এসব প্রশ্ন করেই বহিরাগতরা হিন্দুসমাজকে বিভাজিত করে ধর্মান্তর করতে প্ররোচনা দিত।

- হিন্দু নারী ও শূদ্রদের পূজা করার অধিকার নেই।
- ফালতু কথা। প্রত্যেক হিন্দুগৃহে নিত্যদিনের পূজার্চনা ৯০% ক্ষেত্রে নারীরাই করে। প্রত্যেক শূদ্রের গৃহেও প্রতিদিন ভগবান পূজিত হন। এটাই হিন্দু সমাজের বাস্তব চিত্র। এসব প্রশ্ন ভিত্তিহীন।

- কিন্তু নারী পুরোহিত হতে পারে না হিন্দু সমাজে।
- অবশ্যই পারে। ইদানিং বাংলাদেশে, ভারতে নারী পুরোহিতেরা সরস্বতী পূজা, দুর্গাপূজার মতো বড় বড় পূজাও করছে। বেদে তো নারী ঋষিরাও আছেন। তারা যজ্ঞে পৌরহিত্যও করতেন। হিন্দুসমাজে নারীরা পৌরহিত্য করতে পারে না তো আর কোন সমাজে পারে? বলুন তো।

- নারীদের তো উপনয়ন হয় না। ওদের তো পৈতা নাই। 
- উপনয়ন নিয়েই নারীরা গুরুকুলে ব্রহ্মচর্য পালন ও বিদ্যাগ্রহণ করত আগে। উপনয়ন বা যজ্ঞোপবীত ধারণ না করে মেয়েরা নিশ্চয় বেদ অধ্যয়ন, যজ্ঞ করতেন না, তাই না? গার্গী, ঘোষা, অপালা, সূর্যাদের নাম শুনেছেন নিশ্চয়। মধ্যযুগে হাজার বছরের পরাধীনতায় আমরা অনেক সংস্কার হারিয়ে ফেলেছি। তাই অনেক অনাচার জন্ম নিয়েছিল। দু’শ বছর ধরেই সেসব অনাচার নির্মূল হচ্ছে, এখনো নির্মূল প্রক্রিয়া চলছে।  

- হিন্দুধর্মে নারীদের কোনো মর্যাদা নেই।
- এবার না হেসে পারা গেল না। দুর্গাপূজা দেখেছেন কখনো? সেখানে দাঁড়িয়ে কী করে বলতে পারেন সনাতন ধর্মে নারীর মর্যাদা নেই? মূর্খামির তো সীমা থাকা উচিত। সনাতন ধর্মে নারী ও মাতৃশক্তিকে যে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে তেমন আর কোথাও দেওয়া হয়েছে কি?

- হিন্দু নারীদের সম্পত্তিতে সমানাধিকার নেই।
- জাগতিক বিষয়ভোগ বাসনাই কি সুখের মানদণ্ড? নাকি সংসারের সুখ-শান্তি-সমৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ? যারা অধিকার পায় তাদের চেয়ে হিন্দু নারীরা কি কষ্টে আছে নাকি ভালো আছে? কারা বেশি দুরাবস্থায় আছে? বাস্তব চিত্রটা বিচার করে বলুন তো। তথাপি সম্পত্তিতে মেয়েদের সমানাধিকার অবশ্যই দেওয়া যায়। তাতে ধর্মের কোনো বাধা নেই, হিন্দুদেরও তেমন আপত্তি নেই। কিন্তু সেজন্য পূর্বশর্ত হিসেবে সমাজে আগে মেয়েদের সার্বিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। সে যেন নির্বিঘ্নে সম্পত্তি ভোগ করতে পারে, তাকে যেন বিক্রি করতে না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় সুশাসন, ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে সম্পত্তি দেওয়া মানে সেটাকে দস্যুদের ভোগের সামগ্রী বানানোরই নামান্তর। 

- বুঝলাম। কিন্তু হিন্দুধর্মে অনেক জাতপাত সমস্যা আছে।
- আমরা এখন এসব সেকেলে প্রথা মানি না। মানুষকে গুণ-কর্ম অনুযায়ী মর্যাদা দিই। কোন জাতে কার জন্ম এসব বিবেচনা করি না। শাস্ত্রের নির্দেশও এমনটাই।

- হিন্দুধর্ম ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্ম। এখানে শূদ্রদের নিষ্পেষিত করা হয়। 
- তাই নাকি? এখনো কি সমাজের দিকে তাকালে তাই মনে হয়? এসব তো দুয়েকশ বছর আগেকার ‘বিভ্রান্তকারী’ প্রশ্ন। এসব প্রশ্ন করেই বহিরাগতরা হিন্দুসমাজকে বিভাজিত করে ধর্মান্তর করতে প্ররোচনা দিত। এসব ভোতা অস্ত্র এখন প্রয়োগ করবেন না দয়া করে। এখন বরং ব্রাহ্মণরাই সবচেয়ে দলিত শ্রেণি। শিক্ষায়-দীক্ষায়, জ্ঞান-বিজ্ঞানে, অর্থনীতি, রাজনীতিতে শূদ্ররাই ক্ষমতাশালী। আর ব্রাহ্মণরা এখন করুণার পাত্রে পরিণত হয়েছে। এখনো যদি ব্রাহ্মণ্যবাদের পুরনো ক্যাসেটে গান বাজান, কেউ শুনবে না। বরং আপনার পুরনো অসদুদ্দেশ্য নোংরাভাবে সবার সামনে প্রকাশ পেয়ে যাবে।

- শূদ্রদের তো উপনয়ন নেই। বেদপাঠের অধিকার নেই। 
- আপনার জেনে রাখা দরকার যে, বেদের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিদের মধ্যে শূদ্র বংশোদ্ভূত ঋষিও রয়েছেন। গুণ-কর্ম অনুযায়ী যে কেউ যোগ্যতা অর্জন করে অধিকার বুঝে নিতে পারেন। 

- শূদ্র কি উপনয়ন নিতে পারবে?
- শূদ্র থাকা অবস্থায় উপনয়ন নিতে পারবে না। তবে শূদ্রত্ব মোচন হলে তথা যোগ্যতা অর্জন করলে অবশ্যই উপনয়ন নিতে পারবে। 

- যোগ্যতাটা কি? 
- প্রকৃতপক্ষে যারা পড়াশুনা করছেন, তারা যে বর্ণেরই হোক না কেন, তারা সকলেই উপনয়ন নেওয়ার অধিকারী। কারণ, উপনয়নের মাধ্যমে বিদ্যার্জন শুরু করতে হয়। এখন সবাই বিদ্যার্জন করছেন। এ তো অত্যন্ত দারুণ ব্যাপার। কিন্তু উপনয়ন নিচ্ছে না। এবং নিজেকে শূদ্রই ভাবছেন। শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে যাদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্মেষ হয়েছে তারা কখনোই শূদ্র থাকে না। বিদ্যারম্ভের শুরুতেই তাদের উপনয়ন নেওয়া উচিত ছিল। তবে তখন না নিলেও, যেকোনো বয়সেই উপনয়ন নেওয়া যেতে পারে।  

- তাহলে শূদ্র কারা? শূদ্রত্ব মোচন কীভাবে সম্ভব?
- যারা তামসিক কর্ম, তামসিক ধৃতি, তামসিক জ্ঞান, তামসিক বুদ্ধি, তামসিক শ্রদ্ধা তথা তামসিক গুণের অধিকারী তারাই শূদ্র। যাদের মাঝে রাজসিক ও সাত্ত্বিক গুণের কিছুটা হলেও বিকাশ হয়েছে, তার শূদ্রত্ব মোচন হয়েছে। 

- শূদ্ররা কি পূজার্চনা করতে পারেন?
- কথাটা এরকম হবে, শূদ্ররা পূজার্চনা করে না। কারণ, তামসিক জ্ঞান-বুদ্ধি ও তামসিক শ্রদ্ধাযুক্ত মানুষ হলো শূদ্র। তারা তো পূজার্চনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে না। যদি থাকে তাহলে তার শ্রদ্ধা সাত্ত্বিক হয়ে যায়। সে তো আর শূদ্র থাকে না তখন। 

- তার মানে, শূদ্রসন্তান পুরোহিত হতে পারবে।
- হ্যাঁ। পুরোহিত সকলেই হতে পারেন। তবে পুরোহিত মানেই ব্রাহ্মণ হওয়া নয়। পরিপূর্ণ সাত্ত্বিক গুণের অধিকারী ব্রহ্মজ্ঞানী ব্যক্তিই কেবল ব্রাহ্মণ পদবাচ্য। 

- তাহলে ব্রাহ্মণ্যবাদ....?
- ব্রহ্মজ্ঞানী মানুষদের আবার ‘বাদ’ কিসের? জন্মজাত বংশপরিচয়ের ব্রাহ্মণ্যবাদ পুরোটাই ভ্রান্ত। এটাকে পুরোহিততন্ত্র বলা যেতে পারে। এর দিন শেষ হয়ে গেছে। এখন উপনয়ন নিয়ে, বেদপাঠ, যজ্ঞ, পূজার্চনা করতে পারেন সকলেই। এটা সকল হিন্দুর অধিকার। এতে কেউ বাধা দিতে পারবে না। এরপরও যদি কেউ পুরনো কাসুন্দি ঘাটে, বুঝবেন তার অসৎ উদ্দেশ্য আছে। সে হিন্দু জাতির হিতাকাঙ্ক্ষী নয়।

- শূদ্রসন্তান কি ব্রাহ্মণ হতে পারেন?
- অবশ্যই পারেন। প্রকৃত অর্থে জন্মসূত্রে আমরা সকলেই শূদ্র। উপনয়ন সংস্কারের মাধ্যমে আমরা দ্বিজ হই। বেদপাঠ ও বিদ্যার্জন করলেই যে ব্রাহ্মণ হয়ে যাব তা না, তখন পরিচয় হয় ‘বিপ্র’। আর সাধনার মাধ্যমে যখন ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হয়, তখনই কেবলমাত্র ‘ব্রাহ্মণ’ পরিচয় বিহিত হয়। অন্যথায় আর কেউ ব্রাহ্মণ নয়। ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র সকল বর্ণের সন্তানই ব্রাহ্মণই হতে পারেন। আবার ব্রাহ্মণের সন্তান যদি ব্রহ্মবিদ্যা অর্জনে ব্যর্থ হয় তাহলে তার সে ব্রাহ্মণ পদবাচ্য নয়। 

- তার মানে জন্মগত বর্ণপরিচয় ভুল?
- হ্যাঁ। এটাই শাস্ত্রসিদ্ধান্ত। 

- তাহলে যে এত জাতিভেদে বিভক্ত হিন্দু সমাজ!
- এসব পেশাভিত্তিক পরিচয়। আবার কখনো রাজপ্রদত্ত পদবী বংশের পরিচয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসবের সাথে শাস্ত্রের কোনো সম্পর্ক নেই। যুগে যুগে সমাজে এসব পদবী, জাতপাত তৈরি হয়েছে। সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসে হয়ত তখন তার কোনো গুরুত্ব ছিল। কিন্তু এখন এসবের আর কোনো গুরুত্ব নেই। পেশাভিত্তিক জাতি ইতোমধ্যে নিজে থেকেই ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন বেশিরভাগই পৈত্রিক পেশায় যাচ্ছে না। পেশা পাল্টাচ্ছে। সুতরাং পেশা-কর্মভিত্তিক জাতিভেদ এখন অপাংক্তেয়। এর কোনো মানে নেই।

- তাহলে হিন্দুরা এখনও এসব মানে কেন?
- মূর্খ জাতি। পরম্পরা মেনে যাচ্ছে মাত্র। রাজাহীন, নেতাহীন জাতির ভাগ্যে যা হয় আরকি। আর ধর্মব্যবসায়ীদের গ্যাড়াকলে পড়ে আফিম খেয়ে বুঁদ হয়ে আছে। কেউ তাদের বলে বুঝিয়ে দিচ্ছে না হিন্দুদের সমস্যাগুলো কোথায়, উত্তরণের উপায়, পরম্পরা পালনের যৌক্তিকতা। অনেকটা গল্পের সেই দ্বাররক্ষকের মতো। গার্ডের দায়িত্ব দুয়ারে দাঁড়িয়ে খেয়াল রাখা যেন কোনো চোর-ডাকাত প্রাসাদে না ঢুকতে পারে। এদিকে প্রাসাদ যে ধ্বংস হয়ে গেছে সেদিকে তার খেয়াল নেই। সে দ্বার রক্ষাই করে যাচ্ছে। 


0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted