেটা তো করা হয়নি উপরন্তু প্রতিটি টার্গেট করা হয়েছে তাদের। বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্ত্র উদ্ধার অভিযান চালানো হবে, তালিকায় গোড়াতেই নাম রাখ জগন্নাথ হলের; বিক্ষোভ দমন করতে হবে, লাঠিসোটা নিয়ে ঢুকে যাও জগন্নাথ হলে; ছাত্রদের মধ্যে গোলাগুলি হচ্ছে, চালাও ভাংচুর জগন্নাথ হলে। একি কাণ্ড! মনে হচ্ছে ভারতের ওপরকার সব ঝাল ঝাড়া হচ্ছে জগন্নাথ হলের ওপর! যেন জগন্নাথ হল শায়েস্তা হলেই ফিট হয়ে যাবে ভারত।"

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য হলের মধ্যে জগন্নাথ হল কেন বার বার আক্রান্ত হয় ; কেন '৭৫ থেকে '৯৬ এই ২১ বছরে অর্ধশত বার হামলা চালানো হল জগন্নাথ হলে? সাংবাদিক আবেদ খানের লেখায় তার অত্যন্ত যৌক্তিক উত্তর আছে।

৪ ফেব্রুয়ারি দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত হয়েছিল মুনতাসীর মামুনের  "প্রধানমন্ত্রীর বাংলা একাডেমী অভিযান" শিরোনামে একটি  দীর্ঘ প্রবন্ধ। সেখানে তিনি লিখলেন :
"বিশ্ববিদ্যালয়ের এতগুলো হলের মধ্যে একমাত্র জগন্নাথ হলকেই টার্গেট করা হয়? শিক্ষক সমিতির সভায় হলের পদত্যাগকারী প্রভোস্ট জানিয়েছেন, গত কয়েক বছরে প্রায় শ'খানেক বার বিভিন্ন রকমের হামলা হয়েছে হলে।এর কারণ কি এখানে হিন্দু ছাত্ররা থাকে? হলে ঢুকে ছাত্রদের 'মালাউন' বলা হয়েছে। তা হলে হিন্দুরা কি এদেশে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক?"

৫ ফেব্রুয়ারি দৈনিক সংবাদে সুলতানা নাহার লিখলেন "গণতান্ত্রিক সরকার (?) বনাম জগন্নাথ হল":
"জগন্নাথ হলে যা ঘটেছে তা একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী ভাল বলতে পারবেন। কিন্তু পরদিন সেখানে গিয়ে যা দেখেছি, তাতে আমি একাধারে শংকিত ও লজ্জিত হয়েছি। অনেকের ধারণা যে, এ হলের ছাত্ররা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ছাত্র বলেই তাদেরকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের ওপর সুপরিকল্পিতভাবে নির্মম পুলিশী হামলা চালানো হয়েছে। এ হামলা পাকিস্তানী বাহিনীর হামলারই তুল্য, নৃশংসতা ও ব্যাপকতায়। একটি স্বাধীন দেশে একটি গণতান্ত্রিক সরকারের অধীনে এমন ঘটনা ঘটতে পারে, তা কোনো সুস্থ মানুষ বা সভ্য সমাজ মেনে নিতে পারে না।"

শুধু বিএনপি কেন, এদেশের রাজনৈতিক দলের কাছে গণতন্ত্র মানে নির্বাচনে ভোট পাওয়া না পাওয়া, নির্বাচিত সংসদ এবং সরকার গঠন এর বেশি কিছু নয়। দলের আদর্শের পুঁথিপত্রে অসাম্প্রদায়িকতা থাকলেও, গণতন্ত্র এদেশে কোন দল কিংবা নেতাকে অসাম্প্রদায়িকতা, পরমতসহিষ্ণুতার শিক্ষা দেয় না। গণতন্ত্রের 'কনসেপ্ট' রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় যাই হোক, এদেশে গণতন্ত্র এবং সাম্প্রদায়িকতা পরস্পর বিরোধী নয়। তাই একজন অন্যজনের পিঠে চুলকে আনন্দ  দেয়। সেজন্যেই হয়ত সংখ্যালঘু ছাত্রাবাস জগন্নাথ হলে বারে বারে হামলা হয়,সেই হামলায় নেতৃত্ব দেয় সরকার। সেই সরকারকে সুলতানা নাহার সভ্য সরকার বলতে না পারেন, তাতে তার মানসিকতাকে আমরা অভিনন্দন জানাতে পারি, কিন্তু দিনশেষে সংখ্যালঘু ছাত্রদের কোন উপকার হয় না। বিচারহীনতার কারণে সংখ্যালঘুদের কাছে সংগঠিত সকল ঘটনার পরিনতি একই; রূপ আলাদা, স্থান-কাল-পাত্র আলাদা হলেও দিনশেষে, "যেই লাউ, সেই কদু"- ফলাফলই তাদের কপালে জোটে।

১৪ ফেব্রুয়ারি কলম তুলে ধরলেন, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী; লিখলেন "এ কোন বাংলাদেশ?" শিরোনামে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি প্রবন্ধ। সেখানে তিনি বললেন:
"মুক্তিযুদ্ধের সময় জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মুক্তিযোদ্ধাই ছিল পাক দখলদার বাহিনীর টার্গেট, নির্বিচারে বধযোগ্য শিকার। কিন্তু একটা বাড়তি ক্রোধ ও নিষ্ঠুরতা প্রদর্শিত হয়েছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের নারী পুরুষের প্রতি। স্বাধীন বাংলাদেশেও একটি গোষ্ঠী, সরকারি ও বেসরকারি, হিন্দু সম্প্রদায়ের নাগরিকদের বিদ্বেষের চোখে দেখেন, অকারণে তাদের ওপর স্টিমরোলার চালান। গত ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু ছাত্রদের আবাসিক হল জগন্নাথ হলে যে নারকীয় কাণ্ড ঘটালো বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা, তাই আমাকে এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, এ কোন্ বাংলাদেশে বাস করছি আমি?"

১৪ ফেব্রুয়ারি অধ্যাপক শফি আহমেদ দৈনিক সংবাদে "নির্বাচন, সাম্প্রদায়িকতা ও ভারত" নামে একটি নিবন্ধ লিখলেন। সে নিবন্ধে তিনি লিখলেন :

"সংখ্যালঘু ছাত্রদের ওপর এটি একটি একতরফা পুলিশী দাঙ্গা ছাড়া আর কিছু নয়। পুলিশ খাবার থালা ফেলে দিয়ে বলেছে- হিন্দুরা রোজা রাখে না কেন, 'বল শালা জয়বাংলা বল' এমন চিৎকার করে তাদের হুংকার দিয়েছে। ... যাই হোক না কেন, এই সরকারের আমলে বা এই সরকারের বাহিনীর কাছে সংখ্যালঘুদের মর্যাদা কি রকমের তার একটা প্রামাণ্য প্রদর্শনী দেখা গেছে জগন্নাথ হলে।এমন সংবাদ পাওয়া গেছে যে,পুলিশ হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি ভেঙেছে, ছবি ছিঁড়েছে।রোজার মাসে কাফেরদের প্রতি যথাযথ আচরণের এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর কি থাকতে পারে?"

৫ ফেব্রুয়ারি ভোরের কাগজে, প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব ও এসকাপের প্রাক্তন নির্বাহী সচিব শাহ এ.এম.এস কিবরিয়া, "জগন্নাথ হলকেই আক্রমণের টার্গেট করা হল কেন?" -এ শিরোনামে কলাম লিখলেন। সেখানে তিনি বললেন:

"বিএনপি সরকার যে ধর্মান্ধতার আশ্রয় নিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরীহ ছাত্রদের উপর জুলুম করবে তা অনেকেই ভাবতে পারেনি।"

৩১ জানুয়ারি, খালেদা জিয়া সরকারের পুলিশ বাহিনী সংখ্যালঘু ছাত্রদের উপরে  যে নৃশংসতা চালিয়েছে তার  সম্পূর্ণ বিবরণ জানতে হলে শাহরিয়ার কবির সম্পাদিত ৭২ পৃষ্ঠার শ্বেতপত্রটি পড়তে হবে। শ্বেতপত্রটি পড়লে সেদিনের ঘটনার সম্পূর্ণ বিবরণ চোখের সামনে ভেসে উঠবে। গ্রেফতারের পর পুলিশ যে ৫৪ জন ছাত্রকে কোর্টে চালান করেছিল শাহরিয়ার কবিরের 'শ্বেতপত্র' থেকে তাদের নাম ও রুম নম্বরগুলো দেয়া হল:

১. নারায়ণ চন্দ্র ঘােষ-(৩৮০), ২. রমেশ চন্দ্র বিশ্বাস-(৩৮৩), ৩. পঙ্কজ, ৪. বিপ্লব-(৪৪৬), ৫. পলাশ কর্মকার-(৩৩০), ৬.নীলমণি-(৩৬১,ঘ), ৭. প্রকাশ অধিকারী-(৩৬২), ৮.সুব্রত-(৩৮৩), ৯. শ্যামল কুমার-(২৬৩), ১০.সুভাষ চন্দ্র-(৩৬১,ঘ), ১১. শুভ প্রসাদ-(৩৮২), ১২. অশােক কুমার মুখার্জী-(৩০৮), ১৩. রাজেশ চাঘা-(৩১৪), ১৪. রঞ্জন সরকার-(৩৮৩), ১৫. বিপ্লব কুমার সরকার-(৩৮০), ১৬. অনন্ত কুমার-(৩৮১), ১৭. তরুণ কুমার কর্মকার-(৩০৮), ১৮.বিষ্ণুপদ বিশ্বাস-(১১৯), ১৯. অশােক কুমার মহিম-(৩৮১), ২০. প্রতুল বিশ্বাস-(৩৮২), ২১.প্রণব কুমার-(৩৮২), ২২. অজিত বালা-(৩০৫), ২৩. উৎপল দত্ত-(৩৩৪), ২৪. বিদ্যুৎ কুমার ঘােষ-(৩১৮), ২৫. দিলীপ-(৩৪৭), ২৬. তাপস আচার্য-(৩১৬), ২৭. মনিশঙ্কর-(৩১৮), ২৮. সমর বিশ্বাস-(৩০৩), ২৯. রবীন্দ্রনাথ রায়-(৩১৬), ৩০. অজিত তালুকদার-(৩১৬), ৩১.সুকেশ-(৩১০), ৩২. হেমন্ত কুমার-(৩৬২), ৩৩.সন্তোষ বিশ্বাস-(৩৩০), ৩৪. সঞ্জয় কুমার-(৪৭১), ৩৫.স্বপন কুমার হাওলাদার-(৩৪৯), ৩৬. আঃ হাসান সিদ্দীক-(৭৮,এস এম হল), ৩৭. সঞ্জীব কুমার বিশ্বাস-(৫৩), ৩৮. নীলমণি-(৩১৬), ৩৯.পংকজ সাহা-(৪৬৭), ৪০. বিজয় বসু-(২০/১), ৪১. দেবাশীষ সাহা-(৩৫২), ৪২. সুশান্ত কুমার মণ্ডল-(৩৮২), ৪৩. গােবিন্দ চন্দ্র রায়, ৪৪. মাহানাম ব্রত-(৩২২), ৪৫. মানষ তালুকদার-(৪৪৬), ৪৬. প্রদীপ মজুমদার-(৪৫), ৪৭. কাকন কান্তি-(৩৮১), ৪৮.রামচন্দ্র দাস-(৫৪), ৪৯. প্রিয়ঙ্কর-(৩১৪), ৫০. নবারুণ দাস-(২০৬), ৫১. প্রবাল চন্দ্র বিশ্বাস-(৩৮২), ৫২. ফোটন চন্দ্র সূত্রধর-(৩১০), ৫৩. সুশান্ত কুমার সাহা-(৩৬৩), ৫৪.শেখ রেজাউল ইসলাম-(১৭১, এস এম হল)।

বিএনপি, তার অঙ্গ সংগঠন, কয়েকটি চিহ্নিত মৌলবাদী দল এবং তাদের দলীয় মুখপত্র ছাড়া এদেশের সব রাজনৈতিক দল, ছাত্র-যুব-নারী সংগঠন, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পেশাজীবী জোট ও সংগঠন জগন্নাথ হলে হামলার নিন্দা, ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানিয়েছিল। ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল বাংলাদেশ মানবাধিকার সমন্বয় পরিষদ। দেশের প্রগতিশীল সাংবাদিক, লেখক, কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীরা অনন্য দায়িত্ব পালন করেছিলেন তাদের লেখার মাধ্যমে। হল পরিদর্শনে গিয়ে সহানুভূতি প্রকাশ করেছিলেন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিজীবীরা, পেশাজীবীরা, ছাত্র, যুবক, নারী, সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতা, কর্মীরা। সকলের সহানুভূনিতে জগন্নাথ হলের ছাত্রদের ভেঙ্গে যাওয়া মনোবল আবার জেগে উঠেছিল। তারা এই ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ, নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। তিনটি বিরোধী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী ৩ ফেব্রুয়ারি' ৯৬, জগন্নাথ হলে পুলিশী বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে অর্ধদিবস হরতাল পালন করেছিল ঢাকায়।

জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট এবং হাউস টিউটররা একযোগে পদত্যাগ করেছিলেন ঘটনার প্রতিবাদে। কিন্তু বিএনপি মনোনীত তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমদ পুলিশের এত অত্যাচারের পরেও হল পরিদর্শনে যান নি। আহত ছাত্রদের দেখতে যাননি হাসপাতালে। ছাত্ররা তার বাসভবনে গেলে তাদের সাথে দেখা করেননি। পুলিশ সেখানেও ছাত্রদের লাঠিপেটা করে। 'মালাউন' ছাত্রদের জন্যে উপাচার্য এমাজউদ্দিন আহমদের ন্যূনতম সহানুভূতি বা কর্তব্যবোধ উদয় হয়নি।

৩১ জানুয়ারি ১৯৯৬, জগন্নাথ হলের হামলা সম্পর্কে সরকার কোন প্রেসনোট জারি করেনি। কেন এ ধরণের নৃশংস ঘটনা ঘটল, সরকার  এর জন্যে কোন তদন্ত কমিটি গঠন করেনি। এ ধরণের কোন ঘটনা ঘটলে সাধারণত সরকার অস্বস্তিকর অস্বাভাবিক বোধ করে । কিন্তু তৎকালীন সরকারের আচরণে মনে হয়েছে, বিষয়টিতে  তারা অনুতপ্ত তো নয়ই,  সামান্যতম দুঃখিতও নয়। ঘটনাটি নিয়ে তাদের বক্তব্য ছিল, ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা প্রধানমন্ত্রীর বাংলা একাডেমী আগমনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে পুলিশের উপর গুলি বর্ষণ করলে, পুলিশ বাধ্য হয়ে জগন্নাথ হলে ঢুকে হামলা চালায়। পুলিশের বক্তব্য ছিল, তারা 'সন্ত্রাসীদের' ধরার জন্য এবং অস্ত্র উদ্ধারের জন্যে জগন্নাথ হলে হামলা চালিয়েছে।

১৯৯৬ সালটি ছিল স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীবর্ষ। জগন্নাথ হলে সংখ্যালঘু  ছাত্রদের উপরে তৎকালীন সরকারের অহেতুক নির্মম অত্যাচার ছিল -অভাগা, চতুর্থশ্রেণীর এই মালাউন ছাত্রদের জন্যে তৎকালীন বিএনপি  সরকারের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার শ্রেষ্ঠ  উপহার!

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি :
১. ১৯৯৬ সালের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক।
২. শাহরিয়ার কবির সম্পাদিত 'শ্বেতপত্র'।
৩.প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাৎকার 
৪.কঙ্কর সিংহ, রাষ্ট্র সাম্প্রদায়িকতা এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী 
সহকারী অধ্যাপক, 
সংস্কৃত বিভাগ 
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted