চিন্তাসূত্রের খেরোখাতা (প্রথম পর্ব)

চিন্তাসূত্রের খেরোখাতা 
(প্রথম পর্ব)

১.শ্রীমদ্ভাগবতে রাধা নেই, রাধা আছে ভক্ত হয়ে ভক্তের হৃদয়ে।

২.বেশী গর্জন করা মেঘ বর্ষণ করে না, 
তবুও মানুষ তার কাছে বৃষ্টির প্রত্যাশা করে, 
কিন্তু দিনশেষে পায় বজ্রপাত। 

৩.ঘেউঘেউ করা কুকুর, সাধারণত কাউকে 
না কামড়ালেও বিশ্বস্ত হয়।

৪.প্রেম-ভালবাসার সম্পর্ক আপেক্ষিক ; স্থান কাল পাত্র ভেদে পরিবর্তিত হয়।

৫.দুর্জনের কাছে অহৈতুকী প্রেম বিতরণ মূর্খতা।

৬.জন্মগত বংশীয় শত্রুতা আমৃত্যু থাকে। যেমন সাপে বেজির শত্রুতা জন্মগত। 

৭. যে সংস্কৃতি যত বেশী দৃশ্যমান তাকে গ্রাস করা ততই কঠিন। শুধুমাত্র সংস্কৃতির বায়বীয় উপাদানকেই অন্য সংস্কৃতি গ্রাস করে।

৮. প্রত্যেক জাতির খাদ্যাভ্যাস ভৌগোলিক পরম্পরায় স্বাভাবিকভাবে গড়ে উঠেছে। ধর্ম সম্প্রদায়ের নামে নিজ খাদ্যাভ্যাস অন্যের উপরে চাপিয়ে দিলে বিড়ম্বনার সৃষ্টি হয়।

৯.ঈশ্বরের ভাব, অসীমের মধ্যেও সসীম। 

১০. প্রয়োজনে ঈশ্বর ডাকেন,আসেন,শরীরে থাকেন জীবের মাঝে।

১১. বৃক্ষ-লতা-পাতা বা তথাকথিত নিরামিষই একমাত্র সাত্ত্বিক আহার নয়। যা সহজপাচ্য,আয়ু, আরোগ্য, বল, জীবনীশক্তি সম্পন্ন তাকেই সাত্ত্বিক আহার বলে।

১২. ব্যক্তিস্বার্থে মানুষ অসহিষ্ণু হয়ে ধীরেধীরে ভাল মানুষের মুখোশ খুলে ফেলে।

১৩. ছদ্মবেশী বিনয়ের অভিনয় মানুষ বেশীক্ষণ করতে পারে না, টাকাপয়সা এবং অন্যান্য সুরসুরিতে আসল স্বরূপ বের হয়ে যায়।

১৪.আধারহীন বায়বীয় প্রেতই কোন জীবশরীরে ঢুকে ভুত হয়ে যায়।

১৫. নারীপুরুষের সাম্যাবস্থা আকাঙ্ক্ষিত, কিন্তু সম্পূর্ণরূপে আদৌ সম্ভব না।

১৬. একজন মানুষকে চিনতে হলে, জানতে হলে তার অনুগত মানুষের সাথে তার ব্যবহার দেখে চিনতে হবে। 

১৭.প্রত্যেক প্রতিবাদের একটা নান্দনিকতা আছে, কিন্তু নান্দনিকতাকে ডাস্টবিনে ফেলে যে প্রতিবাদ তাতে কল্যাণ নেই, শুধু হিংসার আগুনই জ্বলে।

১৮.যার মেধা আছে, তার সাংগঠনিক দক্ষতা নেই।
যার সাংগঠনিক দক্ষতা আছে, তার জ্ঞান নেই।
যার জ্ঞান আছে, তার বিনয় নেই।
যার বিনয় আছে, তার সামর্থ্য নেই।
যার সামর্থ্য আছে, তার আগ্রহ নেই।
যার আগ্রহ আছে, তার আত্মত্যাগ নেই। 
ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে!

১৯.বর্তমান হিন্দুদের নিয়ে কাজ করা আর মান্দারগাছে পিঠ ঘসা একই ; রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত হওয়া ছাড়া গতি নেই। যারাই বেশী কাজ করবে তাদেরই নিজ সম্প্রদায়ের থেকে আত্মঘাতী, কুৎসিত, বিকৃত আনন্দের শিকারে পরিণত হতে হবে।

২০. অপ্রয়োজনীয় নামকীর্তন মহোৎসব, যে স্থানে কীর্তন ১ টা হলেই চলে, সেখানেই লোকদেখানো ২৫/৩০ টা মহোৎসব করতেই হবে এবং খিচুড়ি খাওয়ার মহোৎসবের নামে টাকার শ্রাদ্ধশান্তি করে জাতিগঠন এবং জাতিউদ্ধার হয় না। এগুলি মেকি লোকদেখানো। 

২১. নিষ্ঠার সাথে সাত্ত্বিক পূজার বদলে রাজসিক, তামসিক দুর্গাপূজা, কালীপূজা,সরস্বতীপূজা সহ বিভিন্ন পূজার লোকদেখানো আয়োজনে, বাঙালি হিন্দুদের অসারত্ব বেড়ে সম্প্রদায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। 

২২. জাতির চিন্তা না করে বিভিন্ন বাবা, গুরু, স্বঘোষিত অবতারদের এবং তাদের ছেলেমেয়ে, নাতিপুতি, চৌদ্দগুষ্ঠির জন্মমৃত্যুর দিনে প্রোগ্রামের নামে অহেতুক সারাবছরব্যাপী কোটিকোটি টাকা খরচে হিন্দু সম্প্রদায় লাভবানের বদলে ক্ষতিগ্রস্ত এবং ক্ষয়িষ্ণু হচ্ছে।

২৩. সর্বধর্ম সমন্বয়ের ঠিকাদারি জগতে শুধুমাত্র একা হিন্দু সাধুসন্তের নয়; ডোনেশন বন্ধ করলে, এ আত্মঘাতী ঠিকাদারি এমনিতেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হবে।

২৪. সকল ব্যবসা বন্ধ হল, 
খোলা রইলো গুরুর দ্বার, 
গুরুর ব্যবসা চলে ভাল, 
যদি থাকে ভাল ক্যানভাসার।

২৫.সকল সাধুই সাধু না।সাধুত্ব এবং পাণ্ডিত্য সবার থাকে না; কিন্তু গেরুয়া বস্ত্র সর্বদা প্রণম্য।

২৬. জলের সাপ সাধারণত কাটে না, তবুও মানুষ ভয় পায়।

২৭. জীবনে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া শিক্ষাগুলি দেখে শুনেও, আমরা জীবনে খুব একটা ব্যবহার করি না।

২৮. সনাতন ধর্ম শাশ্বত, কোন ব্যক্তিকেন্দ্রিক মত নয়। ব্যক্তিকেন্দ্রিক মতে প্রবর্তক ব্যক্তিকে ছেটে ফেলে দিলে মতবাদের অস্তিত্ব থাকে না। কিন্তু হাজার হাজার ব্যাক্তিদের ছেটে ফেলে দিলেও সনাতন ধর্মের সামান্য হেলদোল হয় না।

২৯. মানুষ জন্ম থেকে আমৃত্যু বিদ্যার্থী ; একদিনের শিশু থেকে শতবছরের বৃদ্ধ প্রত্যেকেই একজন বিদ্যার্থী। 

৩০. ঈশ্বর সাকারও না, নিরাকারও না ; তিনি চিন্তার অতীত একটা সত্ত্বা।

৩১. ঈশ্বর কোন পাঁচতলা, সাততলা, দশতলার উপরে পাপপুণ্যের ক্যালকুলেটর হাতে নিয়ে  আরামচেয়ারে বসে নেই, তিনি সর্বত্র বিরাজিত, প্রত্যেকটি জীবের হৃদয়ে বিরাজিত, প্রত্যেকটি বস্তুতে বিরাজিত। 

৩২. জগৎ একটি বৃহত্তর নাট্যমঞ্চ। এ নাট্যমঞ্চে নারীদের মা এবং বোনের চরিত্র ছাড়া, অন্য চরিত্রে সর্বদা একইভাবে পাওয়া যায় না।

৩৩. পুরাণের মধ্যে ইতিহাস আছে, ধর্ম আছে, সমাজ বাস্তবতা আছে, কল্পনাও আছে; তাই গ্রহণ বর্জনের মাধ্যমে পুরাণের ভাববস্তু গ্রহণ করতে হবে।

৩৪. শিখদের গুরুগ্রন্থসাহেব ধর্মগ্রন্থটি অতিরিক্ত পূজা পাঠের সংস্কারে বদ্ধ হয়ে, সাধারণ মানুষের হাতের কাছে নেই।

৩৫. কোন একক গ্রন্থেই জগতের সকল জ্ঞান থাকতে পারে না, এ অমোঘ সত্যটি উপলব্ধি করে, বেদ একটি নামে অসংখ্য গ্রন্থের একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থাগার। 

৩৬. গত দুইশত বছরে বাংলায় অবতারের ফ্যাক্টরি হয়ে গেছে, রাস্তা থেকে লোক ধরে ধরে এনে অবতার সাজিয়ে পূজা করছি এবং করে চলছি আমরা।

৩৭. একটা বিসিএস ক্যাডার হওয়া যতটা কঠিন, এরথেকেও সহজ বাঙালি হিন্দুর তথাকথিত অবতার হওয়া। শুধুমাত্র কলামূলা খাওয়া দিবান্ধ তেলবাজ কিছু চেলা হলেই হল।

৩৮. সারাদিন হরিনাম জপ করলে যদি সকল কিছুই হত, তবে কুরুক্ষেত্রে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যুদ্ধ করতে নিষেধ করে হাতে জপমালা দিয়ে ১০০০ মালা হরিনাম জপ করতে বলতেন।

৩৯. যিনি জীবকে মায়ার বন্ধনে উন্মাদ করেন, প্রয়োজনে তিনিই জীবকে মুক্ত করেন।

৪০. জীবন মানেই মানিয়ে নেয়া, জীবন মানেই অভিনয়; যতক্ষণ বেলুনে বাতাস থাকে এ দুটো করেই যেতে হয়।

৪১. সব নগ্নতাই অশ্লীলতা নয়, নগ্নতাতে কোথাও কোথাও আছে সৌন্দর্য, সৃষ্টি, ভালবাসা এবং সমর্পণ। 

৪২. আদরের উপবাসেই, পূর্ণ হয় ভালবাসা। 

৪৩.বই একটি খোলা বারান্দার মত, যে বারান্দায় দাড়ালে মন প্রসারিত হয়ে যায়, সকল সংকীর্ণতা চলে গিয়ে দৃষ্টি সুদূরপ্রসারী হয়ে যায়। আমাদের প্রতিদিন সময় করে সে বারান্দাতে একবারটি হলেও এসে দাড়ানো উচিৎ।এ জ্ঞানরাজ্যের বারান্দাতে এলে আমাদের অনুভব হয় আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কথা। 

৪৪.যখন সামান্য সামান্য জ্ঞান আমাদের মাঝে আসে, তখনই আমাদের শরীরে ছটফটে ভাব চলে আসে, অহংকার চলে আসে।তখন সবাইকে শুধুই শেখাতে চাই।সচারাচর শিখতে কেউ চাই না। নিরবচ্ছিন্ন বই পড়া এ অহং ভাব থেকে আমাদের মুক্তি দিতে পারে। 

৪৫.বই পড়া হল জ্ঞানার্জনের আরোহ একটি পদ্ধতি, এ পদ্ধতিতে ধীরেধীরে আমাদের জ্ঞানরাজ্যে উত্তরণ ঘটে।মগজের বন্ধ তালাগুলো আস্তেধীরে খুলে যেতে থাকে। 

৪৬. শ্রীশঙ্করাচার্য বৈদিক ধর্মের পুনরুত্থান ঘটালেন শুধুমাত্র যুক্তি, মেধা, প্রজ্ঞার সহায়তায়। না কোন রক্তপাত, না কোন হানাহানি, না কোন রাজশক্তির ক্ষমতার অপপ্রয়োগে। কোন কিছুই ধ্বংস করেন নি, করেছেন সৃষ্টি, পুনঃপ্রবর্তন। পক্ষান্তরে অনেক জাতিই ধর্মপ্রচারের নামে পৃথিবীকে রক্তাক্ত করেছে। তলোয়ারকে ধর্ম প্রচারের হাতিয়ার করেছে।

৪৭.যতদিন যাচ্ছে তত বেশি করে আমরা মূলবৃক্ষকে ছেড়ে শাখা প্রশাখায় যেয়ে বসছি এবং তাকেই মূলবৃক্ষ বলে অভিমান করছি। সনাতন বৈদিক রাজপথ ছেড়ে কতগুলো অপরিচ্ছন্ন অলিগলিতে যেয়ে পথহারা পথিক হয়ে বসে আছি। অলিগলিতে চলতে চলতে আমরা টেরও পাচ্ছি না যে আমরা পথহারা। 

৪৮.ভগবানের অবতারের নামে হাইব্রীড ফসলে সারা দেশ ছেয়ে যাচ্ছে। ভণ্ড পাষণ্ড মিথ্যা অবতারদের কারণে সনাতন হিন্দু সমাজ নুয়ে নুয়ে ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে। অসংখ্য মত পথের জঞ্জালে আমাদের যুবকসমাজ পথহারা, ভ্রান্ত, বিপথগামী হয়ে সনাতন ধর্ম, সমাজ এবং পারিবারিক কাঠামোর প্রতি শ্রদ্ধা বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে। পরিণামে কেউ হচ্ছে মানসিক হীনমন্য, কেউ বেছে নিচ্ছে ধর্মান্তর, কেউবা হয়ে যাচ্ছে ঘোরতর নাস্তিক।

৪৯.পশ্চিম বাংলার তথাকথিত সেকুলার বুদ্ধিজীবীরা একচোখা। তারা দিবান্ধ, দেখেও দেখেন না; শুধুমাত্র নিজ স্বার্থেই তাদের চোখ খোলে। তথাকথিত বামপন্থী বুদ্ধিজীবীরা দিনরাত্রি যাদের অসহিষ্ণু বলে, ফ্যাসিবাদী বলে, দিনশেষে তারা নিজেরাও জানে; তারা আদতে মতাদর্শের নামে দলকানা ফ্যাসিস্টদের আজ্ঞাবহ দাস। 

৫০. বাংলা পঞ্জিকা "সংস্কার" নামক অনৈতিক কাটাছেঁড়ায় দিনেদিনে বিধ্বস্ত। বাংলা পঞ্জিকাকে নিয়ে যেভাবে কয়েকদশকে অহেতুক উদ্ভট টানাহেঁচড়া কাটাছেঁড়া করে কোটিকোটি টাকা খরচ করে ঘনঘন পরিবর্তন করছে তাতে যারা পরিবর্তন করছেন তাদের কাছে এর সদুত্তর আছে বা থাকতে পারে। কিন্তু সাধারণ বাঙালির কাছে এটা শুধুমাত্র, ক্ষমতাবানদের একগুঁয়েমি এবং ক্ষমতার প্রদর্শন ছাড়া আর কিছুই নয়। কিছু ক্ষমতাবান ব্যক্তি গবেষক নাম ধারণ করে সরকারী সুযোগ সুবিধা, বাঙালির বিভাজন এবং নিজেকে ইতিহাসে যুক্ত করার এক তীব্র আকাঙ্খা থেকেই বাংলা বর্ষপঞ্জিতে এ ঘনঘন পরিবর্তন করছে।

পবিত্র অক্ষয়তৃতীয়া, ২৬.০৪.২০২০

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী 
সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ 
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

(সূত্রগুলি পরিবর্তনযোগ্য, আপনাদের সুস্পষ্ট মতামতের প্রেক্ষিতে। কোন কোন সূত্রগুলো ভাল লেগেছে, মন্দ লেগেছে নিচে কমেন্টে জানান)

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted