চিন্তাসূত্রের খেরোখাতা
(দ্বিতীয় পর্ব)
৫১. যারা ঘনঘন বাংলা পঞ্জিকা পরিবর্তন করছে তাদের মাথায় রাখা উচিত বাঙালি মানেই শুধুমাত্র বাংলাদেশের বাঙালি না। আমাদের এমন কিছুই করা যাবে না যাতে সারা পৃথিবীর বাঙালিদের সাথে আমাদের যোগসূত্রটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বাংলাদেশ ছাড়াও, ভারতের পশ্চিম বঙ্গ, ত্রিপুরা এ দুটি প্রদেশে বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ। আসাম, ঝাড়খণ্ডে দ্বিতীয় বৃহত্তম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি। এর বাইরে ভারতের অন্যান্য প্রদেশ সহ লন্ডন, নিউইয়র্কে কোটি কোটি বাঙালি আছে। আমরা বাংলা পঞ্জিকাকে যাই পরিবর্তন করি তা ভৌগোলিকভাবে অবস্থিত সকলস্থানের বাঙালিকে যুক্ত করেই তবে করতে হবে। নচেৎ এটা হবে, "গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল"- এ বাক্যটির মত বৃথা প্রয়াস।
৫২.আজ বাঙালির দুই নয়নমণি রবীন্দ্র নজরুল বছরে দুইবার জন্ম নিচ্ছে। দুইবাংলায় দুইদিন তাদের জন্মজয়ন্তী পালিত হচ্ছে। বাঙালির জীবনে এর থেকে লজ্জার আর কি হতে পারে? এ লজ্জা থেকে পরিত্রাণ যদি আমরা চাই, তবে সকল বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধভাবে বিজ্ঞানসম্মতভাবে পঞ্জিকা সংস্কার করতে হবে। না হয় হাজার বছরের পুরনো চলমান পঞ্জিকাতে ফেরত যেতে হবে। নচেৎ হিন্দুর পঞ্জিকা-মুসলিমের পঞ্জিকা অথবা এপার বাংলার পঞ্জিকা-ওপার বাংলার পঞ্জিকা ইত্যাদি বিভিন্ন নামে এবং রূপে সমান্তরাল তুষের আগুন চলতেই থাকবে, জ্বলতেই থাকবে।
৫৩.যেখানেই থাকে সম্ভাবনার প্রদীপ,
দিনশেষে প্রদীপের নিচে থাকে বিশ্বাসঘাতকতার গুদাম।
৫৪ মানুষ নামে জন্ম নেয়া সবাই মানুষ না, কেউ কেউ মানুষ ; কেউ দু'পায়ের হিংস্র প্রাণী। লাখ টাকা হারালে কষ্ট নেই, কষ্ট হয় মানুষের অকৃতজ্ঞতায়, হীনমন্যতায় বিশ্বাসঘাতকতায় এবং ছদ্মবেশী প্রবঞ্চনায়।
৫৫. আমরা সংগঠন বা নতুন কিছু যখন শুরু করি, প্রথমে থাকে তীব্র আগ্রহ, পরে দলেদলে বিভক্ত হয়ে হই উপগ্রহ, এরই ধারাবাহিকতায় আসে অশান্তি বিগ্রহ এবং পরিশেষে তা সকলের জন্যে হয় গলগ্রহ।
৫৬.ভালবাসলে ভালবাসার মানুষের দেহের প্রতি অধিকার জন্মায়। সেই অধিকার ভালবাসাকে সুতীব্র করে, পূর্ণ করে।
৫৭. জীবনে সম্পর্ক নামক পোঁতা আলপিনগুলি চিরস্থায়ী নয়, তুলে ফেলতেই আলপিনগুলি বারবার পোঁতা হয়।
৫৮.ক্ষমতা রাজার মত,অর্জন করতে হয়।মেধা, প্রজ্ঞা,প্রতিজ্ঞা, নিরবচ্ছিন্নতা এবং আত্মবিশ্বাস যার শিরদাঁড়ায় তার কাছেই সিংহরূপ ক্ষমতা স্বয়ং হাজির হয়; ভিক্ষুকের ভিক্ষান্নের কাছে নয়।
৫৯.ঈশ্বর যদি সর্বশক্তিমান হন, তবে তিনি সাকার নিরাকার সব হতে পারেন। যদি না পারেন তাহলে বুঝতে হবে তিনি সর্বশক্তিমান নন।
৬০. যন্ত্রের মাধ্যমে স্রষ্টাকে স্মরণ করার কথা যদি দিনে বারবার স্মরণ করিয়ে দিতে হয়, তবে বুঝতে হবে সেখানে ঈশ্বরের বিশ্বাস অনেকটাই ঠুনকো, দৃঢ় নয়।
৬১. ঈশ্বরের কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। ভাল-মন্দ, পজিটিভ নেগেটিভ সকল শক্তির উৎসই তিনি। ব্যক্তির ইচ্ছার স্বাধীনতা সাত্ত্বিক, রাজসিক এবং তামসিক গুণভেদেই শুভ অশুভের উৎপত্তি। কিন্তু পৃথিবীর অনেক জাতিই বিশ্বাস করে ভালোর জগতের একজন ঈশ্বর; খারাপ জগতের আরেকজন ঈশ্বরের কনসেপ্ট। রেললাইনের মত সমান্তরালভাবে চলছে তাদের দুই ঈশ্বরের শুভ অশুভের রাজত্ব।
৬২. তিল মানুষের যে অঙ্গে থাকে সে অঙ্গকে তীব্র করে। বুকে থাকলে সকলকে ভালবাসার প্রেরণা দেয়, এবং পেটে থাকলে ভোজন রসিক হয়।
৬৩. মানুষের জীবনের এক তৃতীয়াংশই পূর্ব জন্মের প্রারব্ধ কর্মফল এবং বাকি সব বর্তমান জন্মের সাত্ত্বিক, রাজসিক এবং তামসিক কর্ম তার কর্মফল। এ প্রারব্ধ কর্মেরই বিভিন্ন চিহ্ন মানুষের সারা গায়ে থাকে।
৬৪. মানুষের জীবন হল পঞ্চপ্রাণ বাতাসের খেলা, এ বাতাসকে নিয়ন্ত্রিত করাকেই সাধনা বলে।
৬৫. হৃদয়কে স্বচ্ছ আয়নার মত করতে পারলে, অবরোহ পদ্ধতিতে জ্ঞান এমনিতেই এসে সে স্বচ্ছ আয়নায় প্রতিফলিত হয়।
৬৬. জ্ঞানকে যোগ্য অধিকারী এবং স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনা করে না দিলে সে জ্ঞানে বদহজম হয়ে সংসারের ক্ষতি করে।
৬৭.বিনা কারণে এ সংসারে কিছুই হয় না, কারণের খোঁজ থেকেই সমস্যার সমাধান বেরিয়ে আসে।
৬৮.ছল,কপটতা এবং ক্রুরতার অস্ত্র হাজার হাজার বছর পূর্বে থেকে বর্তমান পর্যন্ত একইভাবে বহমান।
৬৯. মানুষের ইন্দ্রিয় সীমাবদ্ধ এ কারণেই মানুষের জীবন এত সুন্দর স্বাচ্ছন্দ্যময়; মানুষের চোখ যদি একটি অণুবীক্ষণ যন্ত্রের মত হত, তবে মানুষ একগ্লাস জলও খেতে পারত না। লক্ষ-কোটি জীব তার চোখের সামনে ভেসে উঠত।
৭০.একমাত্র হিন্দু ছাড়া , অন্যান্য সকল ধর্মাবলম্বীরাই ঐক্যবদ্ধ ও সুরক্ষিত। সকলেরই একটি বৈশ্বিক ধর্মীয় জাতিচেতনা আছে। পক্ষান্তরে হিন্দুরা অরক্ষিত, বিচ্ছিন্ন, বিভ্রান্ত, ছিন্নভিন্ন, আত্মকলহপ্রিয় ,হতচ্ছাড়া দুর্বল, এবং ঘুমন্ত । একমাত্র কাণ্ডজ্ঞানের জ্ঞানচক্ষু খুলে গেলেই এ ঘুমন্ত অবস্থা থেকে মুক্তি সম্ভব।
৭১. প্রত্যেক হিন্দু পরিবার যদি বৈদিক শাস্ত্র, সদাচার, অনুশাসন মেনে আহারে, বিহারে, ব্যবহারে, সংস্কারে, পোশাকে,বাক্যলাপে ও চিন্তা-চেতনা প্রভৃতিতে হিন্দু সংস্কৃতির দৃশ্যমান প্রয়োগ হয়, তবেই এ নিমজ্জমান জাতি জাগবে।
৭২.বিপদকালে ধর্মের রূপ পরিবর্তিত হয়।ধর্ম আর আপদধর্ম সম্পূর্ণ এক নয়, কিন্তু ধর্মের সাথেই অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত আছে আপদধর্ম। চরম বিপদকালে ধর্মের রূপ কিছুটা পরিবর্তিত হয় আপদধর্মের প্রধান উদ্দেশ্যই আত্মরক্ষা, জাতিরক্ষা।হিন্দুদের জন্যে বর্তমানে চরম আপদধর্মকালীন অবস্থা বিরাজ করছে। তাই আমাদের উচিৎ আপাতত বিশ্ব-নাগরিক হবার অবাস্তব কল্পনার জগতে বিচরণ না করে বাস্তব জগতে জাতি রক্ষার্থে সামান্য হলেও আত্মনিয়োগ করা। নচেৎ আমাদের ভাগ্যাকাশে বর্তমানের থেকেও ভয়াবহ দিন অপেক্ষা করছে।
৭৩. সমস্যা সমাধানে সর্বাগ্রে ভূমিকা হওয়া উচিৎ সাধু-সন্তদের। কারণ তারা সবকিছু ত্যাগের মাধ্যমেই ঈশ্বরের এবং ঈশ্বরের প্রবর্তিত ধর্মের শরণ নিয়েছেন, আত্মমুক্তি এবং সর্বজীবের কল্যাণের আকাঙ্ক্ষায়। কিন্তু তারা গদি-বালিসে সুয়ে বসে, এসি গাড়িতে, এসি রুমে থেকে কতটা জীবকল্যাণে কাজ করেন তা আমার কাছে ঠিক পরিষ্কার নয়। আমাদের সাধুদের হাঁটুতে বাতের ব্যথা, ডায়াবেটিস, হার্টের সমস্যা। শরীরের ভাঁজে ভাঁজে তাদের প্রতিনিয়ত সমস্যা । অধিকাংশই রোগী, রোগ সেরে গেলে বড়জোর তারা ভোগী হবেন, কিন্তু যোগী কখনোই নয়। মুখে মুখেই শুধুমাত্র কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগের লেকচার। যা বাস্তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের জীবনে ছিটেফোঁটা নেই।
৭৪.হিন্দু সাধুদের দেখলে মনে হয় ধর্মের সাম্যের বাণী প্রচার এবং অবহেলিত মানুষের রক্ষা নয়; সর্বধর্মের ঠিকাদারিই যেন তাদের একমাত্র কাজ। নিজের গায়ে কাপড় নেই, নিজের পরিবারের গায়ে লজ্জা নিবারণের সামান্য কাপড় নেই, এ নিয়ে তাদের কোন সামান্যতম চিন্তা নেই।তাদের চিন্তা শুধুমাত্র লোকদেখানো পৃথিবী উদ্ধার! কিভাবে নিজের সম্প্রদায়ের থেকে টাকা তুলে লোকদেখানো পৃথিবী উদ্ধার করে নাম কামাবে; এ নিয়েই তাদের যত চিন্তা। থাকুক না হয় নিজসম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েরা পোশাকবিহীন উলঙ্গ।
৭৫.তথাকথিত ধর্মের প্রচারক সাধু-সন্তেরা আমাদের হিন্দুত্ব শেখায়নি; শিখিয়েছে শুধু তাদের মত নপুংসক ক্লীব হয়ে সর্বশেষে দেশান্তরি হতে। প্রাচীনকালের ঋষি-মুনিরা ছিলেন যোগী, তাঁরা নিয়মিত হঠযোগ-রাজযোগ করতেন। সাধনা করতেন। নিত্য নৈমিত্তিক বৈদিক উপাসনাও করতেন। তাঁদের শরীরে ব্রহ্মতেজের সাথে সাথে যুগপৎভাবে ক্ষাত্রতেজও ছিল।রাজা- মহারাজারা তাঁদের কথা মেনে চলতেন, সন্মান করতেন, শ্রদ্ধা করতেন এবং সর্বোপরি ভয়ও পেতেন। কিন্তু বর্তমানের কিছু সাধুসন্তদের দেখলেই মনে হবে এরা নির্দিষ্ট কোন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রীদের ভাড়া করা দালাল। নেতাদের তেল দিতে দিতেই সাধুদের দিন চলে যায়।
৭৬.সাধুরা গুরুবাদের নামে গ্রাফিক্স ডিজাইন করে পদ্মের উপরে বসে বিভিন্ন সং ভং চং সেজে আদতে হিন্দুসমাজকে ঠকাচ্ছে এবং ধর্মের নামে নিরবচ্ছিন্ন বিনা পুঁজির ধান্দা করে যাচ্ছে। যাদের কাজ ছিল হিন্দু সমাজকে একত্রিত করা, অভয় দেয়া, মার্গদর্শন করা ; উল্টো তারাই ধর্মের উদ্ভট বানোয়াট অপব্যাখ্যা দিয়ে দিয়ে হিন্দুদের দলে দলে বিভ্রান্ত করছে, বিভক্ত করছে। তবে ব্যতিক্রম আছে গুটিকয়েক সৎগুরুরা। সাধু-সন্তদের উচিত অহেতুক সর্বধর্ম সমন্বয়ের গীত গাওয়া বাদ দিয়ে, হিন্দুদের একত্রিত করা। হিন্দুজাতি গঠন করা। আমাদের মনে রাখতে হবে, দূর্বলে সবলে কখনই বন্ধুত্ব হয় না, বন্ধুত্ব হয় দূর্বলে দূর্বলে অথবা সবলে সবলে। দূর্বলে সবলে যদি বন্ধুত্বও হয়, তবে বুঝতে হবে সবল দূর্বলের প্রতি দয়া করছে, করুণা করছে।আর দূর্বলের ক্ষমা প্রদর্শন করা বা না করা একই ; সমাজে এর কোনই মূল্য নেই।
৭৭.গত দেরশো বছরে বাংলার সাধু-সন্তরা বাঙালি হিন্দুদের যদি সত্যিকারের ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাম্যের শিক্ষা দিতে পারতো তাহলে বাঙালি হিন্দুদের ইতিহাস অন্যপ্রকার হত। হিন্দুদের আর এভাবে মার খেয়ে, জবাই হয়ে, বাস্তুভিটাচ্যুত হয়ে,উপাস্য দেবতার প্রতিমা ধ্বংস হতে দেখে জনসংখ্যা শূন্যের অভিমুখে যেতে হতো না।
৭৮.স্কুল কলেজে রামায়ণ-মহাভারত বিষয়ে পড়াশুনার সুযোগ নেই। কিন্তু সামান্য বিদ্যা নিয়েই, বা কদাচিৎ ক্ষেত্রে না পড়েই আমরা রামায়ণ-মহাভারতের পিণ্ডী চটকাতে চটকাতে নিজেদের পাণ্ডিত্য জাহির করতে শুরু করে দেই। মূল চব্বিশ হাজার শ্লোকের রামায়ণ, অথবা একলক্ষ শ্লোকের মহাভারত হয়ত আমরা কখনো চোখেই দেখিনি। আমরা ইউরোপীয় মুখস্থ তোতাপাখির বিদ্যা দিয়ে সকল কিছুই দেখতে গিয়ে অনেক সময় অনেক অমার্জনীয় ভুল করে ফেলি। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের উদ্দেশ্য করে অনেক আগেই সতর্কবাণী উচ্চারণ করে রামায়ণ-মহাভারত যে ভারতবর্ষের চিরকালের ইতিহাস এবং সত্য ইতিহাস সে কথা স্মরণ করে আমাদের পথের দিশা দিয়েছেন।
৭৯.রামায়ণ পৃথিবীর প্রধান চারটি ক্লাসিক মহাকাব্যের প্রাচীনতম একটি মহাকাব্য।আধ্যাত্মিক, দার্শনিক এবং নীতিশাস্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে, রামায়ণ একটি সর্বশ্রেষ্ঠ জীবন দর্শনের দীপ্তময় শাস্ত্র। প্রত্নতাত্ত্বিক এবং ভৌগলিকভাবে রামায়ণ একটি অভ্রান্ত গ্রন্থ । রামায়ণের অযোধ্যা, কিষ্কিন্ধ্যা, চিত্রকূট, লঙ্কা, সরজু নদী সহ সকল স্থানই ভৌগলিকভাবে বর্তমানে সেই সেই স্থানে অবস্থিত থেকে রামায়ণের কালের সত্যতা এবং সুপ্রাচীন ঐতিহ্য আজও বহন করে চলছে।
৮০.রামায়ণ শুধুমাত্র কাল্পনিক কাহিনী নয়, রামায়ণ হল এই ভূখণ্ডের প্রাচীন ইতিহাস। এর অন্যতম পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ হল রামসেতু, যা ভগবান শ্রীরামচন্দ্র লঙ্কায় পৌঁছানোর জন্য বানরসেনার সহায়তায় তৈরি করেছিলেন ; আজও তাঁর পবিত্র স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রামসেতু অক্ষত আছে। NASA-এর বিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন সেতু এটি এবং এটি কোন প্রাকৃতিক সেতু নয়, সর্বপ্রাচীন এবং সর্ববৃহৎ মানবসৃষ্ট সেতু।
৮১. কি নেই রামায়ণে? রামায়ণ একটি বিশ্বকোষ। এ বিশ্বকোষ নির্মিত হয়েছে এক মর্যাদা পুরুষোত্তম দেব চরিত্রের উদ্বোধনে ; সেই দেব চরিত্রের নাম শ্রীরামচন্দ্র। যিনি শ্রীভগবানের অবতার রূপ পরিগ্রহ করে আমাদের শিখিয়ে দিয়েছেন, আদর্শ পরিবার কেমন হবে? আদর্শ দাম্পত্যজীবন কেমন হবে? আদর্শ সমাজ কেমন হবে? আদর্শ ভ্রাতৃত্ব কেমন হবে? আদর্শ সন্তান কেমন হবে? আদর্শ বন্ধুত্ব কেমন হবে? এ সকল আদর্শের একমাত্র দীপ্তিময় আদর্শরূপ হলেন ভগবান শ্রীরামচন্দ্র।
৮২.আজ ভগবান রামচন্দ্র বা রামায়ণের প্রসঙ্গ আসলেই কিছু মানুষ রামায়ণের উত্তরকাণ্ডের শম্বুক হত্যার প্রসঙ্গ নিয়ে এসে রামচন্দ্রের চরিত্রে কালিমালিপ্ত করতে থাকেন। তাদের উদ্দেশ্যে সংক্ষেপে বলতে চাই, বর্তমানে প্রাপ্ত রামায়ণে উত্তরকাণ্ডের অনেকটাই প্রক্ষিপ্ত। সেখানে শম্বুকবধের কাহিনীটি যে প্রক্ষিপ্ত, এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এর সবচেয়ে বড় প্রমান হলো- রামায়ণের বালকাণ্ডে ১ম এবং ৩ য় সর্গে দুটি সূচিপত্র পাওয়া যায় ; প্রথম সূচিপত্রে নারদের মুখে সমগ্র রামচরিত সংক্ষেপে বর্ণিত, কিন্তু সেখানে উত্তরকাণ্ডের অথবা তার শম্বুকবধের কোন কথাই নেই। অর্থাৎ শম্বুকবধ পরবর্তীকালে কোন বর্ণবাদী দ্বারা সংযোজিত। যে রামের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হলেন নিষাদরাজ গুহক, যিনি বর্তমান জাতপাতের পরিভাষায় হলেন শূদ্র। যেই রামচন্দ্র শূদ্র কুলোদ্ভূত শবরীর মুখের এঠো ফল খেয়েছেন ; সেই রামচন্দ্র কি করে শুধুমাত্র তপস্যার কারণে একজন শূদ্রকে হত্যা করবেন? এ কি বিশ্বাসযোগ্য? এরকম অসংখ্য মিথ্যাচার ছড়ানো আছে রামায়ণকে কেন্দ্র করে, যার সুফল নিচ্ছে হিন্দুবিরোধী কিছু সাম্প্রদায়িক ইতিহাসবেত্তারা। নতুন প্রজন্মের উচিত এ সকল মিথ্যাচারকে অপনোদন করে প্রকৃত ইতিহাসের গতিপথকে অক্ষুণ্ণ রাখা।
৮৩.বহু বছরের বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতা আমাদের এদেশীয় সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় মূল্যবোধগুলোকে আমাদের মন থেকে মুছে দেয়ার অপচেষ্টা করেছে, যার ফলে শিক্ষিত শ্রেণীর অনেকেই আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে ঘৃণা করতে শিখেছি। এ ঘৃণা এবং অবজ্ঞাই আমাদের সাংস্কৃতিক স্বাভিমানকে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে৷ কিছু তথাকথিত বামপন্থী এবং সেকুলার নামধারী বুদ্ধিজীবীদের দ্বিচারিতা আমাদের জাতীয় সাংস্কৃতিক ঐক্যবদ্ধ চিন্তাকে বিভ্রান্ত করে চলছে৷ এ তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা শ্রীরামের অস্তিত্ব এবং কর্মকাণ্ড নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেও, রাবণ তাদের কাছে মহিমান্বিত মহান। রাম-রাবণের শুভ-অশুভের দ্বন্দ্ব তাদের তথাকথিত গবেষণার পরিভাষায় হল, অনার্যদের উপরে আর্যদের আগ্রাসন! অাশ্চর্যের বিষয়, আজও এই দ্বিচারীদের বিভিন্নভাবে জ্ঞানত বা অজ্ঞানত সমর্থন যুগিয়ে চলেছে কিছু বোধশক্তিহীন, আত্মকেন্দ্রিক কুলাঙ্গার।
৮৪.ভারতবর্ষের সকল ভাষাতে তো বটেই, তিব্বত, চীন, ফিলিপাইন, বার্মা, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, কম্বোডীয়া, লাওস সহ এশিয়ার সকল জনপদে প্রচলিত আছে রামায়ণ এবং রামায়ণ সংস্কৃতি বিভিন্ন নামে।
৮৫.জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে শ্রীরামচন্দ্র ছিলেন ধর্ম, ন্যায় এবং কর্তব্য পালনের এক জাজ্বল্যমানতার পরাকাষ্ঠা। তাই তিনি সকল মানবের আদর্শ, মর্যাদা পুরুষোত্তম। তিনি পিতৃসত্য রক্ষার জন্যে চৌদ্দবছর বনবাস সহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ধর্ম পালনে ছিলেন আপোষহীন। সাধু সজ্জনের কাছে তিনি ছিলেন কুসুমের মত কোমল, আবার দুর্জ্জন অধর্মের বিনাশে তিনি নির্মম বজ্রধর । রামায়ণের অসংখ্য স্থানে ধর্মের মাহাত্ম্য এবং অধর্মকে বিনাশ করে ধর্মের শরণে থাকার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। এ জগতে ধর্মই প্রকৃত সারবস্তু। তাই ধর্মের শরণে থাকার চেষ্টা আমৃত্যু করা উচিত।
৮৬.ভগবান শ্রীরামচন্দ্র আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন যে, ধর্মরক্ষার্থে শুধুমাত্র তথাকথিত ধর্ম পালন নয়; ধর্মরক্ষার জন্য অধর্ম, পাশবিক শক্তির সাথে নিরন্তর সংগ্রাম করাটাও আবশ্যক। তাই আজও শ্রীরামচন্দ্র সকল হিন্দুর আদর্শ।
৮৭.শক্তিহীনের শান্তি ও ক্ষমা প্রদর্শনে জগতের কোন কল্যাণ হয় না, ক্ষমা বীরের ধর্ম। একইভাবে নিঃস্ব ভিক্ষুকের দান ও ক্লীবের ব্রহ্মচর্য ধর্মবিরুদ্ধ।
৮৮.নিজেকেই সবচেয়ে বেশী ভালবাসে মানুষ । নিজেকে ভালবাসতে যেয়েই অন্যের সাথে ভালবাসা নামক লুকোচুরি খেলায় সজ্ঞানে অথবা অজ্ঞানে জড়িয়ে যায়। কখনও সে ভালবাসায় আনে মুক্তি , অথবা কখনও ভালবাসা নিয়ে আসে অন্ধত্ব বা বন্ধ্যাত্ব।
কিন্তু এর পরেও ভালবাসতে হয়,
নতুন ঘর বাঁধতে হয়,
আশার রঙ্গিন প্রজাপতি উড়িয়ে দিতে হয় ;
মনের সবুজ শস্যক্ষেত্রে।
৮৯.মাঝগঙ্গায় কারো যদি সপরিবারে নৌকাডুবি হয়। তবে কর্তাব্যক্তিটি সর্বপ্রথম স্ত্রীসন্তান সহ সবাই মিলেই বাঁচতে চায়। বাঁচার আপ্রাণ প্রচেষ্টাও করে। যখন দেখে সবাই মিলে বাঁচা সম্ভব না, তখন সর্বপ্রথমে স্ত্রীকে ছেড়ে বাচ্চাদের বাঁচাতে চেষ্টা করে। এরপরে যদি দেখে সে সকল সন্তানকেও বাঁচানো সম্ভব না, তবে মেয়ে সন্তানটিকে ছেড়ে, ছেলে সন্তানটিকে বাঁচাতে চেষ্টা করে। যদি তাতেও সে অসমর্থ হয়, তবে স্ত্রীসন্তান সকলকেই ছেড়ে সে নিজেই বাঁচতে আপ্রাণ চেষ্টা বা প্রয়াস করে। এরই নাম নির্মম সত্য। অবশ্য ঘটনাটি স্থান-কাল-পাত্র ভেদে সত্য নাও হতে পারে।
৯০. জীবনে কিছু ভুল শুধু ভুল না, অমার্জনীয় অপরাধ।যেমনটি পৃথিবীরাজ চৌহান মোহাম্মদ ঘোরিকে ক্ষমা করে করেছিলেন।
৯১. ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে নবাব সিরাজুদ্দৌলার পরাজয়ে বাঙালির পরাজয় নয়। সিরাজুদ্দৌলার মাতৃভাষা ছিল ফার্সি। তাইতো সিরাজুদ্দৌলাকে যখন ইংরেজ সেনা বেধে নিয়ে যাচ্ছিল তখন রাস্তার দুপাশের অসংখ্য কৃষকেরা নিশ্চিন্তমনে জমি চাষ করছিলেন, কেউ কেউ হাতেতালিও দিচ্ছিলেন। তাদের কাছে এ যুদ্ধ ছিল দুই সাম্রাজ্যবাদীর লড়াই।
৯২. মানুষের দেহযন্ত্রকে মাঝেমধ্যে বনে, পাহাড়ে, সমুদ্রে এবং আকাশের অসীমতায় নিয়ে গিয়ে রিস্টার্ট দিতে হয়। এতে যন্ত্রটি নতুনভাবে আবার শুরু হয়।
৯৩. গণতন্ত্রের একটি বিশিষ্ট দিক হল ব্যাপক গণসংযোগ এবং তার ফলে সৃষ্ট সামাজিক সচলতা (social mobility) এর মধ্য দিয়েই রচিত হয় সমাজের উচ্চবর্গের সাথে নিম্নবর্গের যোগাযোগ। অর্থাৎ সমাজে পশ্চাৎপদ শ্রেণি তাদের সাথে সমাজে যারা প্রতিষ্ঠিত মান্য তাদের এক গণসংযোগ। শ্রীচৈতন্যদেবের (১৫০৯-১০ খ্রিস্টাব্দে) নবদ্বীপ পরিভ্রমণকালে আমরা এর সার্থক প্রয়াস দেখি। নগর পরিভ্রমণের সময়ে তাঁতি, গোয়ালা, গোপ, গন্ধবণিক, মালাকার, পান ব্যবসায়ী, শাঁখারীসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সাথে তাঁর সহজাত স্বাভাবিক সম্পর্কই শ্রীচৈতন্যকে মাটির কাছাকাছি, সাধারণ মানুষের কাছাকাছি করেছে। অথচ বর্তমানের সাধুসন্ন্যাসী অনেকেই সাধারণ মানুষের থেকে দূরে থাকে।
৯৪.শ্রীচৈতন্যেদেবের ভালবাসার দ্বার ছিলো সবার জন্য উন্মুক্ত-অবারিত। অকৃপণভাবে প্রেম, ভক্তি, ভালবাসা বিলিয়ে গিয়েছেন তিনি এ ভূখণ্ডে। এ ভূখণ্ডের মাটি পবিত্র হয়ে উঠেছে শ্রীচৈতন্যের পদস্পর্শে। তিনি শিখিয়েছেন সকল জ্ঞান এবং শিক্ষা প্রথমে নিজেকে আচরণ করেই পরে সবার মাঝে প্রচার করতে হয় ; তবেই মানুষ তা গ্রহণ করে। নিজে আচরণ না করে যে শিক্ষা সে শিক্ষা কেউ গ্রহণ করে না।
৯৫.এ ভারতবর্ষের পবিত্র ভূমিতে জাত হয়ে আমাদের সবারই লক্ষ হওয়া উচিত, প্রথমে যেন আমরা সবাই যার যার মনুষ্য জন্ম সার্থক করতে পারি। এর পরেই পর উপকার এই শিক্ষাটা বর্তমান যুগের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। নিজ জন্ম সার্থক করার পরেই পরিবার এবং এর পরে পর্যায়ক্রমে বৃহৎপরিবার অর্থাৎ জাতির সেবার মাধ্যমে প্রত্যেকেরই জীবন সার্থক করতে হবে- এই মহৎ শিক্ষাটিও শ্রীচৈতন্যদেবের।
৯৬.শ্রীচৈতন্যদেবের সকল শিক্ষার মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষা হলো- মানুষকে অতিস্তুতি করে যেন ঈশ্বর বানিয়ে না ফেলা হয়। তিনি ছিলেন এর ঘোরতর বিরোধী। আজকে বাংলায় গত দেড়শো বছরে অবতারের হাইব্রীড ফসলে ভরে গেছে।শ্রীচৈতন্যদেব তার দূরদৃষ্টি দিয়ে এ মানুষ পূজার নিন্দা করে তাদের পাষণ্ডী বলে অবিহিত করে যমের দণ্ডনীয় বলেছেন। এ সংক্রান্ত অমূল্য কথাগুলো চৈতন্যচরিতামৃতের মধ্যলীলার অষ্টাদশ পরিচ্ছেদে আছে। অথচ তাঁর অনুগামীরা তাকেই ভগবান বানিয়ে দিয়েছে।
৯৭.শ্রীচৈতন্যদেবই আমাদের দেখিয়ে দিলেন, কোন রকমের অস্ত্র-শস্ত্রের ব্যবহার না করে শুধুমাত্র মানুষের ভালবাসাকে অবলম্বন করে বিপ্লব করা যায়। তাই তো তিনি ‘আধ্যাত্মিক গণতন্ত্রে’র পুরোধা পুরুষ। তাঁর রচিত গণতন্ত্রের ভিত্তিমূলে ছিল না কোন জাত-পাত, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য। সবার সেখানে একটিই পরিচয় ‘কৃষ্ণের নিত্যদাস’। একটি মন্ত্রই সেখানে প্রতিনিয়ত ধ্বনিত হয়, তা হল ‘প্রেম’ ; মানবপ্রেম।
৯৮.বাঙালির ভাষা, সাহিত্য এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশের প্রাণপুরুষ শ্রীচৈতন্যদেব। তাঁর আগমনের সাথে সাথেই বাংলা সাহিত্য ফুলে-ফলে, পত্র-পল্লবে বিভিন্ন রঙে বিকশিত হয়ে উঠে। বাংলা সাহিত্যের জীবনীগ্রন্থের প্রচলনও তাঁর মহাজীবনের উপরে তাঁর বিভিন্ন পার্ষদ এবং বৈষ্ণব মহাজনদের রচনার অমূল্য ভিত্তিসৌধের উপরেই গড়ে ওঠে। বৈষ্ণব মহাজনেরা শ্রীচৈতন্যদেবের জীবন এবং দর্শনের উপরে অসংখ্য গ্রন্থ লিখে বাংলা ভাষাকে বহুবছরের বন্ধ্যাত্ব থেকে মুক্তিদান করেন। বাংলাসাহিত্যে শ্রীচৈতন্যদেবের অবদান অপরিসীম।
৯৯.এক ব্রহ্মরূপী রুদ্রই বৃক্ষ-লতা-গুল্মরূপে, জীবের পালকরূপে, সন্ন্যাসী, সাধু-সন্ত থেকে চোর, বাটপাড়, ছিনতাইকারী সকলরূপে এক তিনিই বিরাজিত ; কারণ তিনি ছাড়া যে জগতে আর দ্বিতীয় কেউ নেই।শুক্লযজুর্বেদ সংহিতার ১৬ তম অধ্যায়টি পুরোটাই রুদ্ররূপী,শিবরূপী পরমব্রহ্মের স্তোত্র দিয়েই পূর্ণ।সমাজের প্রত্যেকটি শ্রেণী-পেশার মানবের মাঝেই রুদ্ররূপ ব্রহ্মের প্রকাশ অসাধারণ কাব্যময়তায় বর্ণিত।
১০০.আমরা আজ কথায় কথায় বলি যে; বেদে দেব-দেবীর কথা নেই। সত্যি কি নেই? বেদের আরণ্যক অংশের প্রায় পুরোটা উপাসনাবিধি নিয়েই রচিত। বেদের সকল ভাষ্যকার বা ব্যাখ্যাকারই আরণ্যককে বেদ বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন ; একমাত্র স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী ছাড়া। তাই শুধু স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর কথাই একমাত্র সত্যি হয় তবে পূর্ববর্তী সকল বেদভাষ্যকারদের কথাই মিথ্যা হয়ে যায়। আমরা ভগবান শিবের অভিষেক এবং সকল রোগনাশের জন্যে "ত্র্যম্বকং যজামহে সুগন্ধিং পুষ্টিবর্ধনম" মন্ত্র এবং শিবের উপাসনার প্রধান মন্ত্র " ওঁ নমঃ শিবায় " জপ করি ; এ সকল মন্ত্রই বেদসংহিতা থেকেই নেয়া। বেদের তৈত্তিরীয় আরণ্যকের দশম প্রপাঠকের ২২ অনুবাকে শুধুমাত্র একা ভগবান রুদ্ররূপী শিব নয় অম্বিকাপতি, উমাপতিকেও বন্দনা করা হয়েছে।
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................