রামায়ণে 'গোহত্যা' সংশয়ের নিরসন
ইদানীং যেহেতু রামায়ণ নিয়ে লিখছি। আমাকে একজন একটি ব্লগের লিংক দিয়ে দেখতে অনুরোধ করলো। আমি লিংকটিতে গিয়ে হতবাক হয়ে গেলাম যে কি রামায়ণ সহ হিন্দু শাস্ত্র নিয়ে কি পরিমাণে তথ্য সন্ত্রাস করা হয়েছে। বনবাসকালে সীতা শ্রীরাম এবং লক্ষ্মণ সহ প্রথমে গঙ্গা নদী এবং পরবর্তী যমুনা নদী পাড়ি দিয়েছিলো তখন তিনি অত্যন্ত ভক্তিপূর্ণ হৃদয়ে এ দুইনদীর স্তোত্র করেন। তিনি সেই স্তোত্রে তাদের উদ্দেশ্যে শতসহস্র গরু এবং সুন্দর সুন্দর বস্ত্র ও অন্ন দান করার প্রতিশ্রুতি করেন। এই বিষয়টি নিয়েই জ্ঞানপাপীদের গোষ্ঠী সজ্ঞানে মিথ্যাচার করছে। সেই মিথ্যাচারকে না জেনে অজ্ঞানতাবশত অনেকেই অনুসরণ করছে। পরিণতি বিভ্রান্ত হচ্ছে। যমুনা নদী পাড়ি দেয়ার সময়ে সীতা দেবী যমুনা নদীকে উদ্দেশ্য করে প্রার্থনা করে বলেন, এই চৌদ্দ বছরের বনবাস সমাপ্ত করে ইক্ষ্বাকুবংশীয়দের রাজধানী অযোধ্যাতে শ্রীরামচন্দ্র যেন নির্বিঘ্নে ফিরে আসে। যদি তারা নির্বিঘ্নে পুনরায় অযোধ্যাতে প্রবেশ করে তবে সীতাদেবী সহস্র গরু এবং সহস্র ঘটে দেবদুর্লভ পদার্থ দান করে যমুনার পূজা করবেন বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন।নদী পাড়ি দিতে রাম লক্ষ্মণ শুষ্ক বেনামূল দ্বারা কাঠের একটি ভেলা তৈরি করেন। সেই ভেলাতে প্রথমে সীতাকে উঠিয়ে এরপরে দশরথনন্দন শ্রীরামচন্দ্র এবং লক্ষ্মণ সানন্দে নদী পার হতে লাগলেন।
কালিন্দীমধ্যমায়াতা সীতা ত্বেনামবন্দত।
স্বস্তি দেবি তরামি ত্বাং পারয়েন্মে পতির্ব্রতম্।
যক্ষ্যে ত্বাং গোসহস্রেণ সুরাঘটশতেন চ।
স্বস্তি প্রত্যাগতে রামে পুরীমিক্ষ্বাকুপালিতাম্।।
কালিন্দীমথ সীতা তু যাচমানা কৃতাঞ্জলিঃ।
তীরমেবাভিসম্প্রাপ্তা দক্ষিণং বরবর্ণিনী।
ততঃ প্লবেনাংশুমতীং শীঘ্রগামূর্মিমালিনীম্।
তীরজৈবহুভিবৃক্ষৈঃ সন্তেরুর্যমুনাং নদীম্ ৷৷
তে তীর্ণাঃ প্লবমুৎসৃজ্য প্রস্থায় যমুনাবনাৎ ।
শ্যামং ন্যগ্রোধমাসেদুঃ শীতলং হরিতচ্ছদম্॥
ন্যগ্রোধং সমুপাগম্য বৈদেহী চাভ্যবন্দত।
নমস্তেঽস্তু মহাবৃক্ষ পারয়েন্মে পতির্ব্রতম্৷৷
(রামায়ণ: অযোধ্যাকাণ্ড, ৫৫.১৯-২৪)
"যমুনা নদীর মধ্যভাগে এসে সীতা যমুনার বন্দনা করে বললেন – ‘দেবি ! কল্যাণ করুন, আপনাকে পার হয়ে যাচ্ছি। আমার পতি যেন নির্বিঘ্নে ব্রত সমাপন করতে পারেন!
ইক্ষ্বাকুবংশীয়দের দ্বারা পালিতা অযোধ্যাপুরীতে রাম কল্যাণের সঙ্গে ফিরে এলে আমি সহস্র গরু এবং সহস্র ঘটে দেবদুর্লভ পদার্থ দান করে আপনার পূজা করব।
সুন্দরী সীতা করজোড়ে যমুনার কাছে এইভাবে প্রার্থনা করতে করতেই তাঁরা তিনজনে দক্ষিণ তীরে চলে যমুনার দক্ষিণ তীরে চলে এলেন।
এরপর তাঁরা নদীতীরজাত বহুবিধ বৃক্ষে সুশোভিতা, তরঙ্গসঙ্কুলা দ্রুতগামিনী সূর্যকন্যা যমুনা নদী ভেলায় চেপে পার হয়ে গেলেন।
তাঁরা যুমনা পার হয়ে ভেলা ছেড়ে দিলেন এবং যমুনা তীরের বন থেকে প্রস্থান করে শ্যামল পত্রাচ্ছাদিত শীতল ছায়াবিশিষ্ট 'শ্যাম' নামক বটবৃক্ষের ছায়ায় আশ্রয় নিলেন।
সীতা বটবৃক্ষের কাছে গিয়ে তাঁকে বন্দনা করে বললেন, হে মহাবৃক্ষ ! আপনাকে প্রণাম। আপনি আশীর্বাদ করুন, আমার স্বামী যেন বনবাসব্রত সুষ্ঠুভাবে পালন করতে পারেন।"
যমুনা দেবীকে সীতাদেবী যে সহস্র ঘটে দেবদুর্লভ পদার্থের সাথে গো দান করতে প্রতিজ্ঞা করেছেন, এই বিষয়টি নিয়েই অনেকেই অজ্ঞানতাবশত বিভ্রান্তিতে। যমুনাকে গো দান করার অর্থ হয় না যে যমুনা নদীতে জীবিত অবস্থায় অথবা বলি দিয়ে যমুনা নদীকে সমর্পণ করা। এখানে যমুনাকে কিভাবে দিবে তা পূর্ববর্তী গঙ্গার উদ্দেশ্যে সীতার স্তোত্রতেই পাওয়া যায়। গঙ্গার উদ্দেশ্যেও সীতাদেবী প্রার্থনা করেন, রাজা দশরথের পুত্র গঙ্গার আশীর্বাদে রাজাদেশ পালনে সমর্থ হয়ে সম্পূর্ণ চৌদ্দ বছর বনবাস করে, আবার অযোধ্যায় যেন প্রত্যাবর্তন করেন। প্রার্থনার সাথে সাথে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন, গঙ্গাদেবীর সন্তুষ্টির জন্য ব্রাহ্মণগণকে শতসহস্র গরু দান করবেন।রামায়ণের মূল শ্লোকেই "ব্রাহ্মণেভ্যঃ প্রদাস্যামি" বাক্যটি আছে। এরপরেও এ বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্ত হওয়ার কিছুই নেই। অর্থাৎ গঙ্গা এবং যমুনা নদীকে গোদান করা মানে, যুপকাষ্ঠে বলি দিয়ে অথবা জীবিত গো সকলকে নদীর জলে সমর্পিত করা নয়। নদীকে উদ্দেশ্য করে গোদান করা হলে, দান কোন ধর্মজ্ঞ ব্রাহ্মণ গ্রহণ করতেন। অথবা নদীতটে দান করা গো সকল ছেড়ে দেয়া হতো। নদীতটের অবারিত তৃণলতাদি খেয়ে সেই দানকৃত গোসম্পদ বংশধারায় বৃদ্ধি পেত। রাজাদের দানকৃত এই শতসহস্র গোরুদের দুগ্ধ সকলেই ভোগ করতে পারতো। এর প্রতি কোন ব্যক্তিকর্তৃক থাকতো না। এমনকি যে রাজা দান করতেন তারও কোন কর্তৃত্ব থাকতো না দানকৃত এই গোসম্পদে।শতসহস্র গোদানের সাথে সাথে দেবী সীতা গঙ্গাকে বিবিধ প্রকারের বস্ত্র, অন্ন এবং সহস্রঘটপূর্ণ দেবদুর্লভ বস্তু দান করার প্রতিজ্ঞা করেন। তিনি বলেন, গঙ্গার তীরে যে সকল তীর্থক্ষেত্র ও দেবতার মন্দির আছে, তাদের সকলকেই তিনি পূজা করবেন।
মধ্যং সমনুপ্রাপ্য ভাগীরথ্যাস্ত্বনিন্দিতা।
বৈদেহী প্রাঞ্জলির্ভূত্বা নদীমিদমব্রবীৎ॥
পুত্রো দশরথস্যায়ং মহারাজস্য ধীমতঃ ৷
নির্দেশং পালয়ত্বেনং গঙ্গে ত্বদভিরক্ষিতঃ৷৷
চতুর্দশ হি বর্ষাণি সমগ্ৰাণাষ্য কাননে।
ভ্রাত্রা সহ ময়া চৈব পুনঃ প্রত্যাগমিষ্যতি৷৷
ততস্ত্বাং দেবি সুভগে ক্ষেপেণ পুনরাগতা।
যক্ষ্যে প্রমুদিতা গঙ্গে সর্বকামসমৃদ্ধিনী৷৷
ত্বং হি ত্রিপথগে দেবি ব্রহ্মলোকং সমক্ষসে।
ভার্যা দোদধিরাজস্য লোকেঽস্মিন্ সম্প্রদৃশ্যসে৷৷
সা ত্বাং দেবি নমস্যামি প্রশংসামি চ শোভনে।
প্রাপ্তরাজ্যে নরব্যাঘ্রে শিবেন পুনরাগতে৷৷
গবাং শতসহস্রং চ বস্ত্রাণলং চ পেশলম্।
ব্রাহ্মণেভ্যঃ প্রদাস্যামি ত্ব প্রিয়চিকীৰ্ষয়া৷।
সুরাঘটসহস্রেণ মাংসভূতৌদনেন চ।
যক্ষ্যে ত্বাং প্রীয়তাং দেবি পুরীং পুনরুপাগতা৷
যানি ত্বত্তীরবাসীনি দৈবতানি চ সন্তি হি।
তানি সর্বাণি যক্ষ্যামি তীর্থান্যায়তনানি চ ৷৷
পুনরেব মহাবাহুর্ময়া ভ্রাত্রা চ সংগতঃ।
অযোধ্যাং বনবাসাৎ তু প্রবিশত্বনঘোঽনঘে৷৷
(রামায়ণ: অযোধ্যাকাণ্ড, ৫২.৮২-৯১)
"ভাগীরথী গঙ্গার মধ্যভাগে গিয়ে অনিন্দিতা সুন্দরী বিদেহরাজনন্দিনী সাধ্বী সীতা কৃতাঞ্জলি হয়ে গঙ্গার কাছে প্রার্থনা করলেন।
দেবি গঙ্গে! ধীমান মহারাজ দশরথের পুত্র তোমার দ্বারা রক্ষিত হয়ে রাজাদেশ পালনে সমর্থ হোন !
কাননে পুরো চৌদ্দ বছর বাস করে, আবার যেন ভ্রাতার এবং আমার সঙ্গে অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন করেন।
দেবি, সৌভাগ্যদায়িকে গঙ্গে ! তারপর বনবাসান্তে কুশলতার সঙ্গে ফিরে এসে, সকল কামনাপূরণে সমৃদ্ধা হয়ে সানন্দে তোমার অর্চনা করব।
ত্রিলোকপ্রবাহিনী দেবি ! তুমি ব্রহ্মলোকব্যাপিনী এবং ইহলোকে সমুদ্রাধিপতির স্ত্রীরূপে পরিচিতা (ত্রিলোকপ্রবাহিনী গঙ্গা স্বর্গে মন্দাকিনী, মর্ত্যে ভাগীরথী এবং পাতালে ভোগবতী নামে পরিচিতা)।
শোভাশালিনী দেবি ! পুরুষসিংহ (রাম) বনবাস থেকে ভালোয় ভালোয় ফিরে এসে রাজ্য আবার ফিরে পেলে, এই আমি তোমায় সপ্রশংস প্রণতি জানাব।
মা গঙ্গা ! তোমার প্রীতির ইচ্ছায় ব্রাহ্মণগণকে
শতসহস্র গরু এবং সুন্দর সুন্দর বস্ত্র ও অন্ন দান করব।
দেবি গঙ্গে ! প্রসন্না হও। (পতি ও দেবর সহ) অযোধ্যাপুরীতে আবার ফিরে এলে (আমি) সহস্রঘটপূর্ণ দেবদুর্লভ বস্তু দ্বারা এবং রাজকীয় বস্ত্র ও অন্ন দ্বারা তোমার অর্চনা করব।
দেবি ! তোমার তীরে যে সকল দেবতা বাস করেন এবং যে সকল তীর্থক্ষেত্র ও মন্দির আছে, তাদের
সকলকেই আমি পূজা করব।
অয়ি পবিত্রে ! পূত চরিত্র মহাবীর আমাকে এবং ভাই লক্ষ্মণকে সঙ্গে নিয়ে বনবাস থেকে প্রত্যাবৃত হয়ে অযোধ্যায় প্রবেশ করুন।"
পতির অনুকূলচারিণী অনিন্দিতা সীতা গঙ্গাকে এইভাবে প্রার্থনা করতে করতেই গঙ্গার দক্ষিণ তীরে সত্বর উপনীত হলেন।তীরে এসে শত্রুমর্দন নরশ্রেষ্ঠ রাম ভাই লক্ষ্মণ এবং পরিচিতা পত্নী বিদেহরাজতনয়া সীতার সঙ্গে নৌকা ছেড়ে দিয়ে সমুখপানে চলতে লাগলেন।শ্রীরামচন্দ্র, সীতা এবং লক্ষ্মণ গঙ্গা নদী অতিক্রম করে গঙ্গা এবং যমুনা এ দুই মহানদীর সঙ্গমস্থলে নির্জন রমণীয় পুণ্যভূমিতে উপস্থিত হলেন। সেই পুণ্যভূমি হলো ধর্মাত্মা ঋষি ভরদ্বাজ মুনিবরের আশ্রম। ঋষি ভরদ্বাজ শ্রীরামচন্দ্র, সীতা এবং লক্ষ্মণের আগমনের বার্তা পেয়ে ধেনু, অর্ঘ্য ও পা ধোওয়ার জল দিয়ে তাঁদের স্বাগত জানালেন। সেকালে নিয়ম ছিলো, কোন ঋষি মুনি এবং দেবপুরুষদের মাঙ্গলিক দ্রব্যাদি দিয়ে স্বাগত জানানো হত। প্রায় সকল শাস্ত্রেই এ মাঙ্গলিক দ্রব্যাদির বর্ণনা আছে। এমনকি অযোধ্যাকাণ্ডে শ্রীরামচন্দ্রের যখন রাজ্যে যুবরাজ হিসেবে অভিষিক্ত হওয়ার কথা তখনও মুনিবর বশিষ্ঠদেব সেবকদের মাঙ্গলিক দ্রব্যাদির একটি তালিকা প্রস্তুত রাখতে নির্দেশ প্রদান করেন। এর মধ্যে "হিরণ্যশৃঙ্গমৃষভং" অন্যতম। তাই অতিথিকে স্বাগত জানিয়ে পাদ্য ও অর্ঘ্যপাত্রের সাথে সাথে গোদান করা হতো। অথচ এই গোদানকেই কিছু ব্যক্তি কদর্য অর্থ করেছে যে, তিনি নাকি শ্রীরামচন্দ্রকে গোমাংস পরিবেশন করিয়েছেন। এই ব্যক্তিরা অন্ধের মত সনাতন শাস্ত্রচর্চা করে শুধুই তাদের ব্যক্তিগত ধারণা বা মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। সনাতন ধর্মে বেদমন্ত্র থেকে শুরু করে রামায়ণ, মহাভারত সহ বিবিধ পুরাণগ্রন্থ, স্মৃতিশাস্ত্র এ সকল জ্ঞানরাশির একটি পরম্পরা রয়েছে। অনন্ত জ্ঞানরাশির সমুদ্র থেকে বিচ্ছিন্ন দৃষ্টিতে কোন একটি মন্ত্র বা শ্লোককে সুবিধা অনুসারে প্রয়োগ করা অথবা সুবিধা অনুসারে ব্যাখ্যা করা অনুচিত। যে সকল ব্যক্তিরা বলছেন, মহর্ষি ভরদ্বাজ শ্রীরামচন্দ্র, সীতা এবং লক্ষ্মণকে গোমাংস দিয়ে তাঁর আশ্রমে আপ্যায়িত করেছেন। সেই সকল ব্যক্তিদের আমি শুধু বলবো শুধুই মুনিবর ভরদ্বাজের আপ্যায়িত করার ঠিক পূর্বের শ্লোকটিতে দৃষ্টি দিতে। সেই (২.৫৪.১৬) শ্লোকটিতে শ্রীরামচন্দ্র নিজ মুখেই স্বীকার করেছেন, তিনি বনবাসকালে পিতা কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে তপবনে বাস করে ফলমূলাহারী হয়ে ধর্মাচরণ করবেন।তাই এখানে শ্রীরামচন্দ্রের গোমাংস ভক্ষণের প্রশ্নই আসে না।
পিত্রা নিযুক্তা ভগবন্ প্রবেক্ষ্যামস্তপোবনম্ ।
ধর্মমেবাচরিষ্যামস্তত্র মূলফলাশনাঃ৷৷
তস্য তদ্ বচনং শ্রুত্বা রাজপুত্রস্য ধীমতঃ।
উপানয়ত ধর্মাত্মা গামর্ঘ্যমুদকং ততঃ৷৷
নানাবিধানন্নরসান্ বন্যমূলফলাশ্রয়ান্।
তেভ্যো দদৌ তপ্ততপা বাসং চৈবাভ্যকল্পয়ৎ৷৷
মৃগপক্ষিভিরাসীনো মুনিভিশ্চ সমস্ততঃ।
রামমাগতমর্ভ্যচ্য স্বাগতেনাগতং মুনিঃ।।
প্রতিগৃহ্য তু তামৰ্চামুপবিষ্টং স রাঘবম্।
ভরদ্বাজোঽব্রবীদ্ বাক্যং ধর্মযুক্তমিদং তদা৷
চিরস্য খলু কাকুৎস্থ পশ্যাম্যহমুপাগতম্।
শ্রুতং তব ময়া চৈব বিবাসনমকারণম্॥
অবকাশো বিবিজ্ঞোঽয়ং মহানদ্যোঃ সমাগমে।
পুণ্যশ্চ রমণীয়শ্চ বসত্বিহ ভবান্ সুখম্।।
(রামায়ণ: অযোধ্যাকাণ্ড, ৫৪.১৬-২২)
"ভগবন্ ! পিতা কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে আমরা তপোবনে প্রবেশ করব এবং সেখানে ফলমূলাহারী হয়ে ধর্মাচরণ করব।
ধীমান রাজপুত্রের কথা শুনে ধর্মাত্মা ঋষি ভরদ্বাজ তাঁর জন্য ধেনু, অর্ঘ্য ও পা ধোওয়ার জল এনে দিলেন।
উগ্র তপস্যার তাপে উত্তপ্ত ঋষি ভরদ্বাজ তাঁদের জন্য বনজাত নানাবিধ ফলমূল ও পানীয় আহরণ করলেন এবং উপযুক্ত বাসস্থানেরও ব্যবস্থা করলেন।
পশুপক্ষী এবং মুনিগণ-পরিবৃত মহর্ষি ভরদ্বাজ পত্নী আশ্রমে আগত রামকে ‘স্বাগত’বাক্যে অভ্যর্থনা করলেন। সেই স্বাগতকে প্রতিগ্রহণ করে উপবিষ্ট শ্রীরামচন্দ্রকে ধর্মযুক্ত বাক্যে বললেন—কাকুৎস্থকুলভূষণ রাম ! তোমার প্রতীক্ষায় থেকে দীর্ঘকাল পরে আজ তোমায় দেখলাম ; অকারণে তোমার নির্বাসনের কথাও শুনেছি।
গঙ্গা-যমুনার এ দুই মহানদীর সঙ্গমস্থল এই নির্জন রমণীয় পুণ্যভূমিতে তুমি সুখে অবস্থান করো।”
রামায়ণের মত মহাভারতেও গঙ্গা সরযু নদীর উদ্দেশ্যে গোদানের উল্লেখ পাওয়া যায়। নদীকে গোদান করলে তাকে যে হত্যা করা হত না, এ বিষয়টি মহাভারতের অনুশাসন পর্বের একটি শ্লোকেই পাওয়া যায়। সেই শ্লোকে গঙ্গানদী সহ নৈমিষারণ্যের উল্লেখ করা হয়েছে। নদীর উদ্দেশ্যে গোদান করলে সেই গো নদীর তটে মুক্ত হয়ে বিচরণ করে বেড়াতো। তেমনি নৈমিষারণ্য সহ কোন অরণ্যকে গোদান করলেও গো মুক্ত হয়ে বিচরণ করত। সাধারণ মানুষের কল্যাণেই এই নদী এবং অরণ্যকে গোদান করা হত।
সরয্বাং বাহুদায়াঞ্চ গঙ্গায়ামথ নৈমিষে।
গবাং শতানামযুতমদদং ন চ তেন বৈ।।
(মহাভারত:অনুশাসন পর্ব, ৯০.৩৮)
"আমি সরযু, বাহুদা, গঙ্গা, নৈমিষারণ্যে বহু গোদান করেছিলাম।তার ফলেও আমি এই ব্রহ্মলোকে আসিনি।"
গোদান বলতে শুধু গরুদানকেই বোঝায় না, ভূমিদানকেও বোঝায় এবং জ্ঞানদানকেও বোঝায়।এমনও হতে পারে রামায়ণে ভরদ্বাজ মুনিবর শ্রীরামচন্দ্রকে স্বাগত জানিয়ে পাদ্য অর্ঘ্য দিয়ে এরপরে জ্ঞানদান করেছিলেন। মহাভারতের অনুশাসন পর্বে পিতামহ ভীষ্ম রাজা যুধিষ্ঠিরকে বলেছেন, ধেনু, ভূমি জ্ঞান দানকে গোদান বলে।
তুল্যনামানি দেয়ানি ত্রীণি তুল্যফলানি চ।
সর্বকামফলানীহ গাবঃ পৃথ্বী সরস্বতী।।
(মহাভারত:অনুশাসন পর্ব, ৫৭.৪)
"ধেনু, ভূমি ও বাণীরূপ সরস্বতী এ তিনটি বস্তুই সমান এবং তাদের একই নামে অবিহিত করা হয় তা হলো 'গো'। এ তিনটি বস্তুই দাতব্য। সেই দানের ফলও সমান।এ তিনটি দান থেকে সমস্ত অভীষ্ট ফল লাভ হয়।"
আবার 'গো' অর্থে শুধুই গরুকে বোঝায় না। সূর্যের কিরণকেও বোঝায়। বেদাঙ্গগ্রন্থ যাস্কের নিরুক্তেও বিষয়টি যেমন বলা আছে, তেমনি বেদানুগত মহাভারত সহ অন্যান্য গ্রন্থেও বলা হয়েছে। মহাভারতের অনুশাসন পর্বে বলা হয়েছে, পৃথিবীতে গোসকল পবিত্রতা, পুষ্টি ও দীপ্ত সূর্য কিরণের সমতুল্য।
প্রাপ্তা পুষ্ট্যা লোকসংরক্ষণেন
গাবস্তুল্যাঃ সূর্যপাদৈঃ পৃথিব্যাম্।
শব্দশ্চৈকঃ সন্ততিশ্চোপভোগাস্ত -
স্মাদ্ গোদঃ সূর্য্য ইবাবভাতি।।
(মহাভারত:অনুশাসন পর্ব, ৫৮.৫৪)
"পৃথিবীতে গোসকল পবিত্রতা, পুষ্টি ও সূর্য কিরণের তুল্য হয়। 'গো' শব্দে ধেনু ও সূর্য কিরণ বোঝায়। গোদুগ্ধ উপভোগ করে সন্তান বেঁচে থাকে। তাই গোদাতা সূর্যের ন্যায় তেজস্বী হয়।"
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................