বাংলাদেশের হিন্দু
দিনকে দিন আমার ব্যবসার পরিধি বাড়তে থাকে। টিয়াকাঠিতে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায়, বরফ কলটি একটানা প্রায় দুই সপ্তাহ বন্ধ ছিল। তখন জেলা শহরে বরফ সংগ্রহ করতে গিয়ে, যশোরের একজন আড়তদারের সঙ্গে পরিচয় হয়। এক ট্রাক দুই ট্রাক করে, সে আমার কাছ থেকে এত বিশাল পরিমাণ মাছ কিনতে থাকে; জেলেরা কখন মাছ নিয়ে আসবে- সেই ভরসায় বসে না থেকে, মাছ সংগ্রহের জন্য আমাকে সাগরে ট্রলার পাঠাতে হয়। আমি অপরিণত বয়স্ক হলেও, জেলেরা আমাকে যথেষ্ট বিশ্বাস করতো। আমার কথা শুনলে ট্রলার বোঝাই করে মাছ দিয়ে দিত। পরে সুবিধা মতো সময় এসে টাকা নিয়ে যেত। অনেক জেলেই বলছে, "তোমার ধারে টাহা পাওনা থাকলে মনে করি, ঐ টাহা ব্যাংকে আছে। টাহাডা চাওয়া মাত্তর পাওন যায়।"
এরপর বরিশাল, ঢাকা, কিশোরগঞ্জ প্রভৃতি শহরের আড়তদারদের সঙ্গে ব্যাবসায়িক সংযোগ স্থাপিত হওয়ার পর, টিয়াকাঠি বাজারের কাছাকাছি বন্ধ হয়ে যাওয়া একটা ধানের চাতাল ভাড়া নেই। সেখানে ট্রলার থেকে মাছ নামিয়ে- বরফ দিয়ে প্যাকিং করে- ট্রাকে তুলে আড়তদারদের কাছে পাঠাই।
জেলা শহরের বেশ কয়েকজন আড়তদার এসে টিয়াকাটি বাজারে মৎস্য-ক্রয় কেন্দ্র স্থাপন করলো। আমি মাছ কেনার কৌশল বদলাই। আমাকে মাছ দিতে- জেলেদের আর কষ্ট করে টিয়াকাঠি পর্যন্ত আসতে হয় না। জেলেদের কাছ থেকে অপেক্ষাকৃত স্বল্প মূল্যে মৎস্য সংগ্রহ করতে, আমার ট্রলারগুলো প্রতিদিন সাগরে অপেক্ষা করে।
টিয়াকাঠিতে আরও একটি বরফকল স্থাপিত হয়। তা সত্ত্বেও আড়তদারদের এত বিশাল পরিমাণ মাছ সরবরাহ করতাম- প্রতিদিন ট্রাক ও ট্রলার বোঝাই করে, জেলা শহর থেকে বরফ আনতে হতো।
টিয়াকাটি বাজারে টেলিফোন ও ব্যাংকিং সুবিধা ছিল না। এজন্য জেলা শহরে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে, টেলিফোনের সামনে সর্বক্ষণ বসে থাকার জন্য একজন এবং ব্যাংকের কাজ করার জন্য দু'জন লোক রাখতে হলো।
ব্যবসা পরিচালনা করার জন্য আমি বেশ কয়েকজন দক্ষ লোক পেয়েছিলাম। এটা আমার সৌভাগ্য-ই বলতে হবে। যদিও সেই লোকদের মধ্যে একজনও সৎ ছিল না। সুযোগ পেলেই তারা টাকা মেরে দিত। আমি অনেক কিছু দেখেও, না দেখার ভান ধরতাম। ভাবতাম, আমাকে হাজার টাকা আয় করে দিচ্ছে, সেখানে যদি কেউ পঞ্চাশ টাকা মেরে খায়, ক্ষতি কি! সর্বোপরি ওদের ছাড়া আমি ব্যবসা চালাতে পারবো না। এই কথা আমি নির্দ্বিধায় স্বীকার করতে বাধ্য যে, আমার স্টাফদের কাছ থেকে আমি অনেক কিছুই শিখেছি। বিশেষ করে লেবারদের কাছ থেকে কিভাবে প্রাপ্য কাজ আদায় করে নিতে হয় এবং প্রতিকূল পরিস্থিতি অনুকূলে নিয়ে আসার সুচতুর কৌশল।
সিজনে মাছের এত চাহিদা থাকতো, আড়তদারেরা অগ্রিম টাকা পাঠিয়ে দিত। ক্ষতিকর লোকদের নজর এড়াতে, জেলা শহরের আর্থিক লেনদেন কমিয়ে দিয়ে, বরিশাল শহরে অধিকাংশ ব্যাংকিং লেনদেন করার সিদ্ধান্ত নেই। এবং এজন্য সেখানেও টেলিফোন সহ একটা ঘর ভাড়া নিয়ে, তিনজন লোকের কর্মসংস্থান করি।
ঐ সময়টাকে দক্ষিণবঙ্গে সামুদ্রিক মৎস্য ব্যবসার স্বর্ণযুগ বললেও অত্যুক্তি হবে না। তখন বুদ্ধিমান প্রতিযোগী কম ছিল; যে কারণে অতি সহজেই দারুণ মুনাফা করা যেত। অনেকের কাছে হয়তো গল্পের মতো শুনাবে ― বয়সে আমার থেকে ৮/১০ বছরের বড়- উত্তর বঙ্গ থেকে আসা একজন মৎস্য শ্রমিককে দেখেছি, জেলা শহরের লঞ্চ টার্মিনালে রাতের পর রাত গামছা বিছিয়ে, ইটের উপর মাথা রেখে ঘুমাতে। সেই ব্যক্তি মৎস্য ব্যবসা শুরু করার পর, তার এমন নাটকীয় উত্থান ঘটেছে- সে আজ বাংলাদেশের অন্যতম গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক। বেশ কয়েক বছর সে শীর্ষ রপ্তানিকারকের পুরস্কার লাভ করেছে।
মাধ্যমিক পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপের সময় প্রধান শিক্ষক মহোদয় বললেন, "ব্যবসা-বাণিজ্য করস, টাহা-পয়সাও হইছে শোনলাম। কোন হেল্প লাগলে কইস।"
অর্থাৎ, হেড স্যারের শিক্ষাবোর্ডে ভালো চ্যানেল আছে। আমি যদি মনে করি যে, পাশ করতে পারব না; তাহলে হেড স্যারকে টাকা দিলে- তিনি আমাকে পাশ করিয়ে আনতে পারবেন। সুভাষ স্যার মাথা নেড়ে ঠোঁট কামড়ে দৃঢ়তার সঙ্গে হেড স্যারকে বললেন, "দরকার হইবে না স্যার, আর্টস গ্রুপ ফার্স্ট ডিভিশন পাওয়া মুশকিল। তবে ওর যা প্রিপারেশন, ফার্স্ট ডিভিশন না পাইলেও, মাস্ট হায়ার সেকেন্ড ডিভিশন থাকপে।"
সুভাষ স্যারের অনুমান সঠিক ছিল; কিন্তু পরীক্ষার হলে সরাসরি বই দেখে উত্তর লেখার সুযোগ থাকার সুবাদে, ফার্স্ট ডিভিশন-ই পেয়েছিলাম। আমাদের মাধ্যমিক পরীক্ষার কেন্দ্র ছিল 'হৃদয়খালী উচ্চ বিদ্যালয়'। সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রত্যেক পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে ৫০০ টাকা করে চাঁদা নিয়ে, যথাস্থানে ঘুষ দিয়েছিলেন ― ফলে প্রতিটি পরীক্ষার্থী, পরীক্ষার হলে নোট বই নিয়ে প্রবেশ করার অনুমতি পেয়েছিল।
মাত্র আড়াই-তিন বছরের মধ্যে আমার অর্থনৈতিক অবস্থার এত অচিন্তনীয় উন্নতি ঘটে; সেই দুরন্ত কৈশোরের শেষ প্রান্তে এসে, আমার পক্ষে নিজেকে কন্ট্রোলে রাখা- অত্যন্ত মুশকিল হয়ে ওঠে। তবে সামরিক সরকারের দুর্নীতিগ্রস্থ প্রশাসন এবং তাদের আদরের লালিত সন্ত্রাসীচক্রের উপর্যুপরি চাপ- আমাকে এতটাই উদ্বিগ্ন রাখত এবং তাদের সৃষ্ট সমস্যা সমাধান করার জন্য আমাকে দিনরাত এত চিন্তাশক্তি ব্যয় করতে হতো- শেষ পর্যন্ত হয়তো আমি উচ্ছন্নে যাওয়ার পর্যাপ্ত সময় ও সুযোগ পাইনি।
আমার ম্যানেজার প্রখর বুদ্ধিমান কৈলাস বাবু, অশুভ-শক্তি সমূহ বশে রাখতে দু'হাতে কত টাকা ব্যয় করেছে; নিজে কতটা কমিশন পকেটস্থ করেছে - পরিস্থিতির খাতিরে সে হিসাব আমি রাখিনি।
টিয়াকাঠির মেম্বার-চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে জেলা শহরের হোমরা-চোমরা পর্যন্ত, বহু জায়গায় বহু জনকে- বহু ধরনের অনুদান, ঘুষ, চাঁদা, জিজিয়া কর ইত্যাদি দিতে হয়েছে। আমার তৎকালীন উপার্জনের অন্তত চারভাগের একভাগ সেই বিশাল সংখ্যক অপশক্তির পিছনে ব্যয় করতে হয়েছে। অথচ আমার আশপাশের ইসলাম ধর্মালম্বী ব্যবসায়ীদের- ঐ সব ফালতু লোকদের পিছনে একটি পয়সাও অপচয় করতে হতো না।
আজকের তুলনায় তখনকার মানুষ কিছুটা সহজ-সরল ছিল বিধায়, ওখানকার ক্রিমিনালরা হয়তো সেসময় বুঝে উঠতে পারেনি যে, সামুদ্রিক মাছের কারবারে- কত বিশাল আর্থিক লেনদেন; কিংবা আমার মতো একজন কিশোর বয়সী হিন্দু- কত টাকা জমিয়ে ফেলেছে! আমার ধারণা, তখন যদি তারা আমার সঞ্চয়ের কথা জেনে যেত- তাহলে হয় তারা আমার সমস্ত টাকা কেড়ে নিতো; নতুবা আমাকে মেরে ফেলতো।
জেলা শহরের ঐতিহ্যবাহী সরকারি কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে অ্যালাউ হয়ে গেলাম। ভর্তি হতে গিয়ে শুনি, একটানা বেশি দিন অনুপস্থিত থাকলে সমস্যা হতে পারে। এজন্য হৃদয়খালী বন্দরের বেসরকারি কলেজে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হলাম। নিজের সামাজিক স্তর উন্নীত করার লক্ষ্যে- আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার কমিয়ে দিয়ে, প্রমিত বাংলায় কথা বলার অনুশীলন করতে লাগলাম। টিয়াকাটি থেকে কলেজে যাতায়াত এবং ব্যবসায়িক কাজে জেলা শহরে গমনাগমন করতে- একটা মোটর সাইকেল কিনলাম। এছাড়াও শহরের মধ্যে বিভিন্ন কাজে দ্রুত চলাচল করতে- মোটর সাইকেলটা যথেষ্ট সহায়ক-ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল।
(চলবে)
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................