“মনুবাদ, মনু এবং মনু সমহিতা”
ডাঃ মৃনাল কান্তি দেবনাথ
***** প্রথমেই বলে রাখি, দেবনাথ গোষ্ঠি নিজেদের রুদ্রজ ব্রাহ্মন বলে দাবী করলেও ১১৬০ সাল থেকে ১১৭৯ সাল অবধি পুরো বাংলা এবং বিহারের মিথিলা নিয়ে যে বিশাল সাম্রাজ্য ছিলো তার অধিপতি সেন বংশের দ্বিতীয় রাজা বল্লাল সেন “কৌলিন্য প্রথা” চালু করে দেবনাথ/নাথ গোষ্ঠিকে(যোগী সম্প্রদায়) ‘পতিত শ্রেনী” ভুক্ত করেন। সেই সময় পতিত শ্রেনীর জন্য এখনকার মতো সব কিছুতেই রিজার্ভেশন না থাকায়, এবং বল্লাল সেনের এই অসনাতনি কাজের বিরোধিতা করায় এবং অন্যান্য পতিত শ্রেনীর পাশে দাড়ানোর জন্য, তিনি এই তথাকথিত “শিব গোত্রীয়” দের নিজের শাসিত অঞ্চল থেকে নির্বাসিত করেন এবং এই দেবনাথ/নাথ গোষ্ঠি পালিয়ে (উদবাস্তু হয়ে) বনে জঙ্গলে চলে যায়। সুতরাং এই লেখা পড়ে আবার কেউ ভাবতে বসবেন না যে আমি ব্রাহ্মন দের পক্ষে সওয়াল করছি। আমি জাত/অজাত/কুজাত মানি না। হিন্দুদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার কন্ট্রাক্ট নিয়ে কোনো বিশেষ শ্রেনীকে উচুও বানাই না কাউকে নিচে নামানোর চেষ্টাও ভাবতে পারি না ***********
______________________________________________
“মনুবাদ”
‘বাদ’ অর্থ্যাত ‘মত’,আর ‘বাদী’ মানে যে বা যারা কোন মতের সমর্থক। সাম্রাজ্যবাদ-সাম্রাজ্যবাদী, সমাজবাদ-সমাজবাদী ইত্যাদি।
আমি বেশ কিছু এই ‘বাদ’ এবং ‘বাদী’র খবর রাখি । একমাত্র ভারতীয় লেখা লেখি ছাড়া বিশেষ কোথাও ‘মনুবাদ’ বা ‘মনুবাদী’ শব্দ দুট দেখিনি পড়িনি। মনু সমহিতার ওপর বিদেশীদের লেখা অনেক ভাষ্য আমি পড়েছি, কিন্তু কাউকে এটা বলতে শুনিনি যে “মনু” একটা মতবাদ প্রচার করেছিলেন,যা কিনা ভারতের হিন্দুদের সর্বনাশ করে ছেড়েছে।
“মনুবাদ এবং মনুবাদী” নিয়ে সমালোচনার ঝড় একেবারে আধুনিক এবং এর পিছনে মুল হোতা কিছু বিশেষ বামপন্থী বুদ্ধিজীবি লেখক সম্প্রদায়। ব্রাহ্মন্যবাদ এবং ব্রাহ্মন্যবাদী শব্দ দুটোর প্রতিষ্ঠাতাও এই বুদ্ধিজীবি সম্প্রদায়। সাধারনত, এরা মনুবাদকেই বলেন ব্রাহ্মন্যবাদ আর তার সমর্থকদের বলেন ব্রাহ্মন্যবাদী—দুটোই সমার্থক।
এই বামপন্থীরা তাদের এই তত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য ‘মনু সমহিতা’ নামক হিন্দুদের এক বহু প্রাচীন গ্রন্থকে দ্বায়ী করেন। অনেক ভাবনা চিন্তা এবং পড়ার পর আমি এই সিদ্ধান্তে এসেছি যে, এই প্রচেষ্টা খুব সুক্ষ্ম ভাবে পরিকল্পিত এবং বেশ সুন্দর ভাবে ভারতের জন গন মনে প্রতিষ্ঠা করা হয়ে গেছে। ফলে তৈরী হয়েছে এক ‘মনু বিরোধী’ মনু সমহিতার আদ্যশ্রাদ্ধকারী সম্প্রদায়।
যেহেতু, সনাতনি ধ্যান ধারনায়,সমাজ ব্যবস্থায় বেদ এবং গীতার পরেই ‘মনু সমহিতার স্থান, বেদ এবং গীতা হিন্দুদের ধর্ম গ্রন্থ, সুতরাং হিন্দুদের মধ্যেই এক বিশাল গোষ্ঠী তৈরী হয়েছে যাদের একমাত্র কাজ এবং জীবিকা হিন্দুদের মধ্যে ঝড়তি পড়তি কিছু মানুষ কে দিনরাত গালি দেওয়া। আর এদের মুখ্য শত্রু ওই ব্রাহ্মন বংশীয় মানুষেরাই যারা প্রায় মাদাগাষ্কারের ডো ডো পাখির মতো উধাও হবার পথে।
সাম্প্রতিক কালে, এই মনুবাদী(???????) দের গাল দেওয়ার জন্য একটী রাজনৈতিক দলের ও সৃষ্টী হয়েছে,যার বর্তমান নেত্রী ক্ষমতা লাভ করার আশায় সেই (অসাধু???) ব্রাহ্মন শ্রেনীর সাহায্য নিতে দ্বিধা করেন না। দিন রাত 'দলিত দলিত' করে গলা ফাটিয়ে নিজে দিল্লির ওপরে এক প্রাসাদোপম বাড়ীতে থাকেন এবং লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে তার জন্ম দিন পালন করেন এবং সেই সংগে নিজের নানা কু কর্মের হাত থেকে বাচার জন্য, সি বি আই কে ঠেকিয়ে রাখার জন্য, দিল্লীতে ক্ষমতাসীন দলের পায়ে তৈল মর্দন করেন।
আমার মতে ‘মনুবাদ’ শব্দ বন্ধ টা আর কিছুই নয়, শুধু মাত্র ন্যুব্জ হয়ে পড়া ব্রাহ্মন বংশীয়দের বলির পাঠা করে, সেই পাঠার মাংস রান্না করে মৌজ করে রষনা তৃপ্তি করার জন্য এক ঘৃন্য পরিকল্পনা।
____________________________________________________
“মনু এবং মনু সমহিতা”
মনু কে ছিলেন???? এই মনু বিরোধীরা কি বলতে পারবেন?? মনুর কাল কি এই ‘পতিত ব্রাহ্মন শ্রেনীর উত্থানের সময় থেকে, অর্থ্যাৎ, হাজার বছরের কাছাকাছি??
শাস্ত্রে ‘মন্বন্তর’ বলে একটা শব্দ আছে। এক ‘মনু’র সময় থেকে অন্য ‘মনু’র পরিবর্তনের নাম মন্বন্তর। বলা হয় মনুকে সৃষ্টি কর্তা সৃষ্টি করেছিলেন এবং তাকে দ্বায়িত্ব দিয়েছিলেন তার সৃষ্টিকে রক্ষা এবং লালন পালনের জন্য। তাহলে এও দাড়ালো, সৃষ্টির আদি থেকে নানা মনু এসেছেন, তাদের প্রত্যকের সময় কাল আছে এবং সেই ‘মনু’ একটি উপাধি মাত্র।
ঋৄক বেদের ৮ম মন্ডলের ৩০-৩ শ্লোকে মনুর প্রশংষা করে উল্লেক আছে। সুতরাং মনু বেদের আমলের থেকেও প্রাচীন। সায়ানাচার্য তার লেখার দুটো শ্লোকে (৩-৩৪-৪ এবং ৩-৫৭-৪) মনুকে ‘আদি পিতা’ হিসাবে উল্ল্যেখ করেছেন। এই শুধু নয় বিভিন্ন সনাতনি গ্রন্থে ‘মনু’ কে মানব জাতির জনক বলে শ্রদ্ধা করা হয়েছে। ‘বৈবষ্বত্ব মনু’ র উল্ল্যেখ রয়েছে ‘শতপথ ব্রহ্মন’, অথর্ব বেদ এবং শ্রী গীতায় (৪র্থ অধ্যায়ের ১ম শ্লোকে শ্রী কৃষ্ণের উক্তি)।
তৈতিরীয় উপনিষদ, ছান্দগ্য উপনিষদ এবং ‘তন্ড মহা ব্রহ্মন’ মনুকে ‘Naturopathy’ চিকিৎষা বিদ্যার জনক বলে আখ্যায়িত করেছেন। ছান্দগ্য উপনিষদ বলেছেন সৃষ্টিকর্তা আদি মনুকে সমস্ত জ্ঞান প্রদান করেন এবং অন্যান্য মনু সারা সৃষ্টিকে সেই বিদ্যা,জ্ঞান ভান্ডার বিতরন করেন। প্রজাপতি ব্রহ্মা প্রথমে এক লক্ষ শ্লোকে সমস্ত জ্ঞান ভান্ডার রচনা করেন, পরে মনু মানুষের কল্যানে সেই শ্লোক সংক্ষিপ্ত আকারে মানবের আচরন বিধি ( Human code of conduct) হিসাবে সংকলিত করেন, যার নাম “মনু সমহিতা”। মুনি নারদ এবং অন্যান্য ঋষি ও মুনি মানুষের মাঝে মানুষের কল্যানে সেই আচরন বিধি লোকায়িত করেন ।
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................