ইসলাম ও কমিউনিজম
........................................................
আমি যখন কৈশোর পার হয়ে তারুণ্যে সদ্য পা দিয়েছি, প্রগতিশীলতার অবস্থান থেকে ছিলাম কমিউনিস্ট ঘেঁষা। আমাকে কেউ কমিউনিস্ট বললে বিরোধীতা করতাম না। যদিও কোনদিনই কোন পার্টিতে নাম লেখাইনি। তবে সখ্যতা ছিলো অনেকজনের সঙ্গেই। কমিউনিস্টদের সঙ্গে মিশেই টের পেয়েছিলাম তারা ইতিহাস বলার সময় ভারতবর্ষের ব্রাহ্মণ্যবাদী সাম্রাজ্যবাদ, ইউরোপের খ্রিস্টান চার্চের শাসনকার্যে প্রভাব ও বর্বরতা নিয়ে সামন্ত যুগের ইতিহাস বলা শুরু করলেও ইসলাম বিষয়ে একদম কিছু বলত না। ইসলামী সাম্রাজ্যবাদ যে পৃথিবীর অনেকটা জুড়ে দখল হয়েছিলো সে বিষয়ে তারা কিছু বলত না। উপরন্তু ইসলামের নবীর নামে কিছু জাল হাদিস তারা নবীর প্রশংসা হিসেবে ব্যবহার করত। যেমন ইহুদী বুড়ির নবীর পথে কাঁটা বিছিয়ে রেখে নবীকে কষ্ট দেওয়া, তারপর জ্ঞানীর মর্যাদা শহীদের রক্তের চেয়ে দামী, শিক্ষা অর্জন করতে সুদূর চীনদেশে যাও’ এরকম জাল মিথ্যা হাদিস তারা আলোচনা সভায় বলত।

বাংলাদেশের পেক্ষাপটে এখানে ইসলামী মৌলবাদ হুমকি স্বরূপ হলেও কমিউনিস্টদের সব সমস্যার সমাধান প্যারাসিটমল তিনবেলার মত করে আমেরিকার উপর চাপিয়ে দিয়ে উপসংহার টানত। আমেরিকা আফগানিস্তানে হামলা চালিয়েছে, ইরাকে হামলা চালিয়েছে তারপরই নাকি সেখান থেকে বিদ্রোহীরা ছড়িয়ে পড়ে যাদের নাম আমেরিকা দিয়েছে ‘ইসলামী জঙ্গিবাদ’। এই অবস্থান থেকেই আমার কমিউনিস্টদের সঙ্গে চিন্তার বড় রকমের ফারাক তৈরি হতে থাকে। ব্লগযুগের শুরুতে কমিউনিস্টরা ও রাজনৈতিক বিশ্বাসহীন নাস্তিকদের মধ্যে প্রগতিশীল সেক্যুলারিজম বিষয়ে একই কাতারের মানুষ মনে মনে হলেও দ্রুত রাজনৈতিক কারণে তারা সরে যেতে থাকে। ইসলামী জঙ্গিবাদ যে ইরাক আফগান হামলার কারণে হয়নি, এটার সোর্স যে ইসলামের নিজস্ব রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে, এবং সুদীর্ঘ ইসলামী খিলাফত যুগের ইসলামী সাম্রাজ্য বিস্তার যে জিহাদের মাধ্যমে ঘটেছে সেটি ইতিহাস দিয়ে যখন বুঝাতে লাগলাম তখন কমিউনিস্টরা বলা শুরু করল, সাম্রাজ্যবাদকে আড়াল করতে নাস্তিকরা আমেরিকার হয়ে কাজ করছে...।

কমিউনিস্টদের নিয়ে আমার পড়াশোনা ও অনুসন্ধান মূলত তখন থেকেই শুরু। আমি দেখলাম অবিভক্ত ভারতবর্ষে ঘোষিত ‘দারুল ইসলাম’ প্রতিষ্ঠার জন্য তীতুমীর বাঁশের কেল্লা বানানোর পরও কমিউনিস্টদের কাছে সেটা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধ! আজকে আফগানিস্থানে যেরকম শাসন চলছে, নারীদের যেভাবে চলতে বাধ্য করছে, বাংলাদেশের হেফাজত ইসলামের ১৩ দফার চেয়েও ভয়ংকর সব দাবী সম্বলিত ‘ওহাবী আন্দোলন’ শুরু হয়েছিলো অবিভক্ত ভারতবর্ষে, কমিউনিস্টদের কাছে সেটাও স্বাধীনতা আন্দোলন! আমি দেখলাম কমিউনিস্ট লেখকদের খিলাফত আন্দোলন, জিজিয়া কর, ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের অধিকার ইত্যাদি বিষয়গুলি উঠে আসছে কোন রকম বিরূপ প্রতিক্রিয়া ছাড়াই! যদিও বাংলাদেশের কমিউনিস্টদের নাস্তিক হিসেবে ইসলামপন্থিরা দেখে ও ঘৃণা করে। ভারতবর্ষের কমিউনিস্টরা যুক্তি দেখাতে পারে ভারতে যেহেতু হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ তাই এখানে হিন্দু মৌলবাদের ভয়টা বেশি, কিন্তু বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি অফিসে নামাজের ঘর থাকে কেন? ভারতের কমিউনিস্টরাই কেন ইসলামী জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ধরপাকড় শুরু হলে জনগণের দৃষ্টি অ্ন্ন বস্ত্র থেকে ঘুরিয়ে নিতে সাজানো নাটক বলে দাবী করে?

নিঃসন্দেহে সমাজতন্ত্রই পৃথিবীর সমাধান। কে না চায় সবাই তার মৌলিক অধিকার পাক? আমাদের মত দেশে সমাজতন্ত্রই সমাধান। কিন্তু সেটা কমিউনিস্টদের হাতে হতে হবে কেন? কার্ল মার্কস সমাজতন্ত্রের ফর্মূলা দিয়েছেন কিন্তু দেখিয়ে যাননি কিভাবে সেটা বাস্তবায়ন করতে হবে। লেনিন মাও ক্যাস্ট্র যেভাবে কমিউনিস্ট শাসন জারি করেছে তার কথা তো মার্কস বলে যাননি। তিনি বলেছেন, পুঁজিবাদ নিজেই নিজের ধ্বংস ডেকে আনবে। হচ্ছেও সেটা। কিন্তু সেই পুঁজিবাদ বিনাশ করতে কোন স্টালিন বা মাওকে ডেকে আনা মানে আপনার কন্ঠরোধ করা। আপনার মগজ তাদের পার্টির হাতে বন্ধক রাখা। আপনি কিভাবে চলবেন, কিভাবে ভাববেন সব ঠিক করে দিবে তারা। এখানেই ইসলামের সঙ্গে আমি কমিউনিস্টদের অনেক মিল পাই!

ইসলামে যেমন তার প্রধান শত্রু ‘কাফের’ তেমনি কমিউনিস্টদের প্রধান শত্রু ‘বুর্জোয়া’। ইসলামে কাফেরদের উপর হামলা চালিয়ে ইসলামী শাসন কায়েম করতে বলা হয়েছে। কমিউনিস্টরা তেমন ‘শ্রেণীশত্রু খতম’ করে ক্ষমতা দখলের কথা বলে। ইসলাম যেমন ‘জাহেলি যুগ’ বলে আগের ইতিহাস ঐতিহ্য ব্যক্তি গোষ্ঠি বিশ্বাসকে ধ্বংস করে কমিউনিস্টরাও ‘বুর্জোয়া কবি লেখক সাহিত্যিক দার্শনিকদের’ ধ্বংস করে দেয়। রাশিয়াতে কমিউনিস্ট শাসনে তাই সেখানে কি ধরণের সাহিত্য হবে তা ঠিক করে দেওয়া হয়। পালাতে থাকে ভিন্ন মতালম্বীরা। পুরোনো লেখকদের লেখা সমাজতন্ত্রী রাশিয়াতে যাদের কমিউনিস্ট আদর্শের পরিপন্থি মনে হয়েছে তাদের বিস্মৃত করে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। ভারতবর্ষে নকশালদের শ্রেণী শত্রু খতমের লিস্টে বহু লেখক কবি সাহিত্যিকদের নাম উঠেছিলো। ইসলামী শাসনেও অনুরূপ অবস্থান নেওয়া হয়। ইসলামী শাসনে ভিন্ন আদর্শের রাজনীতি এলাউ না। একইভাবে কমিউনিস্ট শাসনে ভিন্ন আদর্শের রাজনৈতিক দল করা যায় না। ইসলামের যেমন শরীয়ত আছে যা কোনভাবেই লঙ্ঘনীয় নয়, সংস্কার করা যায় না, কেউ সংস্কার করতে চাইলে বা প্রথা ভাঙ্গতে চাইলে শরীয়তের মূল ধরে থাকা মৌলবাদীরা তাদের সহি ইসলাম নহে বলে হুংকার দেয় বা বয়কট করে একইভাবে কমিউনিস্টদের শরীয়তের নাম মার্কসবাদ। কমিউনিস্টরাও সব কিছু ‘মার্কস বলেছেন’ দেখে নিয়ে ফতোয়া দেয়। এই মার্কসবাদের মধ্যেও তাই মৌলবাদী আছে যারা গণতান্ত্রিক ভোটে অংশগ্রহণকে সহি মার্কসবাদ মনে করে না। কমিউনিস্টরাও ইসলামী হুজুরদের মত নানা তড়িকায় বিভক্ত এবং সকলেই মার্কসের একনিষ্ঠ ও একমাত্র সহি অনুসরণকারী বলে দাবী করে। একটা পর্যায়ে এসে তাই কমিউনিস্টরা আধুনিক হতে ভয় পায় পাছে মার্কস থেকে তারা দূরে সরে যায়। ইসলামেরও একই অবস্থা। ইসলাম একটা ধর্ম এটুকু বাদ দিলে ইসলামের রাজনীতির সঙ্গে কমিউনিস্টদের অনেক মিল।

#সুষুপ্তপাঠক
30 May 2022

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted