বাংলাদেশের ‘মুসলিম মানবাধিকারবাদীরা’ কিংবা ভারতীয় বিশ্ব মানবাধিকারের পুজারীরা বেলুচদের উপর বর্বরতা নিয়ে ফলাও করে কিছু বলেছে কেন?

পাকিস্তানে কয়েকজন চাইনিজ নাগিরককে হত্যা করা হয়েছে আত্মঘাতি হামলা করে। না, জান্নাতে যাবার লোভে কোন মুমিন বান্দা এই কাজ করেনি। কাজটা করেছে সম্পূর্ণ জাগতিক কারণে। বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি নামে একটি স্বাধীনতাকামী দলের এক নারী কর্মী আত্মঘাতি হয়ে হত্যা করেছে চাইনিজদের। বেলুচদের অবদমিত করে রাখার পিছনে চীনের বড় ভূমিকাকে বেলুচরা দায়ী করে থাকে। সেটা যে বেলুচরা সহ্য করবে না সেটা জানান দিতেই এই হামলা। সত্যি কথা বলতে বেলুচদের সম্পর্কে জ্ঞান হওয়ার পর প্রায় কিছুই জানতে পারিনি।

কারণ বাংলাদেশের ‘মুসলিম মিডিয়া’ ও ভারতীয় মিডিয়া বেলুচদের স্বাধীনতার বিষয়ে বরাবরই সেন্সর করে রাখে। তাদের আগ্রহ ভারত শাসিত কাশ্মীর নিয়ে। ভারত কাশ্মীরকে স্বাধীন হতে দিচ্ছে না, স্বাধীনতাকামী কাশ্মীরীদের পাখির মত গুলি করে মারছে- এইগুলি বাংলাদেশের ‘মুসলিম মিডিয়া’ ‘মুসলিম বুদ্ধিজীবী’ ও ভারতীয় লিবারাল মিডিয়া দেখাতে বেশি পছন্দ করে। মাওবাদী ভারতীয় লেখিকা অরুন্ধতী রায় একবার দাবী করে বসলেন, ভারতীয় সেনাবাহিনী তার নিজের দেশের মানুষের উপর হত্যাযজ্ঞ চালায় কিন্তু পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর নামে এরকম কোন অভিযোগ নেই।



অথচ পাকিস্তান সেনাবাহিনী তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে। এমনকি বেলুচদের ঘরে ঘরে গিয়ে টর্চার করা, তাদের নারীদের ধর্ষণ করা, গুম করে ফেলা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে ডেইলি রুটিন! আপনি কখনই কি শুনেছেন বাংলাদেশের ‘মুসলিম মানবাধিকারবাদীরা’ কিংবা ভারতীয় বিশ্ব মানবাধিকারের পুজারীরা বেলুচদের উপর বর্বরতা নিয়ে ফলাও করে কিছু বলেছে? বেলুচদের ৫০ বছরের স্বাধীনতা আন্দোলনের কথা প্রায় কেউ জানেই না। কাশ্মীর নিয়ে জাতিসংঘ থেকে বিশ্বনেতারা প্রায়ই মুখ খুললেও বেলুচদের বিষয়ে কেউ কথা তোলে না। কারণ মিডিয়ার ব্লাকআউট এখানে বড় ভূমিকা রাখে।

সম্প্রতি অরুন্ধতী রায় আবার মুখ খুলেছেন। বলছেন, আগে মৌখিকভাবে হুমকি আসলেও এখন শারীরিকভাবে আক্রমণ করা হচ্ছে। মানে উনি ক্ষমতাশীন হিন্দুত্ববাদীদের আমলে ভারতের বাক স্বাধীনতা পরিস্থিতি বুঝাতে এটা বলেছেন। তার দাবী যে অতিরঞ্জিত তাতে কোন সন্দেহ নেই। এটা খুবই সত্য হিন্দুত্ববাদীদের আমলে ভারতে হিন্দুত্ববাদীদের হাতে খুন হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তাদের এক্টিভিটির কারণে ভারতের প্রগতিশীল পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু এটাও তো অরুন্ধতীর জানা ভারতে মাওবাদীরা ‘শ্রেণীশত্রু খতম’ করার নামে কি রকম খুন খারাবী করেছে? বন্দুকের নলই ক্ষমতার উত্স- এটাই কমিউনিস্টদের শ্লোগান। কোন কমিউনিস্ট দেশে কি বাক স্বাধীনতা থাকে? গণতন্ত্র থাকে? স্বাধীন সংবাদপত্র থাকে? পার্টির মাসোহারা পাওয়া লেখক ছাড়া কোন মুক্তচিন্তার লেখক থাকে? আমরা জানি থাকে না। ভারতে যদি কোনদিন মাওবাদী শাসিত দেশ হয় তাহলে ভারতে কেউ সাহস করে একটি কথাও বলতে পারবে না। ভারতে যদি কোনদিন লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী ফের মুসলিম অধ্যুষিত কোন এলাকা আবার ভাগ হয় (যেটা করতে অরুন্ধতীরা প্রবল উত্সাহী) তাহলে সেসব দেশ হবে ইসলামিক দেশ। সেই দেশে কি কারোর মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে? দেওবন্ধের হুজুররা যে ‘গজওয়াতুল হিন্দের’ খোয়াব দেখেন তাদের কমিউনিটিতে কি মত প্রকাশের স্বাধীনতার চর্চা আছে? আমরা জানি নেই। তাহলে ভারতের মত বিপুল দেশের এত এত মত ও জনের দেশে একমাত্র রাক্ষস হিসেবে হিন্দুত্ববাদীদের দেখানোটা একতরফা নয়? আসাদউদ্দিন ওয়াসিসের ঘৃণাপূর্ণ বক্তব্য নিয়ে অরুন্ধতী একটিও প্রতিবাদ করেননি। যোগীর উগ্র কথাবার্তার প্রতিবাদ করলে কি আসাদের বিষয়ে চুপ করে থাকার নামই লিবারাল হওয়া? অরুন্ধতী রায় কি ভারতে পাকিস্তানের ইসলামিক জঙ্গি নেটওয়ার্ক নিয়ে কখনোই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে? করেনি। ভারতীয় ধর্মান্ধ মুসলিম কমিউনিটির হিজাব পরা নিয়ে তুলকালাম কান্ড যে এই কমিউনিটির উপর ইসলামের মৌলবাদ প্রভাব বিস্তার করবে সে বিষয়ে তিনি মুসলিমদের সতর্ক করেন না। কাশ্মীর ফাইলস সিনেমা নিয়ে তিনি বলেন মিথ্যা ঘটনা নিয়ে এই সিনেমা বানানো হয়েছে। ঘটনা যে ‘মিথ্যা’ সেই মিথ্যা ইতিহাসটা এতদিন তারা চেপে গিয়েছিলেন কেন? কাশ্মীর ভারতের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যের অন্যতম সেখান থেকে হিন্দু পন্ডিতদের উচ্ছেদ নিয়ে তারা এতকাল চুপ ছিলেন তো সেটাই থাকতেন। যখনই সেই ঘটনা নিয়ে কেউ সিনেমা বানাচ্ছে তখন কেন কথা বললেন? কাশ্মীরের হিন্দু পন্ডিত উচ্ছেদ নিয়ে উনি এবং উনার মত বুদ্ধিজীবীদের অন্তত একটি মানবিক লেখা কেউ দেখাতে পারবেন যেটা উনারা দশ-পনোরো বছর আগে লিখেছেন? নেই।

বেলুচ নিয়ে কথা বলি। যিনি আত্মঘাতি হয়ে মারা গেছেন তিনি একজন উচ্চশিক্ষিত নারী। তার ছোট ছোট দুটি ছেলেমেয়ে আছে। এই নিস্পাপ শিশুদের মায়া পুরোপুরি উপেক্ষা করে বেলুচিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনে নিজেকে উত্সর্গ করেছেন শারি বালোচ। এই ঘটনা আমাকে মর্মাহত করেছে। কোন আদর্শের জন্যও আমি হত্যাকে শিকার করি না। বেলুচ একদিন স্বাধীন হবে কিন্তু তাতে খুব বেশি পরিবর্তন কি বেলুচদের হবে? বেলুচদের এখন যারা শোষণ করছে তাদের বদলে স্বজাতি আরেক শাষক দল বেলুচদের শোষণ করবে। যারা গরু মোষের মত ধনীদের জন্য খেটে মরে তারা বংশ পরম্পরায় খেটে যাবে। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ হওয়ায় শাসক বদলেছে মাত্র। পরিস্থিতি কি বদলেছে? এই রক্ত আর আত্মত্যাগের উপর কিছু ‘শাহি পরিবার’ তৈরি হবে যারা দেশ শাসনের একমাত্র উত্তরাধিকার বলে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করবে। নিঃসন্দেহে দেশের উপর জুলুম করা, পরাধীনতার শেকল ভাঙ্গার জন্য লড়াই করতে হবে। কিন্তু যে সত্যগুলি বললাম সেগুলি মিথ্যে হয়ে যাবে না। আবেদনও ফুরাবে না। এই দুটি শিশু মাতৃস্নেহ বঞ্চিত হলো। বেলুচিস্তান লিবারাল আর্মি আত্মঘাতী হওয়া শারি বালোচকে আত্মঘাতি হওয়া স্কোয়াড থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে অনুরোধ জানায় তার দুটি শিশু সন্তানের কথা বিবেচনা করে। কিন্তু শারি তার সিদ্ধান্তে অটল থাকে। বেলুচদের স্বাধীনতার প্রতি সমর্থন জানাই। কিন্তু এই হত্যাযজ্ঞকে নয়। কোন শিশুর মায়ের অপেক্ষায় কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে যাওয়াকে নয়...।

ছবি: দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা
#সুষুপ্ত_পাঠক
27 April 2022

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted