শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবনায়
যিনি ব্রহ্ম, তিনিই শক্তি
১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে হুগলি জেলার কামারপুকুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আদ্যাশক্তি মহামায়ার এক পাগল সন্তান শ্রীগদাধর চট্টোপাধ্যায়। উত্তরকালে যিঁনি জগতে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব নামেই খ্যাত হন।তাঁর পিতার নাম ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় এবং মাতার নাম চন্দ্রমণি দেবী। তিনি ছিলেন তাঁর পিতামাতার চতুর্থ ও শেষ সন্তান। দেবী কালীই ছিলেন তাঁর জীবনের একমাত্র ধ্যান এবং জ্ঞান। একজন সাধক কেমন হওয়া উচিত এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব।তিনি কোন নাম-যশ বা জাগতিক সমৃদ্ধি কামনা করেননি জগজ্জননীর কাছে। শুধুই তাঁর শ্রীচরণে আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন।তাই আজও যখন দেবী কালিকার প্রতিমা তৈরি করা হয় তখন, সেই প্রতিমায় পায়ের কাছে শ্রীরামকৃষ্ণকে সস্ত্রীক স্থান দেয়া হয়। গভীর অরণ্যের মত বেদান্তের গূঢ় ভাবকে বাংলা ভাষায় তিনিই প্রথম সার্থকভাবে সরল ভাবে সাধারণের মাঝে প্রকাশ করেন এবং প্রচার করেছেন ।
বেদান্ত অনুগত তাঁর জীবনের শেষের কয়েকটি বছরের কথা নিয়ে রচিত হয় 'শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত' নামে এক অভূতপূর্ব দার্শনিক গ্রন্থ। গ্রন্থটিকে বেদান্তদর্শনের সাধারণজনের ভাষ্যও বলে অবিহিত করা যায়। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের কথাগুলো সংকলিত করেন, শ্রীমহেন্দ্রনাথ গুপ্ত। যিঁনি 'শ্রীম' নামেই জগদ্বিখ্যাত। বেদান্তের প্রায় সকল বিষয় নিয়েই কথা বলেছেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব।১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১ অক্টোবর বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী সহ আরও বেশ কিছু ভক্তের উপস্থিতিতে ঈশ্বর উপাসনার সাকার নিরাকার আপাতবিরোধী এ দুটিভাবের প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব অত্যন্ত সুন্দর করে বুঝিয়ে বলেন।তিনি বলেন, অধিকারীভেদে এ দুটি ভাবেরই একান্ত প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
"সব মানতে হয় গো — নিরাকার-সাকার সব মানতে হয়। কালীঘরে ধ্যান করতে করতে দেখলুম রমণী খানকী! বললুম, মা তুই এইরূপেও আছিস! তাই বলছি, সব মানতে হয়। তিনি কখন কীরূপে দেখা দেন, সামনে আসেন, বলা যায় না।
একটু গীতা, একটু ভাগবত, একটু বেদান্ত পড়ে লোকে মনে করে, আমি সব বুঝে ফেলেছি। চিনির পাহাড়ে একটা পিঁপড়ে গিছ্ল। একদানা চিনি খেয়ে তার পেটে ভরে গেল। আর-একদানা মুখে করে বাসায় নিয়ে যাচ্ছে। যাবার সময় ভাবছে, এবারে এসে পাহাড়টা নিয়ে যাব! (সকলের হাস্য)"
(শ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত: দ্বিতীয় ভাগ,১৮.৩)
অনন্ত অসীম ঈশ্বরের উপাসনার সাকার নিরাকার দুটি ভাবকেই স্বীকার করে, বিষয়টি নিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের বৈদান্তিক একত্বের ভাবনা বেদেও পাওয়া যায়। বেদে পরমেশ্বরের মূর্ত এবং অমূর্ত দুটি রূপেরই কথা বলা আছে। ঈশ্বর সাকারও না, নিরাকারও না ; তিনি চিন্তার অতীত একটা সত্ত্বা।তিনি সর্বত্র বিরাজিত, প্রত্যেকটি জীবের হৃদয়ে বিরাজিত, প্রত্যেকটি বস্তুতে বিরাজিত।
দ্বে বাব ব্রহ্মণো রূপে মূর্তং চৈবামূর্তং
চ মর্ত্যং চামৃতং চ স্থিতং চ যচ্চ সচ্চ ত্যচ্চ।।
(বৃহদারণ্যক উপনিষদ:২.৩.১)
"ব্রহ্মের দুইটি রূপ, মূর্ত(মূর্তিমান) ও অমূর্ত(অমূর্তিমান), মর্ত্য ও অমৃত, স্থিতিশীল ও গতিশীল, সৎ (সত্তাশীল) ও ত্যৎ (অব্যক্ত)।"
১৮৮৪, ১৯ শে অক্টোবর বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীদের সাথে একান্ত আলোচনায় বলেন, মারূপী যে কালী তিনিই ব্রহ্ম। পূর্ণজ্ঞানের উদয় হলে সকল ভেদ বিদূরিত হলে অভেদতত্ত্বের উদয় ঘটে। এ প্রসঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলেন:
"তুমি তাঁকে মা মা বলে প্রার্থনা করছিলে। এ-খুব ভাল। কথায় বলে, মায়ের টান বাপের চেয়ে বেশি। মায়ের উপর জোর চলে, বাপের উপর চলে না। ত্রৈলোক্যের মায়ের জমিদারী থেকে গাড়ি গাড়ি ধন আসছিল, সঙ্গে কত লাল পাগড়িওয়ালা লাঠি হাতে দ্বারবান। ত্রৈলোক্য রাস্তায় লোকজন নিয়ে দাঁড়িয়েছিল, জোর করে সব ধন কেড়ে নিলে। মায়ের ধনের উপর খুব জোর চলে। বলে নাকি ছেলের নামে তেমন নালিশ চলে না।
যিনি ব্রহ্ম, তিনি কালী (মা আদ্যাশক্তি)। যখন নিষ্ক্রিয়, তাঁকে ব্রহ্ম বলে কই। যখন সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় — এই সব কাজ করেন, তাঁকে শক্তি বলে কই। স্থির জল ব্রহ্মের উপমা। জল হেলচে দুলচে, শক্তি বা কালীর উপমা। কালী! কিনা — যিনি মহাকালের (ব্রহ্মের) সহিত রমণ করেন। কালী 'সাকার আকার নিরাকার'। তোমাদের যদি নিরাকার বলে বিশ্বাস, কালীকে সেইরূপ চিন্তা করবে। একটা দৃঢ় করে তাঁর চিন্তা করলে তিনিই জানিয়ে দেবেন, তিনি কেমন। শ্যামপুকুরে পৌঁছিলে তেলীপাড়াও জানতে পারবে। জানতে পারবে যে তিনি শুধু আছেন (অস্তিমাত্রম্) তা নয়। তিনি তোমার কাছে এসে কথা কবেন — আমি যেমন তোমার সঙ্গে কথা কচ্ছি। বিশ্বাস করো সব হয়ে যাবে। আর-একটি কথা — তোমার নিরাকার বলে যদি বিশ্বাস, তাই বিশ্বাস দৃঢ় করে করো। কিন্তু মতুয়ার বুদ্ধি (Dogmatism) করো না। তাঁর সম্বন্ধে এমন কথা জোর করে বলো না যে তিনি এই হতে পারেন, আর এই হতে পারেন না। বলো আমার বিশ্বাস তিনি নিরাকার, আর কত কী হতে পারেন তিনি জানেন। আমি জানি না। বুঝতে পারি না। মানুষের এক ছটাক বুদ্ধিতে ঈশ্বরের স্বরূপ কি বুঝা যায়? একসের ঘটিতে কি চারসের দুধ ধরে? তিনি যদি কৃপা করে কখনও দর্শন দেন, আর বুঝিয়ে দেন, তবে বুঝা যায়; নচেৎ নয়।
‘যিনি ব্রহ্ম, তিনিই শক্তি, তিনিই মা।’
প্রসাদ বলে মাতৃভাবে আমি তত্ত্ব করি যাঁরে।
সেটা চাতরে কি ভাঙবো হাঁড়ি, বোঝনা রে মন ঠারে ঠোরে ।।
আমি তত্ত্ব করি যাঁরে। অর্থাৎ আমি সেই ব্রহ্মের তত্ত্ব করছি। তাঁরেই মা মা বলে ডাকছি। আবার রামপ্রসাদ ওই কথাই বলছে, —
আমি কালীব্রহ্ম জেনে মর্ম, ধর্মাধর্ম সব ছেড়েছি।"
(শ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত: প্রথম ভাগ,১২.৯)
একাগ্র সাধনার ফলে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব জগন্মাতা আদ্যাশক্তি মহামায়াকে শুধু দর্শনই করেননি, নিজের হাতে খাবার খাইয়ে দিয়েছেন। তাঁর সাধনার গুণে এবং শক্তিতে নিরাকার, নির্গুণ, অচিন্ত্য, বাক্য মনের অগোচর আদ্যাশক্তি মহামায়া সাকাররূপ ধারণ করে কৃপা করতে বাধ্য হয়েছে। পরমেশ্বরের কোন নির্দিষ্ট রূপ এবং মূর্তি নেই।মূর্তি আছে ভক্তের মানসলোকে। সাধক যদি সেই উচ্চকোটির হয় তবে, সাধকের কল্যাণার্থে অরূপ স্বরূপ হয়ে সীমার মাঝে ধরা দেন। ঈশ্বর অনন্ত, তাঁর রূপ বৈচিত্র্যও অনন্ত। তাই আমি ঈশ্বর সম্পর্কে যতটুকু বুঝতে পেরেছি, এতেই যদি নিজের সিদ্ধান্ত এবং বিশ্বাস অন্যের উপরে চাপিয়ে দেই; তবেই বিষয়টি ভারগ্রস্ত হাস্যকর হয়ে যায়। একথা স্মর্তব্য যে, ঈশ্বর অনন্ত; তাই তাঁকে উপাসনা করার পদ্ধতিও অনন্ত।
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................