শিবনামে সকল পাপ দূর হয়

শিবনামে সকল পাপ দূর হয়

খদির বা খয়ের গাছের কাঠ অত্যন্ত মজবুত। এ কাঠে উইপোকা, ঘুণপোকা সহ প্রায় কোন পোকাই ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে না। ঘরের খুঁটি, গরুর গাড়ির চাকা, লাঙল, ঢেঁকি সহ কাজে কাঠটি ব্যবহৃত হয়। এ কাঠের জলন্ত কয়লাতে উত্তাপ প্রচুর। সহজেই সেই কয়লাকে স্পর্শ করা যায় না। দগ্ধ হওয়ার ভয়ে যেমন খদির কাঠের কয়লাকে স্পর্শ করে না; ঠিক তেমনি পাপও যিনি সদাশিবের স্মরণে থাকেন তাকে আশ্রয় করে না। "ওঁ নম শিবায়"- এ বৈদিক মন্ত্র নিত্য জপ করা কর্তব্য।

উদ্ধৃতঞ্চ কুলং তৈস্তু যে শিবং সমুপাসতে।
যস্য মুখে শুভং নাম সদা শিবশিবেতি চ।।
পাপনি ন স্পৃশন্তীহ খদিরাঙ্গারকং যথা। 
শ্রীশিবায় নমস্তুভ্যং মুখাদ্ব্যাহরতে যদা।।
তন্মুখঞ্চ তদা যো বৈ পশ্যতি তৎক্ষণে নমঃ।
তীর্থজন্যং ফলং তস্য ভবতীতি সুনিশ্চিতম্।।
(শিবমহাপুরাণ:জ্ঞানসংহিতা, ৩৭.৬-৮)

“যারা শিব উপাসনা করেন তাঁদের অনন্তকুল উদ্ধার হয়; যার মুখে ‘শিব শিব’ এই নাম সর্বদা আছে, যে প্রকারে খদিরকাষ্ঠের অঙ্গারকে লোক স্পর্শ করে না, সেই প্রকারে পাপসকলও শিবের নাম জপ করা ব্যক্তিকে স্পর্শ করতে পারে না।যার মুখ থেকে 'শ্রীশিবায় নমঃ' এ পবিত্র মন্ত্র উচ্চারিত হয়, সে সময়ে শিবের নাম উচ্চারণ করা ব্যক্তির মুখ যিনি দর্শন করেন, তাঁর তীর্থদর্শনের ফল লাভ হয়।”

ভারতবর্ষের শাশ্বত সংস্কৃতি শিবময়।  প্রত্যেকটি জীবকেও স্বয়ং শিবের স্বরূপ মনে করা হয়। আজও কেউ ভুল করলে, মিথ্যা কথা বলে থাকলে, অনিচ্ছায় অপরাধ করে থাকলে শিবের নাম উচ্চারণ করে পাপক্ষালন করি। জগৎজুড়ে ভগবান শিব তো আছেন, যে শ্মশানে কেউ যেতে চায় না; সেই শ্মশানেও তিনি নিত্যবাস করেন। যেখানেই শিব, সেখানেই সত্য এবং সেখানেই সুন্দর। শিব শব্দটির  শুভ, মঙ্গলদায়ক, সুখদায়ক, সত্য, রম্য, সুন্দর বিবিধ অর্থ প্রকাশ করে। এর মধ্যে শুভ এবং মঙ্গলদায়ক অর্থে বেশি ব্যবহৃত হয়।বেদেও একাধিক স্থানে শুভ,মঙ্গলদায়ক এবং সুখদায়ক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এ মঙ্গলদায়ক ভগবান শিব  প্রসঙ্গে শুক্লযজুর্বেদে 'শিবসঙ্কল্প' সূক্ত নামে সুবিখ্যাত একটি সূক্ত হয়েছে। সেই সূক্তে চঞ্চল মনকে বারবার 'শিবসঙ্কল্পমস্তু' বা মঙ্গলরূপ শুভ সংকল্পযুক্ত হতে প্রার্থনা করা হয়েছে। 

যজ্জাগ্রততা দূরমুদৈতি 
দৈবং তদু সুপ্তস্য তথৈবৈতি।
দূরঙ্গমং জ্যোতিষাং জ্যোতিরেকং
তন্মে মনঃ শিবসঙ্কল্পমস্তু। 

যেন কর্মাণ্যপসাে মনীষিণাে 
যজ্ঞে কৃণ্বন্তি বিদথেষু ধীরাঃ। 
যদ্ পূর্বং যক্ষমন্তঃ প্রজানাং 
তন্মে মনঃ শিবসঙ্কল্পমস্তু ॥ 

যৎ প্রজ্ঞানমুত চেতাে ধৃতিশ্চ
যজ্যোতিরন্তরমৃতং প্রজাসু।
যস্মান্ন ঋতে কিঞ্চন কর্ম ক্রিয়তে 
তন্মে মনঃ শিবসঙ্কল্পমস্তু ।। 

যেনেদং ভূতং ভুবনং ভবিষ্যৎ
পরিগৃহীতমৃতেন সর্বম্।
যেন যজ্ঞস্তায়তে সপ্তহােতা
তন্মে মনঃ শিবসঙ্কল্পমস্তু ।।

যস্মিন্নৃচঃ সাম যজূংষি যস্মিন্ 
প্রতিষ্ঠিতা রথনাভাবিবারাঃ।
যম্মিংশ্চিত্তং সর্বমােতং প্রজানাং 
তন্মে মনঃ শিবসঙ্কল্পমস্তু।। 

সুষারথি-রশ্বানিব যন্মনুষ্যান্নে-   
নীয়তেঽভীশুভির্বাজিন ইব।
হৃৎপ্রতিষ্ঠং যদজিরং জবিষ্ঠং 
তন্মে মনঃ শিবসঙ্কল্পমস্তু ॥
(শুক্লযজুর্বেদ সংহিতা:৩৪.১-৬)

"যে মন, জাগ্রত অবস্থায় ইন্দ্রিয়াদি অপেক্ষা দূরগামী, সুষুপ্তিকালে সর্ব বিষয় থেকে নিবর্তিত হয়ে হৃদয়ে লয় হয়, যা দূরগামী ও শব্দাদি বিষয়ের প্রকাশক জ্ঞানেন্দ্রিয়সমূহেরও যিনি একমাত্র প্রকাশক সেই আমার মন শুভ কল্যাণকর সংকল্পযুক্ত হােক ৷ 

মনীষাসম্পন্ন কর্মকাণ্ডীগণ যে মন দ্বারা যজ্ঞাদি কর্মসকল অনুষ্ঠান করে থাকেন, যা ইন্দ্রিয়সমূহের পূর্বে সৃষ্ট, যজ্ঞপটু, প্রাণীদিগের অন্তরস্থ সেই আমার মন শুভ কল্যাণকর সংকল্পযুক্ত হােক ৷ 

যে মন বিশেষ জ্ঞানের জনক, চেতয়িতা, ধৈর্যযুক্ত সকল প্রাণীর অন্তরে থেকে সর্বেন্দ্রিয়ের প্রকাশক জ্যোতি অমৃত, যে মন ব্যতীত কেউ কোন কর্ম করতে পারে না, সেই আমার মন শুভ কল্যাণকর সংকল্পযুক্ত হােক। 

মুক্তি পর্যন্ত স্থায়ী যে শাশ্বত মনের দ্বারা ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমানকালীন দ্রব্যসমূহ পরিগৃহীত হয়, যার দ্বারা সপ্তহােতা নিপ্পন্ন অগ্নিষ্টোমাদি যজ্ঞ বিস্তৃত হয় সেই আমার মন শুভ কল্যাণকর সংকল্পযুক্ত হােক।

রথ নাভিতে অরাসমূহ যেমন প্রতিষ্ঠিত থাকে সেইরূপ ঋক্, সাম, যজুঃ যাতে প্রতিষ্ঠিত, যে মনে প্ৰজাসকলের জ্ঞানপটের সুতাের ন্যায় ওতপ্রােত রয়েছে সেই আমার মন শুভ কল্যাণকর সংকল্পযুক্ত হােক। 

কৌশলী সারথি যেরূপ কশা দ্বারা অশ্বকে পরিচালিত করেন তদ্রপ যিনি প্রাণিসমূহকে ইতস্তত নিয়ে যান, কৌশলী সারথি যেরূপ লাগাম দ্বারা অশ্বকে সংযত করেন সেইরূপ যে মন জীবকে নিয়মন করেন, যেই মন হৃদয়ে অধিষ্ঠিত, জরারহিত, বেগবান সেই আমার মন শুভ কল্যাণকর সংকল্পযুক্ত হােক।"

গ্রামের একজন তথাকথিত অশিক্ষিত কৃষক এবং মৎস্য শিকারী জেলেও বিশ্বাস করেন,"যত্র জীব, তত্র শিব"। প্রত্যকটি জীবের মাঝেই শিবের প্রাকাশ। এ জড় চেতন এ জগত শিবময়। পৃথিবীর বিশাল একটি অংশ জুড়ে শিবের মন্দির প্রতিষ্ঠিত। যেখানেই শিব সেখানেই শিবের বিভূতি। হিমালয়ের কৈলাস থেকে শুরু করে একেবারে দক্ষিণ পর্যন্ত সারা ভারতবর্ষে অসংখ্য শিবমন্দির বিরাজিত। এর মধ্যে পবিত্র দ্বাদশ শিবলিঙ্গ আছে,তাদের দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ বলে। এ জ্যোতির্লিঙ্গগুলো হল: কাশীতে বিশ্বনাথ; উত্তরাখণ্ডে কেদারনাথ; গুজরাটে সোমনাথ; মহারাষ্ট্রে নাগেশ্বর , ভীমাশঙ্কর, ঘৃষ্ণেশ্বর, ত্রম্ব্যকেশ্বর; ঝাড়খণ্ডে বৈদ্যনাথেশ্বর ; মধ্যপ্রদেশে মহাকালেশ্বর, ওঙ্কারেশ্বর; তামিলনাড়ুতে রামেশ্বর; অন্ধ্রপ্রদেশে মল্লিকার্জুন জ্যোতির্লিঙ্গ। স্বয়ম্ভু এ লিঙ্গমূর্তিতে শিব স্বয়ং বিরাজমান। তবে আশ্চর্যের বিষয় রামেশ্বর কেদারনাথ এ স্বয়ম্ভুলিঙ্গ সহ শিবের সাতটি প্রাচীন মন্দির রয়েছে একই সরলরেখায়। মন্দিরগুলোর দ্রাঘিমাংশ একই ; প্রত্যেকটি মন্দিরই ৭৯ ডিগ্রি ৪১ মিনিট ৫৪ সেকেন্ড পূর্বে অবস্থিত।

ওঁ নমঃ শিবায় শান্তায় কারণত্রয়হেতবে ।
নিবেদয়ামি চাত্মানং ত্বং গতিঃ পরমেশ্বরঃ ।।

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী 
সহকারী অধ্যাপক, 
সংস্কৃত বিভাগ, 
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted