প্রথম আলো’র মত প্রগতিশীল পত্রিকা কেন উগ্র মুসলিম বিশ্বাসের উপমা ব্যবহার করবে?

বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক প্রথম আলো’র মত কাগজের ‘সহকারী সম্পাদক’ পদে একটা মুমিন মুসলমান কি করে বসল সেই প্রশ্নটা তোলা যেতেই পারে। কারণ কোন ‘মুমিন মুসলমানের’ পক্ষে ধর্মের প্রশ্নে বস্তুনিষ্ঠ থাকা সম্ভব নয়। বরং এরা সুযোগ পেলেই উগ্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ প্রচার করতে লেগে যায়। সারফুদ্দিন আহমেদ নামের একজন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক। সম্প্রতি ফিলিস্তিনিদের আল আকসা মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়ে ইজরাইল সৈন্যদের হাতে ছত্রভঙ্গ হওয়া নিয়ে এই সহকারী সম্পাদক একটা লেখা লিখেছে। সেটি পড়তে গিয়ে দেখলাম গেল বছর সে এই বিষয়ে আরো একটি লেখা লিখেছিলো যার শিরোনাম ‘একচোখা দাজ্জাল মিডিয়া ও কোণঠাসা ফিলিস্তিনি’! ‘একচোখা দাজ্জাল’ হচ্ছে একটি ইসলামিক বিশ্বাস যেখানে বলা হয়েছে এরকম এক দানব আসবে যে নাকি ইসলাম ও মুসলমানদের শত্রু হবে। আনসার আল ইসলাম, হুজি, আনসার বাংলা, জেএমবি- এই সকল জঙ্গি দলগুলোর নিজেদের বইপত্রে মিডিয়াকে, অমুসলিমদের ঠিক এভাবে ‘দাজ্জাল’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। পশ্চিমা মিডিয়াকে ওয়াজী হুজুররাও এইসব উপমায় ভূষিত করে কথা বলে। প্রথম আলো’র মত (ধারণা মতে) প্রগতিশীল পত্রিকা কেন উগ্র মুসলিম বিশ্বাসের উপমা ব্যবহার করবে?



প্রথম আলো সহকারী সম্পাদকের এবারের আহাজারী কেন রমজান মাসের মত পবিত্র মাসে ইজরাইল প্রতিবছর ফিলিস্তিনিদের উপর হামলা চালায়? এই প্রশ্ন করার আগে সহকারী সম্পাদকের কেন এই প্রশ্নটাও মাথায় এলো না, কেন রমজান মাস এলেই আফগানিস্থানের মসজিদগুলিতে বোমা হামলা চালানো হয়? কেন শিয়া মসজিদগুলি রক্তে রঞ্জিত হয়? ফিলিস্তিনি ঘটনার একই সময়ে আফগানিস্থানে এবছরও মসজিদে হামলা হলো। জেরুজালেমের আল আকসায় ইজরাইল কাঁদানো গ্যাস মেরেছে তাতেই সহকারী সম্পাদকের চোখ জ্বলছে, কিন্তু আফগানিস্থানে তরতাজা প্রাণগুলি শেষ হয়ে গেলেও তিনি নিশ্চুপ এই কারণে যে মুসলমান হিসেবে তিনি এসব ঘেঁটে মুসলমানদের বিতর্কিত করতে চান না?

বলছি না যে সহকারী সম্পাদককে আফগানিস্থান নিয়ে লিখতেই হবে। কে কি লিখবে সেটা তার নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু কোন কিছু লিখতে গেলে বস্তুনিষ্ঠতা থাকতে হবে। সহকারী সম্পাদক আলোচ্য লেখাটি লিখেছেন পুরোপুরি মুসলিম পজিশন থেকে। তিনি ফিলিস্তিনি ইজরাইল ইস্যুতে মুসলমান বনাম ইহুদী দেখিয়ে স্পষ্ট মুসলমান পক্ষ নিয়েছেন। সেটা নেওয়াও দোষের নয়। কিন্তু বস্তুনিষ্ঠতা থাকতে হবে। কেন সেটা নেই? কারণ এই সহকারী সম্পাদক জেরুজালেমকে মুসলিমদের পবিত্র স্থান দাবী করে ইহুদীদের এখানে স্রেফ দখলদার বানিয়ে ফেলেছেন। এমনকি ইহুদীদের নবীদের যেমন ইব্রাহিম (আব্রাহাম) দাউদ (ডেভিড) সোলাইমান (সলমন)সহ অন্যান্য নবীদের ‘মুসলমানদের নবীদের স্মৃতি বিজরিত জেরুজালেম’ বলা হচ্ছে। অথচ এটি ইহুদী ধর্মের প্রধান তীর্থস্থান। ইসলাম ধর্ম প্রচার হয়েছে ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের পর। সেখানে ইহুদীরা সাড়ে তিন হাজার বছর ধরে নানা মিথ ইতিহাস মিলিয়ে তাদের নবীদের কাহিনী বলে আসছে। এইসব নবীকে ইসলাম স্বীকার করে নিয়েছিলো। তাতেই এরা সবাই ইসলামের একমাত্র সত্ত্বাধিকারী হয়ে গেছে? ইসলামের সঙ্গে জেরুজালেমের সম্পর্ক কি ইহুদীদের চাইতে গভীর? মোটেও না। অলৌকিক উপায়ে আকাশ ভ্রমণ করার সময়, একটি ডানাওয়ালা গাধা ও খচ্চরের মাঝামাঝি সাইজের প্রাণীর কাঁধে চড়ে ইসলামের নবী সপ্ত আকাশে আল্লার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে জেরুজালেম ট্রানজিট নিয়েছিলো এরকম একটা বিশ্বাস মুসলমানরা করে থাকে। কারণ মক্কা থেকে জেরুজালেম ইসলামের নবী অলৌকিক উপায়ে ভ্রমণ করেছিলেন, এমনকি বাইশ বছর তিনি এখানে ছিলেন না এরকম একটা বিশ্বাসের ঘটনাই জেরুজালেমের সঙ্গে ইসলামের সম্পর্ক। ইহুদীদের তীর্থস্থানকে কিবলা করে মুসলমানরা প্রাথমিক যুগে কিছুদিন নামাজ পড়েছিলো। পরে ওমর জেরুজালেম দখল করে নিলে কথিত মিরাজের সময় ইসলামের নবী যেখানে অবস্থান করেছিলেন বলে বিশ্বাস করা হয় সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। সেটাই এখন আল আকসা। আর এতেই জেরুজালেম হয়ে গেলে মুসলমানদের? এটা তো অন্যের তীর্থস্থান চুরি করা! যে কিবলা বাতিল করা হয়েছে সেটা তো এমনিতেই মুসলমানদের কাছে গুরত্ব হারিয়েছে। সহকারী সম্পাদক পুরোপুরি ইসলামিক মাইন্ডে লিখেছেন-

‘এসব কারণে আল-আকসায় ইসরায়েলি হামলাকে শুধু ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের আগ্রাসন হিসেবে দেখলে হবে না। আল-আকসার অসম্মান বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের জন্য অপমান। আর প্রতিবছর নিয়ম করে সেখানে রোজার মাসে মুসলমানদের ওপর ইসরায়েলের বাহিনীর এই আক্রমণ মূলত সমগ্র মুসলমানদের ওপর উগ্র ইহুদিবাদীদের নির্লজ্জ আগ্রাসন’।

সহকারী সম্পাদক কিন্তু বলেই দিয়েছেন ফিলিস্তিনি ইজরাইল সমস্যা কোন দেশ কেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদী লড়াই নয়, তিনি বিভিন্ন জিহাদী গ্রুপের মত মনে করেন এটা মুসলমানদের সঙ্গে ইহুদীবাদীদের লড়াই। ধন্যবাদ এই স্পষ্ট অবস্থানের জন্য। এডওয়ার্ড সাঈদ বা মাহমুদ দারবিশদের মত দার্শিনিক কবিরা কিন্তু কখনোই এভাবে এই সমস্যাকে দেখতেন না ও স্বীকার করতেন না। এডওয়ার্ড সাঈদ তো ছিলেন ফিলিস্তিনি খ্রিস্টান। তারা বলতেন, তারা তাদের দেশের জন্য লড়ছেন। কিন্তু এই ইস্যু নিয়ে বাকী ইসলামিক বিশ্ব ও মুসলমানরা যে সাম্প্রদায়িকভাবে লড়ছে সেটা আগে কেউ স্বীকার করতে চাইত না। সহকারী সম্পাদককে ধন্যবাদ লুঙ্গি খুলে ফেলায়!

আল আকসা মসজিদকে ইজরাইল নয়, ইহুদীরা যে এখনো মেনে নিয়েছে সেটাই সহিষ্ণুতার একটি নির্দশন। কারণ তুরস্ক দখল করার পর মুসলমানরা সাইয়া সোফিয়া গির্জাকে মসজিদ বানিয়েছিলো। পরে আতার্তুক কামাল পাশা সেটাকে জাদুঘর করে রেখে দেন। এরদোয়ান সেটাকে গত বছর ফের মসজিদ হিসেবে চালু করেন। মক্কা প্যাগনদের ছিলো। সেখানে কি একটি মন্দিরের কোন চিহ্ন কেউ দেখাতে পারবে? হিন্দুদের কাশি গয়াতেও মুঘল সম্রাট ঔরাঙ্গজেব মসজিদ বানিয়েছিলো যা আজো আছে। ওমর জেরুজালেমে মসজিদ বানিয়েছে সেটা আজো আছে। ইসলামের কোন তীর্থভূমি দখল করে কেউ মন্দির গির্জা বানালে সেটি কি পরে আস্ত থাকত? তাছাড়া আল আকসায় ঘোষণা করে ফিলিস্তিনিদের সেখানে নামাজ পড়তে যেতে বলার মানে কি? দেড় লাখ মানুষ গত জুম্মায় সেখানে নামাজ পড়েছে। পকেটে পাথর নিয়ে এরা সেখানে নামাজ পড়তে যায়। চোরাগুপ্তা হামলা করে ইজরাইল সৈন্যদের উপর ছোরা মারা হয়। ফিলিস্তিন মসজিদগুলির সমস্ত মাইক ইজরাইল অভিমুখে তাক করে উচ্চস্বরে আজান দেয়া হয়। কেন? এরকম নিরাপত্তা হুমকিতে থাকা মসজিদটি যে এখনো বন্ধ করেনি সেটাই কি ভাগ্য নয়?

এই বিষয়গুলি কোন ধর্ম বিশ্বাসী মুসলমানই ফিলিস্তিনি কাশ্মির প্রশ্নে তুলে ধরবে না। যে কারণে কোন ধর্ম বিশ্বাসী মুসলিম অথবা মুসলিম জাতীয়তাবাদী নাস্তিক অজ্ঞেয়বাদী কেউ বস্তুনিষ্ঠ হতে পারেন না। উল্টো তারা বিভিন্ন উগ্রবাদী মুসলিম দলগুলি জন্মানোর জন্য ফিলিস্তিনে ইহুদীবাদী আগ্রাসন ও ভারতের কাশ্মিরে আগ্রাসনকে দায়ী করে। এইসব নিপীড়ণের ক্ষোভ থেকেই নাকি জঙ্গি দলগুলির জন্ম। কী যুক্তি! তাহলে আফগানিস্থানে সুন্নিরা শিয়াদের মসজিদে হামলা চালায় কেন? বাংলাদেশের শোলাকিয়া ঈদের নামাজে কেন মুসলিম জঙ্গিরা হামলা চালায়? পাকিস্তানের মসজিদগুলিতে কেন মুসলমানরা অপর মুসলমানদের উপর হামলা চালায়? কাদিয়ানী মুসলমানদের উপর কেন সুন্নিরা হামলা চালায়? তুরস্কের কেন এতগুলি জঙ্গি সংগঠনের জন্ম হলো? ৯৮ ভাগ মুসলমানের দেশেও কেন রমজান মাসে মসজিদগুলি রক্তে রঞ্জিত হয়? কি জবাব? আছেন কোন সহকারী?

25 April 2022

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted