মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের রবীন্দ্রনাথকে মুসলিম বিরোধী, নজরুল ষড়যন্ত্রী না বানালে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে।

আমার নিজের ক্লাশ নাইনে পড়ার সময়ের কথা বলি। আমার শিক্ষক বলছিলেন, নজরুল যখন নোবেল পুরস্কার আনতে বিদেশে যাবে তার আগের দিন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নজরুলকে দাওয়াত দিয়ে খাইয়ে অসুস্থ করে দিয়েছিলো। ফলে নজরুল পুরস্কার নিতে যেতে পারেনি। রবীন্দ্রনাথকে তখন পুরস্কারটা দিয়ে দেওয়া হয়েছে...। একজন বয়স্ক মানুষ, উচ্চ শিক্ষিত, প্রশাসিনকভাবে দক্ষ, বিচেক্ষণ জ্ঞানী শিক্ষক যদি এইসব জিনিস বিশ্বাস করতে পারে তাহলে শিক্ষাদীক্ষার কার্যকারীতা বলতে যে কিছু নেই সে বিষয়ে আমি সে বয়সেই নিশ্চিত হয়ে যাই। আজকে ফেইসবুকে এক স্কুল শিক্ষিকার নজরুলকে বিষ খাইয়ে অসুস্থ করে দেওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথ তার বোনকে লেলিয়ে দিয়েছিলেন এরকম বক্তব্য অনেকে শেয়ার করছেন দেখে পুরোনো কথা মনে পড়ল। এর মানে হচ্ছে প্রায় ৭৫-৮০ বছর বয়স হবে রবীন্দ্রনাথের নজরুল ষড়যন্ত্র গল্পের বয়স। 

১৯৪৭ সালের পাকিস্তান করার জন্য পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা এই ধরণের গল্প তৈরি করেছিলো। এরকম আরেকটি গল্প হচ্ছে নজরুলকে তার হিন্দু শাশুড়ি ও হিন্দু বউ মিলে পাগল করতে বিষ খাইয়েছিলো। এই গল্প এখনো জামাতী সাইটগুলিতে দেখতে পাওয়া যায়। আজকে যদি এই গল্প কাজী সব্যসাচী শুনত নিজের মাকে নিয়ে তাহলে মনে হয় জুতা পেটা করতে আসত বাংলাদেশে। বাংলাদেশের মুসলমানদের ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদ’ প্রতিষ্ঠা করতে অনেক নিচে নামতে হয়েছে। এই লেভেলে বুদ্ধিজীবী থেকে ঠেলাওয়ালা সবাই সমান ভূমিকা রেখেছে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম এ মতিন বীরপ্রতীক বই লিখে জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হোক তা চাননি। তিনি মুসলমানরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করুক সেটা চাননি। তার এই বক্ত্যের সপক্ষে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন ইসলামী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত তথ্যসূত্রহীন এই বই। এই গল্পও মারাত্মক হিট করেছে বাংলাদেশে। আমার মনে হয় এখন স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে তাদের ৯০ ভাগই এই গল্প জানে এবং ৯৯.৯৯ জনই এই গল্প বিশ্বাস করতে পারিবারিকভাবেই তৈরি হয়ে থাকে বিধায় তারা তথ্য যাচাই বা বুদ্ধি খাটিয়ে দাবীর যৌক্তিকতা বিচার করে না। পূর্ববঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় হলে সেখানে কোন মুসলিম ছাত্রই খুঁজে পাওয়া যাবে না সেই সময়। পূর্ববঙ্গে মুসলমান শিক্ষানুরাগীরাই বরং ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করেছিলো এই যুক্তিতে যে এখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে শিক্ষা বাজেটের বেশির ভাগ টাকা এখানে বন্টন হবে ফলে স্কুলে টাকার টান পরবে। এতে হিন্দু শিক্ষার্থীদেরই লাভ হবে। কারণ তথনো স্কুলে ৫০ শতাংশও মুসলিম ছাত্র পাওয়া যেত না। তাই বিশ্ববিদ্যালয় হলে হিন্দুদেরই লাভ হবে। সবচেয়ে বড় কথা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কোন তথ্য প্রমাণই নেই। বরং গড়ে মাঠে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে মিটিংয়ের সময় কবি শিলাইদহ ছিলেন বলে ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণ রয়েছে। যাক এটা নিয়ে ভিন্ন লেখায় বিস্তারিত লিখেছি বলে এখানে তা লিখতে বিরত খাকলাম।

রবীন্দ্রনাথকে ইংরেজদের দালাল বানিয়ে নজরুলকে বিদ্রোহী রণক্লান্ত দাবী করে আরেকটি গল্প এদেশে প্রচলিত। এক্ষেত্রে বামপন্থীদের ঐতিহাসিক মিথ্যাচার খুব কাজে দিয়েছে। অথচ রবীন্দ্রনাথ যে ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের নজরবন্দী ছিলেন, তিনি জোড়াসাঁকো বা শান্তিনিকেতন থেকে বের হলেই যে গোয়েন্দারা পিছু নিতো, তার শান্তিনিকেতনকে জাতীয়তাবাদীদের আখড়া বলে ব্রিটিশরা সন্দেহ করত সেসব দলিল তথ্যসূত্রসহকারে পাওয়া যায়। সেকালের গোয়েন্দা পুলিশ নিজেদের মধ্যে যে বার্তা আদান প্রদান করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তা থেকে জানা যায় ব্রিটিশরা তাকে চোখে চোথে রাখত। এমনকি রবীন্দ্রনাথকে খুলনা আদালতের কাঠগড়ায় সাক্ষি হিসেবে দাঁড়াতে হয়েছিলো একটি বইয়ের রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগে। এই মামলায় তাকে আসামী করতেই চেয়েছিলো ইংরেজ সরকার কিন্তু গোয়েন্দা রিপোর্টে জানা গিয়েছিলো আসামী করলে মামলা দুর্বল হয়ে যাবে কারণ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বইটির সম্পর্ক সরাসরি কোথাও নেই। লেখক তাকে বইটি উত্সর্গ করেছেন মাত্র। চালাকি করে রবীন্দ্রনাথকে মামলার সাক্ষি বানানো হয়েছিলো সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগ থেকে বাঁচতে সাক্ষি দিবেন এই আশায়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সাক্ষি ইংরেজদের বেকায়দায় ফেলে দেয়। বিচারক বইটির কবিতা উত্তেজক উশকানিজনক কিনা জানতে চাইলে রবীন্দ্রনাথ উত্তর করেছিলেন, “স্বাধীনতাকাঙ্ক্ষী তরুণের পক্ষে উত্তেজক কবিতা বা গান লেখা আদৌ অস্বাভাবিক নয়। ওকালতি তার পেশা নয়, সুতরাং কবিতা বা গান কী পরিমাণ উত্তেজক হলে সেটা আইনত দণ্ডনীয় হবে সেটা তাঁর জানা নেই।” (প্রথম আলো ১১ আগস্ট, ২০১৭)।

নজরুলের লেখা গান-কবিতা চুরি করে নাকি রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরুষ্কার পাইছেন একশ্রেণীর লোক এমনটাই প্রচার করে। 

রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরুষ্কার লাভ করেন ১৯১৩ সালে। কাজী নজরুল ইসলাম জন্ম লাভ করেন ১৮৯৯ সালে। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ যখন নোবেল পুরুষ্কার লাভ করেন তখন নজরুলের বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর। 

নজরুলের প্রথম কাব্যগ্রন্থ অগ্নি-বীণা প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালে। রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তিরও ৯ বছর পর। 

অগ্নি-বীণা কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদ আঁকেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিখ্যাত চিত্রশিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইপো। 

১৯১৩ সালে যে গ্রন্থের জন্য রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরুষ্কার পান সে গ্রন্থের ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস। সেই ইয়েটস সাহিত্যে নোবেল পান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল প্রাপ্তির ১০ বছর পর। অর্থাৎ ১৯২৩ সালে।  

এখন বলেন, ১৯১৩ সালে নোবেল পাওয়া কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কীভাবে মাত্র ১৪ বছর বয়সী নাবালক কাজী নজরুল ইসলামের গান, কবিতা চুরি করে? যার প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালে? তাও আবার অগ্নি-বীণার প্রচ্ছদ এঁকে দিছেন রবীন্দ্রনাথের ভাই-পো অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর!


এই হচ্ছে গল্প।  মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের রবীন্দ্রনাথকে মুসলিম বিরোধী, নজরুল ষড়যন্ত্রী না বানালে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। একইভাবে বামপন্থীদের রবীন্দ্রনাথকে বুর্জোয়া জমিদার না বানালে লেনিন স্টালিন মাওকে পিতৃপুরুষ কি করে বানাবে?

#সুষুপ্তপাঠক
26 May 2022

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted